Friday, November 30, 2007

দেশ

সন্ধ্যায় বেইলি রোড থেকে রিকশা করে বাসায় ফিরছিলাম। রাস্তায় বের হলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ট্রাফিক সিস্টেমের কি ভয়ঙ্কর অবস্থা। যে যেভাবে ইচ্ছা চালাচ্ছে। নিয়ম কানুন তো অনেকই আছে। কিন্তু সেটা মানাটা তো আর ঘাড়ে ধরে করানোর কাজ না। নিজের সিভিক সেন্স নিজেকেই বজায় রাখতে হয়। যখন বাসে থাকি, দেখি স্টপেজ আসার আগেই মানুষ বাস থেকে নেমে পড়ার জন্য পাগল। সেই স্টপেজও এমন কিছু দূরে না, সেখানে নেমে কেবল একটু হাঁটলেই গন্তব্যে চলে যাওয়া যায়। এটুকু কষ্টও করতে ইচ্ছা করে না কারো। এতই আরামের কাঙাল লোকজন! তুমুল গতিতে যখন গাড়ি চলে, একটা গাড়ির গতির সাথে দিকের সাথে অন্যান্য গাড়িগুলোর চলাচলও সম্পর্কিত। অথচ যাত্রীরা মাঝপথে বলে উঠে, থামান থামান নামব। তখন এক গাড়ির গায়ের উপর আরেক গাড়ির হামলে পড়ার যোগাড়! একটু গেলেই কিন্তু স্টপেজ। যদি গাড়ি না থামে, ড্রাইভারের দোষ; আর যদি এসবের জন্য কোন দুর্ঘটনা ঘটে তাহলেও ড্রাইভারেরই দোষ। বড়ই আজব! আমাদের এমন এক দেশ! কত সমস্যা। আরেকটু ছোটবেলায় তো আমি কথায় কথায় বলতাম, আমি এই দেশে থাকব না। আমি নিউজিল্যান্ডে থাকব, অস্ট্রেলিয়াও খারাপ না। আমার আসলেই ইচ্ছা ছিল। কিছুটা বড় হবার পর থেকে অনেক মায়া লাগে। মনে হয় আমি অন্য দেশে যাব কেন, কেন থাকব অন্য দেশে। বাইরের দেশে কি এত আরাম করে প্রাণ খুলে গাল ভরে কথা বলা যায়? ফুচকা খাওয়া যায়? বারান্দায় দাঁড়ালে শাড়ি পরা পাঞ্জাবি পরা মানুষ দেখা যায়? ওখানে কি বাচ্চারা ভালভাবে বাংলা শিখতে পারে? কিজানি। যারা থাকে তাদের নানারকম অভিজ্ঞতা। কারো ভাল লাগে, কারো মন্দ লাগে। কেউ বলে একবার গেলে আর আসতে মন চায় না। আবার কেউ কেউ বলে অভ্যাস হয়ে যায়। কিন্তু নতুন করে ‘থাকা’ অভ্যাস করা কি কম ঝক্কি? হয়তবা এসব একেবারেই আমার ভাববাদী কথা। যখন কেউ চাকরি পায়না, পেলে চলার মত যথেষ্ট বেতন পায়না, বাজারে গেলে দামের আঁচে সেদ্ধ হয়, সমাজের লোকজন কটুকথা বলে তখন এত আহ্লাদ করে দেশে থাকার গোঁ ধরে রাখা যায় না। নাহয় কেনইবা পরিবার পরিজনের মায়া ত্যাগ করে কেউ কেউ কোন কাজের নিশ্চয়তা ছাড়াই ভবিতব্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে ভিনদেশে যাত্রা করে। মনের আনন্দে নিশ্চয়ই না। কিন্তু যখন কোন স্বচ্ছল ব্যাক্তির কাছে ভবিষ্যতের প্ল্যানিং জানতে চাইলে ‘এই দেশে থেকে কি হবে’ জাতীয় আক্ষেপ শুনতে হয়, সেটা বড়ই কানে লাগে। কোন বিশেষ কারণ ছাড়াই আমি আগে ভাগে ঠিক করে রাখব যে আমি এখানে থাকব না? আমি যে পড়াশোনা করার সুযোগ পেলাম যেটা কিনা সবার ভাগ্যে জোটে না, আমি যে নিজের মনস্তত্ত্বকে সুষম আকৃতি দেয়ার পরিবেশ পাচ্ছি যা কিনা এদেশের তথাকথিত সুবিধাবঞ্চিতরা পায়না, আমার কি উচিত না তাকে কাজে লাগানো? আর আমি যদি একজন সত্যিকারের “মানুষ” হতে পারি, সেই মানুষটাকে এখানেই রেখে দিই না কেন? যদি আমি এখানে ভালভাবে বেঁচে থাকতে পারি, কি দরকার পরের দুয়ারে কড়া নাড়ার? জানিনা এই স্পিরিট সারাজীবন ধরে রাখার মত সুখে আমি থাকতে পারব কিনা। এমন আশা আর স্বপ্ন তো আছেই, শুধু বাংলাদেশই আমার মধ্যে থাকবে না, আমিও বাংলাদেশের মধ্যেই থাকব।

Tuesday, November 20, 2007

দুর্যোগ

এবারের মত দুর্যোগ আমি আগে দেখিনি। এই সিডর নাকি স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম। এখন পর্যন্ত আমার জিবদ্দশায় বড়রকম ঘূর্ণিঝড় ছিল ১৯৯১ এর ২৯শে এপ্রিলে। সেটা প্রায় প্রতিবছর স্মরণ করা হয়। ছোট ছিলাম, ঢাকায়ই ছিলাম। তাই সেবার তেমন কিছু বুঝতে পারিনি, শুধু টিভিতে দশ নাম্বার মহাবিপদ সংকেতের ঘোষণা দেখাচ্ছিল বারবার। আর বাবা মাকে দেখেছিলাম গ্রামের বাড়ির জন্য চিন্তিত। এবার তো ঝড়ের দিন রাতের বেলা কি ভয়াবহ শোঁ শোঁ শব্দ বাতাসের! ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে আর আসার নাম নেই পুরো শহরে। পানির অভাব। রাস্তায় রাস্তায় বেশকিছু বিলবোর্ড মোচড়ানো, গাছ উপড়ানো। এটা কেবল ঢাকার কথা, সিডর যেখানে কেবল শুঁড় বুলিয়ে গেছে। সত্যিকারের তান্ডব যেসব জায়গার উপর দিয়ে গেছে সেসবের কথা তো চিন্তা করা যায় না। ঝড়টার আয়তন বাংলাদেশের আয়তনের চেয়েও বড়। কোন একটা চরাঞ্চলে সাহায্যকারীরা গিয়ে দেখে এখানে সেখানে মৃতদেহ পড়ে আছে অনেক। কি বীভৎস! এসব কিছু মিলিয়েও নাকি ক্ষতির তীব্রতা কম, যেহেতু সুন্দরবনে ধাক্কা খেয়ে সিডরের তেজ কিছুটা কমে গিয়েছিল। টিভিতে খবর দেখতে বসলে অবস্থার নমুনা জেনে দেখে হতভম্ভ হয়ে যেতে হয়। হেলিকপ্টার থেকে একেকটা বস্তা ফেলা হয় আর সেটা নিয়ে টানাটানি করে কিছু মানুষ। হেলিকপ্টার এসে নামে আর ক্ষুধার্ত মানুষের একটা বিরাট দঙ্গল ছুটে আসে। স্বামীর হাতের মুঠি থেকে ছুটে হারিয়ে গেছে স্ত্রী, মায়ের বুক থেকে উড়ে গেছে ছোট্ট বাচ্চা। হঠাৎ করে যদি আমি দেখি আমার বাড়িঘর পরিবার পরিজন সবকিছু কয়েক নিমিষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে আমার তখন কেমন লাগবে? আর যাদের জীবনে সত্যিকার ঘটে গেল তারা কি ভয়ংকরভাবে বেঁচে আছে! শত মাইল দূরে বসে আমি বা অন্য কেউ কিছুই অনুমান করতে পারব না। এমনিতেই রিলিফের ঘাটতি, তার মাঝে নিশ্চয়ই এর কিছু অংশ পকেটস্থ করার তালে থাকবে প্রভাবশালী কেউ কেউ। এটা সত্যি আমাদের দেশ অনেক ঘুষখোর আছে, অনেকে চাকরির বেতনে চলতে না পেরে অন্যায় করে। কিন্তু নিঃস্ব মানুষের প্রাপ্য চুরি করে তেলা মাথায় তেল দিতে গেলে অনেক অনেক বেশি নীচ হতে হয়। প্রকৃতিই বা এমন নিষ্ঠুর হবে কেন? আমাদের ভাঙাচোরা দেশটার কপালেই এত দুর্গতি হতে হবে? এক জায়গায় ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে জীবনের সমাপ্তি তো আরেক জায়গায় নদী ভাঙতে ভাঙতে বসতভিটা বিলীন। তার মাঝে যে কোন সময় হতে পারে বিরাট ভূমিকম্প। ধীরে ধীরে সাগরের পানির লেভেল উপরে উঠছে। হঠাৎ হয়ে যায় সিডর। পৃথিবী বুড়ো হচ্ছে, জরাগ্রস্ত হচ্ছে। কিছুদিন আগে একটা প্রতিবেদনে দেখাচ্ছিল কয়েকজন বিদেশি পরিবেশবিদ গবেষণা করতে এসে নাকি বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের খাপ খাইয়ে নেয়ার নমুনা দেখে মুগ্ধ। আর তারা হিসাব করে বের করেছে যে আমাদের দেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনার সামনে অনেক নাজুক। প্রতিবেদনের শেষদিকে বলা হল, আশা করা হচ্ছে যে তাদের সার্বিক রিপোর্ট জেনে যেসব উন্নত দেশ পরিবেশ ভারসাম্যহীনতার জন্য মূলত দায়ী তাদের টনক নড়বে। টনক নড়বে না হাতি! যেন পৃথিবীর বাকি অংশের মানুষদের নিয়ে তাদের কোনরকম মাথাব্যথাও আছে। সিডর কেটে যাবার পর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্যের জন্য ফান্ড হচ্ছে দেশের সবখানে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের প্রত্যেকেরই ভালবাসা আর সামর্থ্যের সম্মিলন ঘটবে সেখানে।

Wednesday, November 14, 2007

ভার্সিটি

সারা ক্যাম্পাসে কিছুদিন ধরে অনেক ছেলেমেয়ের আনাগোনা। কারণ ভর্তি ফরম এর কাজ চলছে। লাইনে দাঁড়িয়ে ফরম কেনো, অতি সাবধানে ফিল আপ কর এবং ঠিকমত জমা দাও, এত সহজ না। টি এস সি কলাভবন সমেত সারা এলাকায় সাজ সাজ রব। প্রায়ই দেখা যায় বয়স্ক অভিভাবক বা ভর্তিচ্ছু কেউ একে ওকে জিজ্ঞেস করছে অমুক বা তমুক জায়গায় কিভাবে যেতে হবে। আমি তখন মনে মনে বলি, আরে সেইটা তো একটু ওইদিকে গেলেই হয়। আমি যখন নতুন ছিলাম, কি যে প্যাঁচানো লাগত। বিশাল ক্যাম্পাস, কলাভবনের তিন চারটা গেট, এত ডানে বাঁয়ে ঘুরেফিরে চিনে চিনে ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত যেতে যেতে তো ঘাম ছুটে যাবে। ওদের মনে হয় এখন ওই অবস্থা চলছে। কয়টা দিন পরে ওরাও হাতের তালুর মত পরিচিত বানিয়ে ফেলবে জায়গাটাকে। একদম প্রথমবার যখন জুনিয়র আসল, অর্থাৎ আমাদের পরের ব্যাচ, আমরা মোটেও খুশি হইনি। ইচ্ছা ছিল সারাজীবন ফার্স্টইয়ারে পাইয়ের মানের মত ধ্রুব হয়ে থাকব। তা আর হল কই! সেশনজটের ছোঁয়া লাগার পরও যেন হুটহাট করেই অনেকখানি শেষ করে ফেললাম। তাই নতুনদের কলকাকলি দেখি আর ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলি। কেন যে প্রথম বছরটা শেষ করলাম। তার পেছন পেছন বাকী বছরগুলোও কালের গর্ভে হারিয়ে যাবার জন্য পাল্লা দিয়েছে। এটা সত্যি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ব্যাপারটার মধ্যে এখনও অনেকখানি প্রেস্টিজ জড়িয়ে আছে; সে পাশ করে বেরুতে যত দেরিই লাগুক না কেন। আর সত্যি কথা বলতে গেলে প্রথম দিকে তো ডিপার্টমেন্ট আর ভার্সিটির নাম ভাঙিয়েই মুড নিতাম। পড়াশোনা চুলোয় যাক, নতুন পরিচিত লোকজন কতক্ষণে জানতে চাইবে কি পড়ি কোথায় পড়ি সেদিকে চেয়ে থাকতাম। বড়দের কেউ কেউ আবার বলে বসত, খুব ভাল খুব ভাল। তখন আর পায় কে। ধরেই নিতাম আমার জন্য তার সম্ভ্রমের পেয়ালা উপচে পড়ছে। এখন বুঝি এসব ভাবনা আসলে ছেলেমানুষি (আমার ভাব অবশ্য সবটা চলে যায়নি, যাবেও না)। আবার নতুন করে ভার্সিটি লাইফ শুরু করতে ইচ্ছা হয়। শুরু বলতে আমি একা পেছনে যাব না, অবশ্যই সময়টাকেও পিছিয়ে নিব। কিন্তু ফরম নিয়ে ব্যস্ত ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একথাটা বলতেই আজকে দুই বন্ধু প্রবল আপত্তি করল। একজন বলল, আবার পড়তে আসার কোন দরকার নেই। আর আরেকজন বলল, মোটেই না, বড় যখন হয়েছ, আর ছোট হতে চাওয়ার কোন মানে নেই। আরে বাবা, বড় হয়েছি দেখেই তো ছোট হতে চাই। সামনে আছেটা কি? পাশ টাশ করে বের হয়ে যাব। ফ্যা ফ্যা করে ঘুরব চাকরির জন্য। সবাই বলবে, নো নো নো, এই যোগ্যতা? অভিজ্ঞতা আছে? নেই? তাহলে আপাতত সার্টিফিকেট ধোয়া পানি খেয়েই উঠে পড় বাছা, এখানে হবে না। “কি কর মা?” “জ্বী চাচা, মানে এখন ঠিক কিছু করি না।“ সঙ্গে সঙ্গে তার সম্ভ্রমের পেয়ালা শুকিয়ে ঠনঠন করতে থাকবে। বেকার শব্দটা কেমন যেন অবহেলা মেশানো। শুনলেই মনে হয় একজন পেটরোগা যুবক, বেলা বারোটায় ঘুম থেকে ওঠে আর একটু পরপরই খোঁচা খোঁচা দাড়িসমৃদ্ধ চিবুকখানা চুলকাতে চুলকাতে হাই তুলতে থাকে। কপাল ভাল, মেয়েদেরকে কেউ “বেকার” বলে না। তবে কয়েক বছর পর বলতে শুরু করবে আশা(!) করি। আমি কিন্তু কাউকে বেকার বলি না। ইংরেজিতে বরং ভাল শব্দ আছে, unemployed. মানে দাঁড়ায়, ‘অনিযুক্ত’ টাইপের কিছু একটা। পরিশেষে ইহাই প্রার্থনা, আমি, আমার বন্ধুরা এবং অন্যেরাও ভাল ভাল কাজ করার সুযোগ পাক... ... ...
ভার্সিটির শুরু ছিল, তাই একটা শেষ তো থাকবেই, কি আর করা। এই বাচ্চারা এত কষ্ট করে সারাটা দিন খরচ করে ফরমের গতি করল, এত প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিবে, নাহয় তাদের কেউ কেউ রেজিস্ট্র খাতায় আমাদের পরের পৃষ্ঠায় নাম লেখালোই।

Sunday, November 11, 2007

তত্ত্ববাদী

আমি মনে হয় আঁতেল টাইপের হয়ে যাচ্ছি। শুধু simile metaphor allegory এসব চলে আসে মাথায়। আজকে টেবিলের উপর এক ঠোঙা চিনাবাদাম দেখেও আমার মধ্যে উচ্চমার্গীয় তত্ত্বের নাচানাচি শুরু হল। সেদিন এক বন্ধু বাদাম কিনেছিল। বেচারীর দুই টাকার আধমুঠো বাদামের মধ্যে নষ্টই গেল কয়েকটা। তার উপর আবার আমার হাভাতে চোখের জুলজুলে চাহনি উপেক্ষা করতে না পেরে দানছত্রও করতে হয়েছে। তাই কাল উদাস হয়ে বাবাকে বলেছিলাম বাদামে কত ভিটামিন অথচ কতদিন বাদাম খাই না! আজকে দেখি হাজির। আমার তো মনেই ছিল না, তাঁর ঠিকই মনে ছিল। ভাবলাম, বাবা মাকে কত কষ্ট দিই, তাদের সন্তুষ্টির জন্য জীবনে কিছু করতে পারব তো? সঙ্গে খানিকটা ভাবের কথাও জুড়ে গেল। মনে হল, পরিবার যেন বাদামের মত। বাবা মা উপরের দুই পরত খোসা হয়ে ভেতরের আমাদেরকে সারাক্ষণই ঘিরে রাখেন। আর আমরা বেশিরভাগ সময়েই প্রয়োজনেরটা রেখে আঙ্গুলে ভেঙে হাতে কচলে বাকি সবটা ফেলে দিই। তবে এই তুলনাটা মোটেও যথাযথ হয়নি। আমার আঁতলামি বোঝানোর জন্য উল্লেখ করলাম।

অন্তরীক্ষ

নতুন একটা গ্রহ পাওয়া গেছে। গ্রহটা আমাদের সৌরজগতের বাইরে। পৃথিবী থেকে দূরত্ব সম্ভবত ৪১ আলোকবর্ষ। কিছুদিন পরপরই নতুন নতুন গ্রহ নক্ষত্র ধূমকেতু এটা সেটার সন্ধান পাওয়া যায়। তাতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কোন প্রভাব পড়ে না। মহাবিশ্বের কাছে আমরা কত ক্ষুদ্র! রাতের আকাশের দিকে তাকালে শহরে তেমন কিছুই চোখে পড়ে না। তবে গ্রামের দিকে যেখানে ইলেকট্রিসিটি নেই সেখানে অগুণতি তারা দেখতে পাওয়া যায়। কালপুরুষ, লুব্ধক, সপ্তর্ষিমন্ডল এসব খুঁজে দেখতে খুব উৎসাহ পেয়ে বসে। শুয়ে থেকে এমনভাবে যদি আকাশের দিকে তাকানো যায় যেন দৃষ্টির সীমানায় আকাশ ছাড়া আর কোন কিছু না আসে, তখন কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। মনে হয় আমি পৃথিবীর চূড়ায় খুব নাজুক একটা জায়গায় আছি। একটুখানি নড়াচড়া করলেই টাল খেয়ে গোলাকার জিনিসটার গা বেয়ে গড়াতে গড়াতে অজানা অসীমে বিলুপ্ত হয়ে যাব। সেই সাথে নিজেকে অতি তুচ্ছও মনে হয়। হয়ত এসবের জন্যই প্রকৃতির সাথে মানুষের এত মাখামাখি। অধরা আকাশ, বিশাল নদী, বিরাট পাহাড় বা কূলহারা সমুদ্রের সামনে একধরণের হাহাকারের মত লাগে। মনে হয় I am nothing but an insignificant human being! আমার ধারণা এরকম সময়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও খারাপ ভাবনা দূরে সরে যায়। নিজেকেই যেখানে ক্ষুদ্র লাগে সেখানে নিজের ভেতরকার ক্ষুদ্রতা আরও ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে।

Friday, November 9, 2007

বধ

আমার ক্লাসমেট খাদিজার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী চলে গেল কয়েক মাস আগে। সম্ভবত জুলাইতে। হলে থাকত খাদিজা। আপাদমস্তক কালো বোরকায় ঢাকা। আমার কাছের কেউ ছিল না। তবু যেদিন ডিপার্টমেন্টে গিয়ে ওর মৃত্যুর খবর পাই, অসহায় একটা অনুভূতি হয়েছিল। জলজ্যান্ত একটা মেয়ে হঠাৎ নাই হয়ে গেল, সেটাও কিনা নিজের হাতে নিজের মৃত্যু। ওর আত্মহত্যার কারণ জানতে পারিনি। কেউ কেউ বলেছে প্রেমঘটিত। ওর মোবাইলের সিম নাকি ভেঙ্গে টুকরা করা, রুমে এমন কোন নিশানা পাওয়া যায়নি যেখান থেকে কোন দ্বিতীয় ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু জানা যায়। ইত্যাদি ইত্যাদি। এর পরপর ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা শোকসভা জাতীয় আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে আমাদের টিচাররা অনেক কথাই বললেন। শাহনাজ সিনহা ম্যাম বললেন নিজেদের সমস্যা শেয়ার করতে, কারণ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত হল চরমতম ভুল। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের একটা কথা মনে আছে। একবার হলের এক মেয়ে নাকি প্রেমিকের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির কারণে আত্মহত্যা করেছিল। স্যার যখন খবর পেয়ে হাসপাতালে যান মেয়েটা তখন মৃত। মেয়েটার বাবার হতভম্ভ চোখের সামনে এক করুণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। তার কিছু বছর পর ওই মেয়ের প্রেমিককে স্যার দেখেন নিউমার্কেটের সামনে। সঙ্গে লোকটার স্ত্রী আর সন্তান। অর্থাৎ সারমর্ম হল একটা অন্য মানুষের জন্য জীবনটাকে ধ্বংস করে দিয়ে কি লাভ হল? পুরোটুকুই তো ক্ষতি, নিজের আর নিজের পরিবারের। রোকেয়া হলে একটা সেমিনার হয়েছিল মেয়েদেরকে জন্য, আত্মহত্যার প্রবণতার খারাপ দিক নিয়ে। মেয়েদেরকে নিয়ে যেমন সেমিনার হল, সমাজ সংসার পরিবারের লোকদেরকে নিয়ে কি তেমনটা হবে? তাদেরকে কি কেউ বোঝাবে যে জীবনে অনেক বড় কোন ভুল করে বসা কোন মেয়ের উপর ক্রোধ নিয়ে চড়াও হবার আগে অন্তত তাকে মানসিকভাবে স্থির হওয়ার সময়টা হলেও পরিবারের দেয়া উচিত? আর পাড়াপ্রতিবেশীদেরকে কি কেউ জানাবে যে কাউকে অপবাদ দিয়ে নিজেকে খুব উঁচু জায়গায় তোলা যায় না? কিংবা জানালে বা বোঝালে আদৌ কি কেউ কর্ণপাত করবে? খবরের কাগজে, খবরের কাগজের বাইরে কত কত আত্মহত্যা ঘটে রোজ রোজ! মফস্বল আর গ্রামের দিকে তো বাচ্চা বয়সী মেয়েরা পর্যুদস্ত হয়ে অহরহ মরে গিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। কে খবর রাখে। আমার ধারণা, এভাবে নিজের হাতে মৃত্যুকূপ সাজালেও মরার আগ মুহূর্তে মানুষের মধ্যে তীব্রভাবে একটা বাঁচার আকুতি জন্মায়। কিন্তু তখন ফেরত আসার কোন উপায় থাকে না। কারণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা চালায় সবার চোখের আড়ালে। আমরা কি অন্যের দোষত্রুটি বের করতে গলদঘর্ম না হয়ে বরং সহানুভূতিশীল হতে পারি না? আর আচরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারি না যে তুমি ভুল বুঝছ? অন্যের অপরাধের জন্য, বা যা ঘটেছে তার জন্য আমরা তোমার দিকে আঙ্গুল তুলে তোমাকে ঘৃণা করছি না।

Wednesday, November 7, 2007

মন

কিছুদিন আগে www.natural7wonders.com এ সুন্দরবন আর কক্সবাজারকে ভোট করলাম। পৃথিবীর সাতটা প্রাকৃতিক এলাকা বাছাই করা হবে সৌন্দর্যের ভিত্তিতে। এক নাম্বারে দিলাম সুন্দরবন আর দুই নাম্বারে কক্সবাজার। আমি এই দুইটা জায়গার কোনটাই এখনো সরাসরি দেখিনি। টিভি আর ছবিতেই যতটুকু দেখা। তবে কথা হচ্ছে বাংলাদেশের বাইরের অন্যান্য জায়গা তো আরো অদেখা। সেক্ষেত্রে নিজের দেশকে ভোট করাটাই বেটার মনে হল। একটা সাগর আর আরেকটা অরণ্য। বেশ বিপরীত। ভারতের ‘সানন্দা’ পত্রিকায় আগে দেখতাম ওদের কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিতে গেলে একটা প্রশ্ন থাকত, আপনার কোনটা বেশি ভাল লাগে, সাগর না পাহাড়? এই প্রশ্নটা আমার বেশ পছন্দ। অনেক সময়ই দেখেছি এটা একটা উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন। সাগর প্রিয় না পাহাড়। আমি নিজের কাছে উত্তর দিলে সবসময় বলি পাহাড়। দুইটার যেকোন একটা জায়গায় যাবার সুযোগ পেলে আমি পাহাড়ী কোন জায়গাই বাছাই করব। আর যেখানে ইচ্ছা যেতে পারলে প্রথমেই বান্দরবন। সাগর আর পাহাড় নিয়ে এই প্রশ্নটা কেন করা হয় জানিনা। আমার ধরে নিতে ভাল লাগে যে এর মধ্যে মানুষের প্রকৃতি বা ব্যক্তিত্বের কোন একটা দিক ফুটে ওঠে। বিভিন্ন আপাত অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, কুইজ বা কোন ছবির বিশ্লেষণ থেকে ব্যক্তিত্ব ব্যাখ্যা করা ব্যাপারটার প্রতি আমার আকর্ষণ আছে। হতে পারে এটা পুরোপুরি সঠিক হয়না। তারপরও এধরণের কিছু পেলে আমি সিরিয়াসলি সমাধান করি। তবে ফলাফলের মধ্যে চরিত্রের শুধু ভাল ভাল জিনিসগুলো না দিয়ে সবমিলিয়েই দেয়া উচিত। একবার দেখেছিলাম হাতের লেখার ধরণ দেখে মানুষ বোঝার উপায়। তো শেষ করার পর রেজাল্ট থেকে জানলাম আমিসহ সকলেই আসলে গুণের আধার। অনেকটা এরকম, যার লেখা বাম দিকে হেলানো সে মহৎ আর যার বাম দিকে হেলানো সে উদার। খুবই হতাশ হয়েছিলাম। সাইকোলজি খুব interesting একটা বিষয়। এবং সেই সাথে খুব confusing ও। মনোবিজ্ঞানকে একবাক্যে বিজ্ঞান বলাতে আমার সামান্য আপত্তি আছে। মানুষের মনস্তত্ত্বকে মনে হয় না বিজ্ঞানের মত প্লাস মাইনাসে বসিয়ে বা সূত্রে সাজিয়ে ব্যাখ্যা করে ফেলা যায়। আরেকটা মজার জিনিস আছে, রাশি। বিশ্বাস না করলেও মনোযোগ আমি ঠিকই দিই। ছোট থাকতে আমাদের মধ্যে হাত দেখা বলতে সীমাবদ্ধ ছিল কার কয়টা ছেলেমেয়ে হবে। দেখা যেত আমরা প্রায় প্রত্যেকেই বাংলাদেশের আদমশুমারিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে চলেছি। আসলে সত্যিই কি মানুষের ভাগ্য জানা যায়? বা আঙ্গুলে গোমেদ পাথর আকিক পাথর বাঁধিয়ে জীবনের মোড় ঘুরানো যায়? তাহলে তো আর এত হা হুতাশ থাকত না। আবার এটাও সত্যি যে বিপদের সময়ে, দুর্বলতার সময়ে আমরা একমাত্র আমাদের rationality কে আঁকড়ে ধরে রাখি না। অনমনীয় মনের বর্ম ভেদ করে অনেক কুসংস্কারও ঢুকে পড়ে। সারাজীবন সবরকম গোঁড়ামিকে অন্ধবিশ্বাসকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়া মাও সন্তানের মৃত্যুশয্যার সামনে এসে তাবিজ কবচ পানি পড়া ঝাড়ফুঁকের কাছে আশ্রয় নেন। এটাও মনের একটা বিচিত্র দিক। আমাদের অস্তিত্বের পুরোটা জুড়ে আছে মন। অথচ সারা শরীর কেটেকুটে তার সন্ধান পাওয়া যায় না। মস্তিষ্ককে মন বলে চালিয়ে দেয়া কি ঠিক হবে? সব অর্থ আর অনর্থের মূল আমাদের যেই মন, তা আসলে একতাল শুভ্র আর ধূসর পদার্থ, একথাটা এক বাক্যে মেনে নিতে গেলে সেই মনটাই কি দ্বিধার দোলাচালে দুলতে থাকে না?

Sunday, November 4, 2007

পেপার

কালকের পেপারে সাংবাদিকদের ছোট ছোট অভিজ্ঞতা নিয়ে কয়েকটা লেখা বের হয়েছে। পড়তে ভাল লাগল। কেউ ফটোগ্রাফার, কেউ রিপোর্টার। কাজ করতে গিয়ে কত সময় কত কিছুর সামনে পড়তে হয়, কত কিছু দেখা হয় জানা হয়। সাংবাদিকদের কাজ ভীষণ পরিশ্রমের। সংবাদ সংগ্রহ করে আনা, আবার সেটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে আমাদের তৃষ্ণা নিবারণের মত যথেষ্ট আকার প্রকার দেয়া। তার মধ্যে আবার কারো সম্বন্ধে একটু এদিক ওদিক কথা বলে ফেললেও ফাঁড়া। মোটেও সহজ না। আসলে যারা ফিল্ডে গিয়ে কাজ করেন সেটা যেই পেশাই হোক, তাদেরকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। নানারকম মানুষ, নানারকম তাদের ব্যবহার। ধৈর্য্য ধরে রাখা মুশকিল। নিজেদেরকেও লাঞ্ছনা গঞ্জনার কবলে পড়তে হয় কত। সাংবাদিকদের হাতে কোন ইস্যুতে মানুষের সমর্থন বা অসমর্থন তৈরি করার শক্তি থাকে। কেউ কেউ তার অপব্যবহারও করে। তবে কিছু বিষয় আমার একেবারেই পছন্দ না। কেউ একবার সেলিব্রেটি হয়ে গেলে তার জীবন গেল। দেশে বিদেশে কাকে কার সঙ্গে কোথায় দেখা গেছে, কার বিয়ে কেন ভাঙলো, কার সাথে কার গোপন প্রেম এসব ফলাও করে ছাপার কি আছে? আমারা যারা পাঠক তাদেরও উচিত না এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি মাতামাতি করা। নিজের যেই ব্যাপারটা আমরা নিজের কাছে রাখতে চাই, অন্যের বেলায় সেটা জানার জন্য ছটফটানি করাটা কী ঠিক? তাছাড়া আমি এই কথাটার সাথে একমত না যে যারা জনপ্রিয় বা যারা কবি লেখক অথবা শিল্পী, মানুষের প্রতি তাদের একটা “দায়বদ্ধতা” আছে। বিশেষ দায়বদ্ধতার প্রশ্ন যদি আসে, মানুষের উন্নয়ন দেখার জন্য যাদেরকে নির্বাচন করা হয়, তাদেরই সেটা বেশি থাকার কথা। তাছাড়া দায়বদ্ধতা আমাদের সবারই আছে। দেশের মানুষের কাছে পরিচিত বা আদৃত ব্যক্তির মানুষকে প্রভাবিত করার সুযগ বেশি, এটা সত্যি। তার মানে এই না যে আমরা আশা করব সারাক্ষণ সেদিকে নজর দিয়েই তাদেরকে যে কোন পদক্ষেপ নিতে হবে। অবশ্যই নিজস্ব ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য আছে।


আজকে একটা ভাল জিনিস পড়লাম। পরিসংখ্যান বলছে গত কয়েক বছরে মেয়েরা তুলনামূলকভাবে এগিয়ে গেছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিভিন্ন পেশাতে মেয়েদের উপস্থিতির হার আগের থেকে বেশি। গ্রামে নিরক্ষর মহিলারা সংসারের হাল ধরছে এরকম উদাহরণ দিনে দিনে বাড়ছে। এসব জেনে খুব ভাল লাগল। এর অর্থ হল মানুষের মানসিকতা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। আর্থিকভাবে সমর্থ হলে পরিবারে মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে সমস্যা আগের চেয়ে কমছে। অভিভাবকরা মেয়েদের লেখাপড়াকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাদের যে চাকরি করা দরকার এই ব্যাপারটাও এখন অপেক্ষাকৃত উদারভাবে নিতে পারছে মানুষ। যদিও আমি জানিনা এর পেছনে স্বচ্ছলতার খোঁজটাই বড় কারণ কিনা। কারণ যেটাই হোক, দেশের কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াটাই সুখের বিষয়। তবে মেয়েদের শিক্ষা আর পেশাজীবনের সমর্থক বাড়লেও পারিবারিকভাবে তাদের ওজন একই অনুপাতে বাড়েনি। অনেক পরিবারেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, রোজকার কাজের ভাগাভাগি বা মতের মূল্যায়নে মেয়েরা এখনো তাদের কাউন্টারপার্টের কাছে শাসিতই বলা চলে। এটারও পরিবর্তন হবে নিশ্চয়ই। আমার আকাঙ্খা মেয়েরা স্বাধীন হবে, যোগ্যতা দিয়ে বড় হবার যোগ্য হবে, দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে উদার হবে, মানসিকভাবে কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে না এবং একদিন হাতে যথাযথ ক্ষমতা পেলে সেটাকে পুরুষের বিরুদ্ধে কিছুতেই ব্যবহার করবে না। লিঙ্গবৈষম্য শব্দটার প্রয়োজনীয়তা বিলুপ্ত হোক।

Thursday, November 1, 2007

কবিতা

আজকে ভার্সিটি গেলাম না। Auden এর কবিতার একটা ক্লাস ছিল। কবিতা আমার জন্য কোন কালেই স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয় না। একেবারেই যে বুঝিনা বা একেবারেই পড়ি না তা বলব না। কিন্তু ঠিক পছন্দের না। এক বন্ধুর একটা বই আমার কাছে অনেকদিন ছিল। জীবনান্দের কবিতার সংকলন। আমি দুই তিনটার বেশি পড়তে পেরেছি বলে মনে পড়ছে না। জীবনানন্দ আরো বেশি জটিল লাগে। যেসব কবিতায় একটা গল্প আছে বা সাধারণ ছন্দে লেখা সেসবই আমার জন্য সহজবোধ্য। সঞ্চয়িতা থেকে বেছে বেছে কাহিনীভিত্তিক কবিতাগুলো পড়েছি। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ আমার সবচেয়ে প্রিয় বই। ছোটগল্প এত সুন্দর করে লেখা যায়! এই বইয়ের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটা পড়ে প্রতিবারই মন খারাপ হয়। ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘দিদি’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘রাজপথের কথা’, ‘সুভা’ সবই অসাধারণ। গল্প, উপন্যাস বা সিনেমার শেষটা সুখী সুখী না হয়ে কমবেশি দুঃখ থাকলেই আমার বেশি ভাল লাগে। ক্লাস নাইনে এক টিচার প্রশ্ন করেছিলেন আমাদের বাংলা বইয়ের কোন গল্পটা আমাদের সবচেয়ে পছন্দ। আমি বললাম, ছুটি। তারপরের প্রশ্ন, ছুটি কেন। বললাম, শেষটা দুঃখের হলে আমার ভাল লাগে। এবার প্রশ্ন, দুঃখের গল্প কেন ভাল লাগে। আর কি বলব আমি। কেন ভাল লাগে তা তো কখনো ভেবে দেখিনি। আর সবকিছুর তো বিশেষ কারণও থাকে না। আরেকদিন একই টিচার আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কোন জিনিসটায় বেশি আগ্রহ পাও, জীবজগতের খুঁটিনাটি নাকি মহাবিশ্বের গ্রহনক্ষত্র? আমি বেছে নিলাম মহাবিশ্ব। আবারও একই কথা, কেন? আমি এই টাইপের একটা উত্তর দিয়েছিলাম, মহাবিশ্ব নাগালের অনেক দূরে, এজন্য এটা বেশি আকর্ষণীয়। সেই শিক্ষিকা কেন যেন আমার দিকে বেশি লক্ষ্য করতেন। সুতরাং তাকে আমার শাশুড়ী বলা আমার বন্ধুদের জন্য স্বাভাবিকই ছিল। কারণ ক্লাসে কেউ কোন টিচারের স্নেহের পাত্র হওয়া মানেই তার ছেলের বউ। ছেলে থাকুক বা না থাকুক, ছেলের বয়স যতই হোক।

কবিতার কথা লিখতে গিয়ে কোথায় চলে গেলাম। প্রাইমারিতে পড়ার সময় আমার একটা হলুদ রঙের খাতা ছিল, ‘সহজাত কবিপ্রতিভা’র বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য। অনেক ছড়া ছিল সেখানে, অর্ধসমাপ্ত গল্প ছিল কয়েকটা। সেই খাতা খুলে নিজের ছন্দ মেলানোর ক্ষমতা দেখে বহুবার মুগ্ধ হয়েছি। নীচে তারিখ দিয়ে রাখতাম, পরে কবির বিভিন্ন বয়সের লেখা নিয়ে সংকলন বের হলে যেন সমস্যা না হয়। বিদেশি পটভূমিতে একটা উপন্যাস লেখার কাজও শুরু করেছিলাম। তবে শীঘ্রই ক্লাস সিক্সে উঠব বলে ব্যস্ততার কোন সীমা ছিল না। ফলে দুই পৃষ্ঠা পর্যন্ত গিয়েও উপন্যাসটা শেষ পর্যন্ত শেষ হল না। এটা একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে বলা যায়। কেননা সেসব গল্প উপন্যাস একটুখানি পড়ে দেখলেই বেশ যেন চেনা চেনা মনে হওয়ার একটা চান্স থাকত। তবে আমার ছড়া নিয়ে কোন অভিযোগের সুযোগ নেই, পুরোপুরি মৌলিক। হলুদ খাতাটা যদি হারিয়ে না যেত! সে নিজে তো হারালোই, আমার সবেধন নীলমণি সেই বিন্দু পরিমাণ সৃজনশীলতাটাকেও বগলদাবা করে নিয়ে গেল। এখন তো মাথা কুটেও কঞ্জুস কলমের ডগা থেকে কিছু বের করতে পারব না। অবশ্য এটা নিয়ে কোন আক্ষেপ নেই, শুধু খাতাটার জন্য যা একটু আফসোস হয়। তা হোক। জীবন যখন জীব জড় দুই নিয়েই, আনন্দ বেদনা কেবল মানুষকে ঘিরে হবে কেন, বস্তুবাচক বিশেষ্য নিয়েও হতে পারে।

আকাশকুসুম

আমেরিকায় কালকে ছিল হ্যালোউইন। সন্ধার পর বাচ্চারা নানারকম বিচিত্র পোশাক পরে বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাইরে বের হয়। তারপর প্রতিবেশীদের বাড়ির দরজায় টোকা দিয়ে বলে “trick or treat?” বেশিরভাগই খাবার দাবার ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করে। এরকম কয়েকটা বাড়ি ঘুরলেই ঝুলিতে বেশ অনেক চকলেট জুটে যাবে। তারপর ঘরে ফিরে সেসব সাবাড় করার পালা। বিশাল একটা মিষ্টিকুমড়ার ভেতরে বাতি রেখে সেটাকে নাকি বাড়ির পোর্চ বা বারান্দায় ঝুলিয়ে দেয়া হয়। তার আগেই কুমড়াটার পেটের নাড়িভুঁড়ি বের করে গায়ে চোখ নাক মুখের আকার দিয়ে রাখা হয়েছে। একটু দূর থেকে দেখলে মনে হবে একটা চেহারা ভাঁটার মত জ্বলছে। হ্যালোউইন সম্বন্ধে আমি অন্তত এমনটাই জানি। শুনে তো বেশ মজার মনে হয়। আর আফসোস হয় এমনটা আমাদের দেশে নেই বলে। বাচ্চারা আমাদের বাসায় ভূত সেজে এসে যদি বলত trick or treat, আমি বলতাম, ok trick. দেখিই না ওরা কেমন করে ফাঁদে ফেলতে চেষ্টা করে। আমি জিতে গেলে তো আমার চকলেট আমারই থাকল। আর হারলে ওরা একটু আনন্দ পেল। ইউরোপ আমেরিকার কিছু কিছু জিনিস আমার বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়। যেমন ফ্যান্সি ড্রেস পার্টি। যে যেমন খুশি একটা কিছু সেজে এল। হতে পারে সেটা ভিনগ্রহের প্রাণী অথবা মধ্যযুগের সেনাপতি। তারপর ওদের স্কুলগুলো দেখলেও খুব পড়তে ইচ্ছা করে। ভেন্ডিং মেশিন থেকে জিনিস বের করা, ফাঁকা ফাঁকা রাস্তা, নববর্ষ আর বড়দিনের উৎসব, বন্ধুদের নিয়ে ক্যাম্পফায়ার, কিছুদিনের জন্য এসবের অভিজ্ঞতা নিয়ে আসতে পারলে মন্দ হয় না। আমার খুব নিউজিল্যান্ড আর গ্রিসে যেতে ইচ্ছা করে। নিউজিল্যান্ড বললেই খুব ঠান্ডা আর সুন্দর একটা জায়গার ছবি চোখে ভেসে ওঠে। আর গ্রিস ভাবলেই মনে হয় যেন ওখানে পা ফেললেই আমি অনেক অনেক বছর আগের একটা সময়ে চলে যাব। পথে প্লেটো সক্রেটিসকে দেখা যাবে। স্টেডিয়ামের মত দেখতে থিয়েটারে নাটক চলবে। দারুণ ব্যাপার! আমাকে প্যারিসে যেতে হবে লুভ জাদুঘরে একবার ঢুঁ মেরে আসার জন্য, রোমে গিয়ে জুলিয়াস সিজারের রাজত্ব পর্যবেক্ষণ করতে হবে, স্পেনে তো না গেলেই না, দেখতে হবে জার্মানি শুনলেই যে আমার একটা কাঠখোট্টা জায়গা মনে হয় সেটা সত্যি কিনা। এ তো গেল কেবল ইউরোপের একটা অংশ। আফ্রিকা আর ল্যাটিন আমেরিকা তো পড়েই রইল। এত ফিরিস্তি দিতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে। তবে দরকার ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া হবে না। বেশি সাধাসাধি করলে বড়জোর দুবাই, ব্যস। কিন্তু এত সময় সুযোগ কোথায় পাই! টাকা পয়সাই বা কোত্থেকে আসবে! খুবই চিন্তার বিষয়।