সারা ক্যাম্পাসে কিছুদিন ধরে অনেক ছেলেমেয়ের আনাগোনা। কারণ ভর্তি ফরম এর কাজ চলছে। লাইনে দাঁড়িয়ে ফরম কেনো, অতি সাবধানে ফিল আপ কর এবং ঠিকমত জমা দাও, এত সহজ না। টি এস সি কলাভবন সমেত সারা এলাকায় সাজ সাজ রব। প্রায়ই দেখা যায় বয়স্ক অভিভাবক বা ভর্তিচ্ছু কেউ একে ওকে জিজ্ঞেস করছে অমুক বা তমুক জায়গায় কিভাবে যেতে হবে। আমি তখন মনে মনে বলি, আরে সেইটা তো একটু ওইদিকে গেলেই হয়। আমি যখন নতুন ছিলাম, কি যে প্যাঁচানো লাগত। বিশাল ক্যাম্পাস, কলাভবনের তিন চারটা গেট, এত ডানে বাঁয়ে ঘুরেফিরে চিনে চিনে ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত যেতে যেতে তো ঘাম ছুটে যাবে। ওদের মনে হয় এখন ওই অবস্থা চলছে। কয়টা দিন পরে ওরাও হাতের তালুর মত পরিচিত বানিয়ে ফেলবে জায়গাটাকে। একদম প্রথমবার যখন জুনিয়র আসল, অর্থাৎ আমাদের পরের ব্যাচ, আমরা মোটেও খুশি হইনি। ইচ্ছা ছিল সারাজীবন ফার্স্টইয়ারে পাইয়ের মানের মত ধ্রুব হয়ে থাকব। তা আর হল কই! সেশনজটের ছোঁয়া লাগার পরও যেন হুটহাট করেই অনেকখানি শেষ করে ফেললাম। তাই নতুনদের কলকাকলি দেখি আর ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলি। কেন যে প্রথম বছরটা শেষ করলাম। তার পেছন পেছন বাকী বছরগুলোও কালের গর্ভে হারিয়ে যাবার জন্য পাল্লা দিয়েছে। এটা সত্যি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ব্যাপারটার মধ্যে এখনও অনেকখানি প্রেস্টিজ জড়িয়ে আছে; সে পাশ করে বেরুতে যত দেরিই লাগুক না কেন। আর সত্যি কথা বলতে গেলে প্রথম দিকে তো ডিপার্টমেন্ট আর ভার্সিটির নাম ভাঙিয়েই মুড নিতাম। পড়াশোনা চুলোয় যাক, নতুন পরিচিত লোকজন কতক্ষণে জানতে চাইবে কি পড়ি কোথায় পড়ি সেদিকে চেয়ে থাকতাম। বড়দের কেউ কেউ আবার বলে বসত, খুব ভাল খুব ভাল। তখন আর পায় কে। ধরেই নিতাম আমার জন্য তার সম্ভ্রমের পেয়ালা উপচে পড়ছে। এখন বুঝি এসব ভাবনা আসলে ছেলেমানুষি (আমার ভাব অবশ্য সবটা চলে যায়নি, যাবেও না)। আবার নতুন করে ভার্সিটি লাইফ শুরু করতে ইচ্ছা হয়। শুরু বলতে আমি একা পেছনে যাব না, অবশ্যই সময়টাকেও পিছিয়ে নিব। কিন্তু ফরম নিয়ে ব্যস্ত ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একথাটা বলতেই আজকে দুই বন্ধু প্রবল আপত্তি করল। একজন বলল, আবার পড়তে আসার কোন দরকার নেই। আর আরেকজন বলল, মোটেই না, বড় যখন হয়েছ, আর ছোট হতে চাওয়ার কোন মানে নেই। আরে বাবা, বড় হয়েছি দেখেই তো ছোট হতে চাই। সামনে আছেটা কি? পাশ টাশ করে বের হয়ে যাব। ফ্যা ফ্যা করে ঘুরব চাকরির জন্য। সবাই বলবে, নো নো নো, এই যোগ্যতা? অভিজ্ঞতা আছে? নেই? তাহলে আপাতত সার্টিফিকেট ধোয়া পানি খেয়েই উঠে পড় বাছা, এখানে হবে না। “কি কর মা?” “জ্বী চাচা, মানে এখন ঠিক কিছু করি না।“ সঙ্গে সঙ্গে তার সম্ভ্রমের পেয়ালা শুকিয়ে ঠনঠন করতে থাকবে। বেকার শব্দটা কেমন যেন অবহেলা মেশানো। শুনলেই মনে হয় একজন পেটরোগা যুবক, বেলা বারোটায় ঘুম থেকে ওঠে আর একটু পরপরই খোঁচা খোঁচা দাড়িসমৃদ্ধ চিবুকখানা চুলকাতে চুলকাতে হাই তুলতে থাকে। কপাল ভাল, মেয়েদেরকে কেউ “বেকার” বলে না। তবে কয়েক বছর পর বলতে শুরু করবে আশা(!) করি। আমি কিন্তু কাউকে বেকার বলি না। ইংরেজিতে বরং ভাল শব্দ আছে, unemployed. মানে দাঁড়ায়, ‘অনিযুক্ত’ টাইপের কিছু একটা। পরিশেষে ইহাই প্রার্থনা, আমি, আমার বন্ধুরা এবং অন্যেরাও ভাল ভাল কাজ করার সুযোগ পাক... ... ...
ভার্সিটির শুরু ছিল, তাই একটা শেষ তো থাকবেই, কি আর করা। এই বাচ্চারা এত কষ্ট করে সারাটা দিন খরচ করে ফরমের গতি করল, এত প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিবে, নাহয় তাদের কেউ কেউ রেজিস্ট্র খাতায় আমাদের পরের পৃষ্ঠায় নাম লেখালোই।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment