Tuesday, November 20, 2007

দুর্যোগ

এবারের মত দুর্যোগ আমি আগে দেখিনি। এই সিডর নাকি স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম। এখন পর্যন্ত আমার জিবদ্দশায় বড়রকম ঘূর্ণিঝড় ছিল ১৯৯১ এর ২৯শে এপ্রিলে। সেটা প্রায় প্রতিবছর স্মরণ করা হয়। ছোট ছিলাম, ঢাকায়ই ছিলাম। তাই সেবার তেমন কিছু বুঝতে পারিনি, শুধু টিভিতে দশ নাম্বার মহাবিপদ সংকেতের ঘোষণা দেখাচ্ছিল বারবার। আর বাবা মাকে দেখেছিলাম গ্রামের বাড়ির জন্য চিন্তিত। এবার তো ঝড়ের দিন রাতের বেলা কি ভয়াবহ শোঁ শোঁ শব্দ বাতাসের! ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে আর আসার নাম নেই পুরো শহরে। পানির অভাব। রাস্তায় রাস্তায় বেশকিছু বিলবোর্ড মোচড়ানো, গাছ উপড়ানো। এটা কেবল ঢাকার কথা, সিডর যেখানে কেবল শুঁড় বুলিয়ে গেছে। সত্যিকারের তান্ডব যেসব জায়গার উপর দিয়ে গেছে সেসবের কথা তো চিন্তা করা যায় না। ঝড়টার আয়তন বাংলাদেশের আয়তনের চেয়েও বড়। কোন একটা চরাঞ্চলে সাহায্যকারীরা গিয়ে দেখে এখানে সেখানে মৃতদেহ পড়ে আছে অনেক। কি বীভৎস! এসব কিছু মিলিয়েও নাকি ক্ষতির তীব্রতা কম, যেহেতু সুন্দরবনে ধাক্কা খেয়ে সিডরের তেজ কিছুটা কমে গিয়েছিল। টিভিতে খবর দেখতে বসলে অবস্থার নমুনা জেনে দেখে হতভম্ভ হয়ে যেতে হয়। হেলিকপ্টার থেকে একেকটা বস্তা ফেলা হয় আর সেটা নিয়ে টানাটানি করে কিছু মানুষ। হেলিকপ্টার এসে নামে আর ক্ষুধার্ত মানুষের একটা বিরাট দঙ্গল ছুটে আসে। স্বামীর হাতের মুঠি থেকে ছুটে হারিয়ে গেছে স্ত্রী, মায়ের বুক থেকে উড়ে গেছে ছোট্ট বাচ্চা। হঠাৎ করে যদি আমি দেখি আমার বাড়িঘর পরিবার পরিজন সবকিছু কয়েক নিমিষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে আমার তখন কেমন লাগবে? আর যাদের জীবনে সত্যিকার ঘটে গেল তারা কি ভয়ংকরভাবে বেঁচে আছে! শত মাইল দূরে বসে আমি বা অন্য কেউ কিছুই অনুমান করতে পারব না। এমনিতেই রিলিফের ঘাটতি, তার মাঝে নিশ্চয়ই এর কিছু অংশ পকেটস্থ করার তালে থাকবে প্রভাবশালী কেউ কেউ। এটা সত্যি আমাদের দেশ অনেক ঘুষখোর আছে, অনেকে চাকরির বেতনে চলতে না পেরে অন্যায় করে। কিন্তু নিঃস্ব মানুষের প্রাপ্য চুরি করে তেলা মাথায় তেল দিতে গেলে অনেক অনেক বেশি নীচ হতে হয়। প্রকৃতিই বা এমন নিষ্ঠুর হবে কেন? আমাদের ভাঙাচোরা দেশটার কপালেই এত দুর্গতি হতে হবে? এক জায়গায় ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে জীবনের সমাপ্তি তো আরেক জায়গায় নদী ভাঙতে ভাঙতে বসতভিটা বিলীন। তার মাঝে যে কোন সময় হতে পারে বিরাট ভূমিকম্প। ধীরে ধীরে সাগরের পানির লেভেল উপরে উঠছে। হঠাৎ হয়ে যায় সিডর। পৃথিবী বুড়ো হচ্ছে, জরাগ্রস্ত হচ্ছে। কিছুদিন আগে একটা প্রতিবেদনে দেখাচ্ছিল কয়েকজন বিদেশি পরিবেশবিদ গবেষণা করতে এসে নাকি বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের খাপ খাইয়ে নেয়ার নমুনা দেখে মুগ্ধ। আর তারা হিসাব করে বের করেছে যে আমাদের দেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনার সামনে অনেক নাজুক। প্রতিবেদনের শেষদিকে বলা হল, আশা করা হচ্ছে যে তাদের সার্বিক রিপোর্ট জেনে যেসব উন্নত দেশ পরিবেশ ভারসাম্যহীনতার জন্য মূলত দায়ী তাদের টনক নড়বে। টনক নড়বে না হাতি! যেন পৃথিবীর বাকি অংশের মানুষদের নিয়ে তাদের কোনরকম মাথাব্যথাও আছে। সিডর কেটে যাবার পর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্যের জন্য ফান্ড হচ্ছে দেশের সবখানে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের প্রত্যেকেরই ভালবাসা আর সামর্থ্যের সম্মিলন ঘটবে সেখানে।

No comments: