Wednesday, October 31, 2007
হোস্টেল
একই ছাদের নীচে থাকলে মনের সাথে মনের একটা নৈকট্য সৃষ্টি হয়ে যায়। বারবার দেখা হয়, অনেক কথা হয়, সুখদুঃখ ভাগাভাগি হয়। আমি দাম্পত্যজীবনের কথা বলছি না, হোস্টেল লাইফের কথা বলছি। কাছাকাছি বয়সের অনেকগুলো মানুষ একসঙ্গে থাকে ঘুমায় খায় দায়। যেন একটা গোষ্ঠি তৈরি হয়। হোস্টেল জীবনের ভাল আর মন্দ নিয়ে এই ব্যাপারে অভিজ্ঞ আর অনভিজ্ঞদের নানারকম মত আছে। তাই মোটমিলিয়ে চার দলের চারটা রকম দাঁড়িয়ে যায় বক্তব্যের। যেমন আমাদের দেশ আর সামাজিক অবস্থা, তাতে আনন্দের ভাগটা ছেলেদের রাজকপালেই কিছুটা বেশি জোটে। গভীর রাতে বেরিয়ে গিয়ে দল বেঁধে হাঁটা ধরল, গান গাইতে গাইতে সূর্য জাগিয়ে ফেলল। মেয়েরাও খারাপ সময় কাটায় না। খাবার সময় ছাড়া হোস্টেলে ঘড়ি একটা মোটামুটি অচল যন্ত্র। রাত তিনটায় ঘুমাতে গেলেও মা বলবে না, এতক্ষণ জেগে থাকলে শরীর খারাপ করবে কিংবা দুপুর বারোটার দিকে হাই তুলতে তুলতে বিছানা ছাড়লেও বাবা বলবে না, অপদার্থকে আরো ঘুমাতে বল, এখনো সন্ধ্যা হয়নি। এসব মজার পাশাপাশি খাওয়াদাওয়ার মত খারাপ পয়েন্টও আছে অনেক। তবে স্কুলের হোস্টেল লাইফের কথা ভাবলে একটু খারাপ লাগে। যারা ক্যাডেট কলেজে পড়ে, ক্লাস সেভেনের বাচ্চাকাল থেকেই নিয়মকানুনের শেকলের মধ্যে ঢুকে পড়তে হয়। প্রথম প্রথম বাড়ির জন্য মন কেমন করে, কান্না পেয়ে যায়। সেই কাজটাও করতে হয় লুকিয়ে। কারণ ওই বয়সে আবার বিশাল ইগো। ক্যাডেটে পড়া ছেলেমেয়েরা বের হয়ে আসার পর তিন রকম কথা বলে। একদল বলে তারা ছয় বছর বলতে গেলে কারাগারে কাটিয়েছে। আরেকদল মনে করে এমন মজার লাইফ আর হয় না। আর তৃতীয় দলের ধারণা ভাল মন্দের কোনটাই কোনটার থেকে বেশি না। তৃতীয় দলেই সদস্য বেশি। আমার নিজের কাছে স্কুল আমল থেকেই হোস্টেলে থাকাটা ঠিক পছন্দ হয় না। একটা গন্ডির মধ্যে থাকতে হয়। তাছাড়া পরিবারের মত ভালবাসা বা আবহ কি অন্য কোথাও পাওয়া যায়? এটা ঠিক যে এভাবে থেকে ওরা আমাদের থেকে খারাপ কিছু হয়ে যায় না। তারপরও কেন যেন আমার ভাল লাগে না কলেজে ওঠার আগে হোস্টেলে থাকাটা। সেক্ষেত্রে আমার জন্য সুখের কথা হল আমাকে ক্লাস সেভেনে থাকতে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেয়ার আর কোন উপায় এখন নেই।
বাস্তব
একটা সময় ইউনিভার্সিটি পড়ুয়াদের জীবনের প্রতি অন্যধরণের মোহ ছিল। অর্থাৎ স্কুলকালে। কাছ থেকে কাউকে দেখা হয়ে ওঠেনি। তবে নাটক সিনেমা দেখে যতদূর বুঝতাম তা হল অনেক বড় হলে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে হয়। সেটা অনেক বিশাল জায়গা, স্কুলের মত ছোট্ট না। সেখানে মাঝেমাঝে ক্লাস করতে হয় তবে পড়াশোনা করা লাগে না বললেই চলে। যখন ইচ্ছা বাসায় ফেরা যায়। সুন্দর সুন্দর জামা পরে যাওয়া যায়। আর ইউনিভার্সিটির আপুরা অনেক কিছু বোঝে, গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করে। একা একা মার্কেটে যায়। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন হল স্বাধীন জীবন এবং আমিও একদিন নিঃসন্দেহে আপুদের মত ‘বড়’ হব। এখন ক্যাম্পাসে ঘুরলে দেখি সেই আপুদের বেশিরভাগই আমার চেয়ে ছোট ক্লাসে পড়ছে। কিন্তু তবু নিজেকে বড় হয়েছি বলে মনে হয়না। আমার সমবয়সী কেউ চাকরি করতে পারে এটা বিশ্বাস করা কঠিন লাগে। কারণ সারাজীবন জেনেছি চাকরি ‘বড়’রা করে। সত্যি বললে অনার্স মাস্টার্স এসব এখনো নিজের কানে ‘বড়’দের বিষয়ের মত শোনায়। একটা ব্যাপার অবশ্য ভাবনার সঙ্গে মিলে যায়। তা হল আসলেই এখানে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয়ে আলোচনা চলে। মোটামুটি থার্ড ইয়ার চলে এলেই ক্যারিয়ার নিয়ে সিরিয়াসলি মাঠে নেমে যায় বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী। স্কলারশিপের চেষ্টা চলে। সিভি জমা দেয়া হয়। পার্টটাইম কিছু করা যায় কিনা সেদিকে চোখকান খোলা রাখতে হয়। তাছাড়া মেয়েদের মধ্যে বিয়ের হাওয়া লাগতে শুরু করে। আড্ডা দিতে বসলে দেখা যায় পেশাগত আর সাংসারিক বিষয় আশয় অহরহ কথায় উঠে আসে। মনোমালিন্যও হয় প্রেম ভালবাসা, ভুল বোঝাবুঝি, ব্যাক্তিত্বের সংঘাত সংক্রান্ত ভারী ভারী কারণে। সবাই বড়দের মত কথা বলে, কাজ করে। আমি নিজেও এসবকিছুর বাইরের কেউ না। এককথায় বলতে গেলে এখন মনে হয় বড় হওয়ার মধ্যে এত আনন্দের তেমন কিছু নেই। বড় হতে থাকলেই মানুষের খুব উদাস উদাস হয়ে পেছনের দিনে ফেরত যেতে ইচ্ছা করে। ততটুকু পেছনে যখন আনন্দ বুঝতে পারার মত বয়স ঠিকই হয় কিন্তু সেই সাথে জীবনের কঠিন কঠিন ব্যাপারগুলো মাথায় ঢোকানোর মত প্রাপ্তবয়স্কতাও আসে না।
বাস্তবতা শব্দটার একটা নেগেটিভ চেহারা আছে। মধুর বাস্তবতা কথারটার চেয়ে কঠিন বাস্তবতা কথাটাই আমাদের বেশি পরিচিত। সেই বাস্তবতা এমনই কঠিন যে তা থেকে পালাতে ইচ্ছা করে। আর তাকে পাশ কাটিয়ে পালানোর মনোবৃত্তি আছে এমন মানুষের সংখ্যাও এতই বেশি যে তাদের জন্য escapist বলে একটা শব্দ চালু করতে হয়েছে। কিটস শেলি ঘরানার কবিরা আবার বাস্তবকে দূরে ঠেলে কিছুক্ষণ কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করার চেষ্টা করেন। কবিরা বিখ্যাত মানুষ বলে আলাদা গুরুত্ব। কিন্তু সব মানুষেরই কি বাস্তবকে নিয়ে কমবেশি অসন্তুষ্টি নেই? বাস্তব...বাস্তবতা...জীবনঘনিষ্ঠতা...জীবন। তাহলে জীবনটাই তো দেখা যাচ্ছে একটা খারাপ জিনিস। অথচ এত কষ্ট হলেও জীবনের গায়ে এতটুকু আঁচ লাগার ভয়ে আমরা সিঁটিয়ে থাকি। জীবনের ঘানি তো অনেক টানিয়াছ, এইবার কলুর ইচ্ছা তোমার ছুটি হউক... যমের মুখে এমন কথা শুনলে কেউ কি হাসিমুখে মেনে নিতে পারে? মানুষের মধ্যে একই সঙ্গে কতসব বিচিত্র বৈপরিত্য!
বাস্তবতা শব্দটার একটা নেগেটিভ চেহারা আছে। মধুর বাস্তবতা কথারটার চেয়ে কঠিন বাস্তবতা কথাটাই আমাদের বেশি পরিচিত। সেই বাস্তবতা এমনই কঠিন যে তা থেকে পালাতে ইচ্ছা করে। আর তাকে পাশ কাটিয়ে পালানোর মনোবৃত্তি আছে এমন মানুষের সংখ্যাও এতই বেশি যে তাদের জন্য escapist বলে একটা শব্দ চালু করতে হয়েছে। কিটস শেলি ঘরানার কবিরা আবার বাস্তবকে দূরে ঠেলে কিছুক্ষণ কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করার চেষ্টা করেন। কবিরা বিখ্যাত মানুষ বলে আলাদা গুরুত্ব। কিন্তু সব মানুষেরই কি বাস্তবকে নিয়ে কমবেশি অসন্তুষ্টি নেই? বাস্তব...বাস্তবতা...জীবনঘনিষ্ঠতা...জীবন। তাহলে জীবনটাই তো দেখা যাচ্ছে একটা খারাপ জিনিস। অথচ এত কষ্ট হলেও জীবনের গায়ে এতটুকু আঁচ লাগার ভয়ে আমরা সিঁটিয়ে থাকি। জীবনের ঘানি তো অনেক টানিয়াছ, এইবার কলুর ইচ্ছা তোমার ছুটি হউক... যমের মুখে এমন কথা শুনলে কেউ কি হাসিমুখে মেনে নিতে পারে? মানুষের মধ্যে একই সঙ্গে কতসব বিচিত্র বৈপরিত্য!
Sunday, October 28, 2007
শস্য
এবার মনে হচ্ছে ভাল শীত পড়বে। অবশ্য প্রতিবারই কিছু একটা দেখে আমি এই একই জিনিস আন্দাজ করে ফেলি। আর প্রতিবারই ভাবি আরে বুদ্ধি থাকলে এসব বুঝতে পারা কোন ব্যাপারই না। এখন হেমন্তকাল। নবান্নের ঋতু। নবান্নের কতটুকুই বা অবশিষ্ট আছে এখন! আজকাল তো ধান কাটার কাজ বছর জুড়েই চলতে থাকে। এ নিয়ে উৎসব করার সময় বা আগ্রহ থাকে না। এখন কেবল কার্তিক চলছে, তাতেই ভোরের দিকে একটু ঠান্ডা পড়ে। বৃষ্টি মৌসুম পেছনে ফেলে এসেছি বেশ কিছুদিনের জন্য। হেমন্তের বৃষ্টি ফসলের জন্য খারাপ সংকেত। এটা আমি জানি খনার বচন থেকে। “ যদি বৃষ্টি আগনে, রাজা যায় মাগনে “। আবার শীতের শেষে বৃষ্টি হওয়া ভাল লক্ষণ। “ যদি বৃষ্টি মাঘের শেষ, ধন্যি রাজার পূণ্যি দেশ “। খনার বচন বেশ ইন্টারেস্টিং। তার জন্ম সম্ভবত ময়মনসিংহে, সময়টা আমার জানা নেই। খনা সম্পর্কে আমি কেবল আর এতটুকুই শুনেছি যে তার জনপ্রিয়তায় তার শ্বশুরের ঈর্ষা হয়েছিল। তাই খনার জিভ কেটে ফেলে লোকটা। যেন এসব বচন টচন সে আর না দিতে পারে। এই কাহিনী সত্যি কিনা জানি না। তবে প্রকৃতির ব্যবস্থাটা কিন্তু দারুণ। শীতের শাকসবজি ভাল হবে যখন তার গায়ে কুয়াশা পড়বে। আবার বর্ষাকালের ফসলে বৃষ্টির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। গরমের ফলও নিশ্চয়ই ঠিকমত তাপ না পেলে ভাল হয়না। খনার আমলে এসব মেনে চলা প্রয়োজন ছিল। এই শতাব্দীতে খাবারদাবারের উৎস হাইব্রিড জাত। জৈষ্ঠ্য মাসে পাকা টমেটো মামুলি ব্যাপার। অন্যদিক দিয়ে দেখলে এখন গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর যুগ। বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হচ্ছে, ভূমিকম্প দোরগোড়ায় ইত্যাদি ইত্যাদি। এজন্যই হয়ত এখন বয়স্কদের মুখে ইলিশের স্বাদ কমে গেছে, আম লিচু পানসে লাগে, কোথায় সেই খালে বিলে মাছের দাপাদাপি...এসব আক্ষেপ শোনা যায়। তারপরও মানুষ পৃথিবীতে আছে, উৎপাদন চলবে, কৃষি চলবে। নারকেল কুল আপেল কুল এরকম নতুন সব প্রজাতি যুক্ত হবে ফসলের অভিধানে। শেষ করার আগে খনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তার আরেকটা বচন জুড়ে দিচ্ছি।
“ কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত “।
“ কলা রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত “।
আমার খেলনা আমার বই
ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধবিহার আমাদের বাসা থেকে দূরে না। দুই একদিন আগে প্রবর্তনা পূর্ণিমা হয়ে গেছে। দেখলাম মঠের সামনের জায়গাটায় ছোট ছোট কয়েকটা দোকানপাট বসে গেছে। মেলার মত। তখনি আমার অনেক বছর আগের মেলার কথা মনে পড়ে গেল। ঈদের দিন বা তার পরের দিন বিকালে আব্বুর সঙ্গে কমলাপুর মাঠের মেলায় যেতাম। এখন গ্রামবাংলার মেলার চিত্র হিসাবে আমরা যেমন ছবি ভেবে নিই সেরকম ছিল ওই মেলা। সন্ধ্যায় যখন বাসায় ফিরতাম হাতে একটা পলিথিন থাকত। পলিথিন ভর্তি আমার শখের জিনিসপত্র। সবচেয়ে প্রিয় ছিল মাটির পুতুল হাঁস-মুরগী এসব। সাথে ছোট্ট পিঁড়ি-বেলন বাঁশি বেলুন আর প্লাস্টিকের আরো এটা সেটা। তার মধ্যে কাঠের একটা পুতুল অনেকদিন ছিল আমার কাছে। এখন হারিয়ে গেছে। আর একটা কাঠের হাতি এখনো আছে। আশা করি এটা হারাবে না, খুব দুঃখের ব্যাপার হবে তাহলে। প্লাস্টিকের পশুর সেট ছিল আমার একটা। বাবা মায়ের তরফ থেকে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্টের উপহার। ছিল লেগো সেট। চুম্বক, নষ্ট রেডিওর নাড়িভুঁড়ি নাড়াচাড়া করতে গিয়ে মনে হত আমি বিরাট শিশুপ্রতিভা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছি। ব্যাটারিওয়ালা মেম পুতুলের কথা তো না বললেই না। আমি মেম পুতুল বলতাম না। এই নামটা তখনই অলরেডি বিলুপ্ত। পরে বই থেকে জেনেছি। পুতুলটা মামার দেয়া। নাম ছিল তুলতুল। গায়ে গোলাপি উলের পোশাক আর টুপি। শান্ত স্বভাব, কখনোই বিরক্ত করেনি। সত্যি কথা বলতে এতদিন পর আমি এদের কাউকেই মিস করি না। তবে জীবনের প্রথম গল্পের বইটা হারানোর দুঃখ কখনোই যাবে না। ঠাকুরমার ঝুলি। ক্লাস ওয়ানের কথা সেটা। ওই অসাধারণ গন্ধ আর কোন কিছুতে নেই। বাজারে বহু ঠাকুরমার ঝুলি আছে। কিন্তু ঠিক ওই বইটা পাইনি আমি পরে। এখানে একটা ব্যাপারে আমি আমার বাবা মা কে বিশেষ ধন্যবাদ দিই। তা হল, আমাকে স্কুলজীবনে গল্পের কিনে দেয়া হত যথেষ্ট। হাইস্কুলে ওঠার পর ওপরতলার আপুর বিশাল সংগ্রহ থেকে প্রায়ই যে একসঙ্গে অনেকগুলো ধার করতাম সেখানেও নিষেধ ছিল না। অমুক টাইপের বা তমুক লেখকের প্রবেশ নিষিদ্ধ এমনটাও না। আজকে লিখতে বসে হঠাৎ করে আমার কৃতজ্ঞতা নতুন করে জেগে উঠছে। আমি জানি না সবার বাবা কলিগের কাছ থেকে নিজের উদ্যোগে মেয়ের জন্য বইপত্র নিয়ে আসেন কিনা কিংবা চাকরিজীবী মায়েরা মেয়ের ফরমায়েশের উপন্যাসের খোঁজে অফিসের লাইব্রেরি ঘাঁটার কষ্ট করেন কিনা। আমার ভাগ্য ভাল। আরেকটা জিনিস আমি বিশ্বাস করি যে গল্পের বইয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ না থাকলে একটা মানুষ কিছুতেই ভালভাবে এবং শুদ্ধভাবে মাতৃভাষায় কোনকিছু লিখতে পারে না।
Thursday, October 25, 2007
শীতচিন্তা
আজকাল আমার জানালা গলে রোদ আসে। এর অর্থ শীত আসছে। জানালায় রোদ আসার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন আনন্দ আছে। আমি জানি এটার উৎস কি। উৎস হল স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, বিশাল অবসর আর গল্পের বই পড়া, সেই সাথে কিছুদিনের মধ্যে নতুন ক্লাসে ওঠা, নতুন নতুন বইখাতাতে নাম লেখা অর্থাৎ সবমিলিয়ে একটু বড় হওয়া। সেই সঙ্গে বাঁধাকপি ফুলকপি শিম আর টমেটোকে ভুলে গেলে চলবে না। কেবল গাজরটাকে একটু সহ্য করে নিলেই হল। এতদিন পর কোনকিছুই আর আগের মত নেই। শুধু শীত আসার খুশিটাই ঝুলে ঝুলে টিকে আছে কিছুটা। আমি অবশ্য শীতের পিঠা খাওয়া বা খেজুরের রসের খুব ভক্ত এমনটা বলা যাবে না। তবুও শীতের সঙ্গে এসব ঐতিহ্যের নাম না জুড়ে দিলে চলে না। এই জুড়ে দেয়াটাও একটা ঐতিহ্য। সাহিত্যের জগতে শীত তেমন একটা স্নেহের পাত্র বলা যায় না। শীতকে বরং বিবর্ণতা, শুষ্কতা বা নিষ্প্রাণতার প্রতীক হিসাবেই দেখা হয়। গাছগুলো হুড়মুড় করে পাতা ঝরানোর জন্য পাগল না হয়ে গেলে হয়ত এই ঋতুটার রূপক অর্থ আরেকটু অন্যরকমই হত। আমাদের দেশে তো তুষার পড়ে না। ব্যাপারটা কেমন আমি জানি না। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকব আর উপর থেকে কিনা কুচি কুচি বরফ পড়তে থাকবে। ভাবতে বেশ রোম্যান্টিক। কিছুক্ষণ দাপাদাপি করলাম, আইসবল ছুঁড়লাম, তারপর আমার লগহাউসে ঢুকে ফায়ারপ্লেসের আগুনটা উস্কে দিলাম। এই সময়ের মধ্যে নিশ্চয়ই কফিও রেডি হয়ে যাবে। কফি অর্ধেক হতে না হতেই দেখি বাইরে তুমুল তুষারঝড়। না আজকে আর আপেল পাড়া হল না। ভেবেছিলাম খানিকটা সাইডার বানিয়ে রাখব। (সাইডার মানে আপেলের জুস। এই পর্যায়ে কল্পনার গাড়ি মোড় নিয়ে লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের গল্পের দিকে চলে যেতে থাকল...)
কয়েক দিন পরই রোদটা কোমল হতে শুরু করবে। আলো ঠিকই থাকবে কিন্তু তেজ থাকবে না। শীতকালের রোদের একটা হালকা গন্ধ আছে। সেটা শুধুমাত্র পড়ন্ত দুপুরে পাওয়া যায়। তবে ঝামেলা হল এসময় সন্ধ্যাটা বড় তাড়াতাড়ি নেমে আসে। আসে তো আসেই। গড়িয়ে গড়িয়ে রাত পর্যন্ত যেতে তার যেন অনন্তকাল লেগে যায়। সূর্য মশায়ের ঘুম ভাঙতেও তেমনই দেরি। লম্বা লম্বা রাত, ছোট্ট ছোট্ট দিন। এর মাঝেই একদিন পড়বে উত্তর গোলার্ধের ক্ষুদ্রতম দিন ২৩শে ডিসেম্বর। দক্ষিণ গোলার্ধে তখন যথারীতি ক্ষুদ্রতম রাত। যত মেরুর দিকে যাব, দিনরাতের বৈষম্য বাড়তে থাকবে। মেরুর আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। পুরো পৃথিবীটাই নাকি একটা চুম্বকের মত। আমাদের চুম্বক উত্তর দিক দেখানোর জন্য যেদিকে মুখ বাড়িয়ে রাখে সেটা নাকি ভৌগলিক দক্ষিণ আর চুম্বকের দক্ষিণ নাকি বিশ্বচুম্বকের উত্তর। সবই অনেক আগের পড়া, ঠিকঠাক বললাম কিনা কে জানে। পড়াশোনার ব্যাপার কি মনে থাকে নাকি? না মনে থাকার কথা? এতদিন ধরে পড়েও আমি ঠিক জানিনা শেলির বা ব্রাউনিং এর বা কোলেরিজের লেখার স্টাইল কিরকম হয় যেটা কিনা পরীক্ষার ভারী ভারী লেখার জন্য দরকারি। অথচ ড্যান ব্রাউনেরটা ঠিকই বলতে পারব। আর টিভিতে নতুন বিজ্ঞাপন আসলে সেটার জিঙ্গেল হাবিবের কম্পোজিশন কিনা তা বোঝা তো এক মুহূর্তের ব্যাপার।
কয়েক দিন পরই রোদটা কোমল হতে শুরু করবে। আলো ঠিকই থাকবে কিন্তু তেজ থাকবে না। শীতকালের রোদের একটা হালকা গন্ধ আছে। সেটা শুধুমাত্র পড়ন্ত দুপুরে পাওয়া যায়। তবে ঝামেলা হল এসময় সন্ধ্যাটা বড় তাড়াতাড়ি নেমে আসে। আসে তো আসেই। গড়িয়ে গড়িয়ে রাত পর্যন্ত যেতে তার যেন অনন্তকাল লেগে যায়। সূর্য মশায়ের ঘুম ভাঙতেও তেমনই দেরি। লম্বা লম্বা রাত, ছোট্ট ছোট্ট দিন। এর মাঝেই একদিন পড়বে উত্তর গোলার্ধের ক্ষুদ্রতম দিন ২৩শে ডিসেম্বর। দক্ষিণ গোলার্ধে তখন যথারীতি ক্ষুদ্রতম রাত। যত মেরুর দিকে যাব, দিনরাতের বৈষম্য বাড়তে থাকবে। মেরুর আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। পুরো পৃথিবীটাই নাকি একটা চুম্বকের মত। আমাদের চুম্বক উত্তর দিক দেখানোর জন্য যেদিকে মুখ বাড়িয়ে রাখে সেটা নাকি ভৌগলিক দক্ষিণ আর চুম্বকের দক্ষিণ নাকি বিশ্বচুম্বকের উত্তর। সবই অনেক আগের পড়া, ঠিকঠাক বললাম কিনা কে জানে। পড়াশোনার ব্যাপার কি মনে থাকে নাকি? না মনে থাকার কথা? এতদিন ধরে পড়েও আমি ঠিক জানিনা শেলির বা ব্রাউনিং এর বা কোলেরিজের লেখার স্টাইল কিরকম হয় যেটা কিনা পরীক্ষার ভারী ভারী লেখার জন্য দরকারি। অথচ ড্যান ব্রাউনেরটা ঠিকই বলতে পারব। আর টিভিতে নতুন বিজ্ঞাপন আসলে সেটার জিঙ্গেল হাবিবের কম্পোজিশন কিনা তা বোঝা তো এক মুহূর্তের ব্যাপার।
Wednesday, October 24, 2007
পুরাণ
গ্রীক পুরাণের গল্পগুলো বেশ ভাল লাগে। ইলেক্ট্রা, ইডিপাস রেক্স, ইলিয়ড, ওডিসির মত আরো অনেক অনেক বিখ্যাত রচনার বিষয় এসেছে এসব কাহিনী থেকে। তবে সবচেয়ে পরিচিত সম্ভবত ট্রয় নগরীর গল্প। একজন নারীর জন্য প্রলয়ংকারী যুদ্ধ বলা হলেও মূল গল্পটা পড়ে দেখলেই জানা যায় এখানে হেলেনকে যুদ্ধের একমাত্র কারণ বলা ভুল। পাখনাওয়ালা কিউপিডের জন্য সাইকির ভালবাসা, আকিলিসের সর্বনাশা গোড়ালি, প্রমিথিউসের আগুন চুরি, সাগরের অধিশ্বর পসেইডন ইত্যাদি অগুণতি কাহিনী। নার্সিসাস নামের এক সুন্দর তরুণ পানিতে তার অসাধারণ রূপের ছায়া দেখে নিজেরই প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। তাই নিজের প্রতি বাড়াবাড়ি রকম মুগ্ধতার ইংরেজি নাম ‘নার্সিজম’। ক্লাসের পড়ার ভেতর এসব মাঝে মাঝে চলে আসে। নতুবা স্বাভাবিক স্মৃতিশক্তির মানুষের দুই তিনটার বেশি ঘটনা মনে রাখার কথা না। পুরাণের দেব দেবীদের প্রায় সবার সঙ্গেই সবার কোন না কোন সম্পর্ক আছে, এতে প্যাঁচ বাড়ে বৈ কমে না। আর তাদের মধ্যে সবসময় লেগে আছে ঝগড়া বিবাদ হিংসা বিদ্বেষ। অনেক সময় মর্ত্যের মানুষও এসব রেষারেষির কারণ। তারা একটু সন্তুষ্ট হলেই পুরষ্কারের ব্যবস্থা আবার একটু অসন্তুষ্ট হলেই তীব্র রোষানলে পড়তে হত মানুষকে এমনকি দেবালোকবাসীদেরকেও। অনেকটা ছোটদের রূপকথার মত এসব গল্প। পার্থক্য হচ্ছে রূপকথার মত এসব ততটা সরল না। অনেক ঘটনা একে অপরের সাথে জড়িত। তবে বেশিরভাগ গল্পতেই যেন সামনে কি হতে যাচ্ছে বুঝতে পারা যায়। তারপরও ভাল লাগে। গ্রীক পুরাণের সংগ্রহ হিসাবে এডিথ হ্যামিল্টনের ‘মিথলজি’ একটা বিখ্যাত বই। একটা গল্প বলতে ইচ্ছা হচ্ছে।
তরুণ ভাস্কর প্যাগম্যালিয়ন এর ছিল অসাধারণ প্রতিভা। কিন্তু সে মেয়েদের ঘৃণা করে। তার ধারণা ছিল এমন যে প্রকৃতি নারীদের তৈরি করেছে সীমাহীন দোষের আধার করে। তার সংকল্প সে কখনোই বিয়ে করবে না। নিজের শিল্প নিয়েই জীবন কাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছা তার। একদিন সে একটা মূর্তি তৈরি করল, খুব সুন্দর এক মেয়ের। কারণ হতে পারে, জীবন থেকে যত সহজে সরিয়ে রাখতে পেরেছে মন থেকে তত সহজে নারীচিন্তাকে সে দূরে রাখতে পারেনি। অথবা হয়ত একটা নিখুঁত নিষ্প্রাণ নারী তৈরি করে সে পুরুষদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিল সত্যিকার নারীদের খুঁতগুলো। অসামান্য একটা ভাস্কর্য জন্ম নিল তার হাতের ছোঁয়ায়। আর এটাই প্যাগম্যালিয়নের জন্য কাল হয়ে উঠল।
দিনরাত খাটতে লাগল সে মূর্তিটার পেছনে। ধীরে ধীরে তা হতে লাগল আরো বেশি মনোহর, আরো বেশি চোখজুড়ানো। দেখে বোঝাই যায়না এ কোন মানবী না বরং সাধারণ একটা মূর্তি। প্যাগমিলিয়ন তার সৃষ্টির গভীর প্রেমে পড়ে গেল। বাস্তবের প্রেমিকার মতই আচরণ পেতে লাগল সেই পাথরের টুকরা। যতই সুন্দর পোশাক গায়ে চড়াক, যেভাবেই ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিক, যেমনই যত্ন নিক, এক বিন্দু আবেগের জন্ম দিতে পারলো না সে মূর্তিটার মাঝে। প্রবল দুঃখে উন্মাদপ্রায় প্যাগম্যালিয়ন। কারণ সারাজীবন এই নিষ্প্রাণকেই ভালবাসতে হবে তার। এমন অদ্ভুত প্রেমিক মনোযোগ কাড়ল প্রেমের দেবী ভেনাসের। তার ইচ্ছা হল এই ভগ্নহৃদয় তরুণের জন্য কিছু করার। ভেনাসের ভোজের দিন, সারা সাইপ্রাস দ্বীপে উৎসব। বেদীতে বেদীতে ধূপের সুবাস। রাজ্যের সমাগত প্রেমিকদের মধ্যে ছিল প্যাগম্যালিয়নও। তার প্রার্থনা, সে যেন তার মূর্তিটির মত মোহনীয় কোন পার্থিব রমণীকে খুঁজে পায়। কিন্তু ভেনাস ঠিকই বুঝতে পারলেন ভাস্কর আসলে ঠিক কি চায়।
বাড়ি ফিরে প্যাগম্যালিয়ন দাঁড়াল তার ভালবাসার প্রস্তরকীর্তির সামনে। হাত বুলিয়ে দিল তার গায়ে। চমকে গেল সে। তার কি মনের ভুল নাকি সত্যিই সে উষ্ণতা টের পেল? মূর্তির ঠোঁট, নাক, মুখ, বাহু সারা শরীর আস্তে আস্তে পালটে যেতে লাগল। কব্জির নীচে ধমনীর স্পন্দন জন্ম নিল। কাঠিন্য সরে গিয়ে জেগে উঠতে লাগল প্রাণ। বিস্মিত তরুণের গভীর আলিঙ্গনের স্পর্শে প্রাণহীন মূর্তি মানবীতে পরিণত হল। তার চোখের দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসি দিল তার আরাধ্য। প্যাগম্যালিয়নের এই আত্মার আত্মীয়ের নাম রাখা হল গ্যালাটি। ভেনাস নিজে উপস্থিত থেকে তাদের বিয়েতে আশীর্বাদ দিলেন।
তরুণ ভাস্কর প্যাগম্যালিয়ন এর ছিল অসাধারণ প্রতিভা। কিন্তু সে মেয়েদের ঘৃণা করে। তার ধারণা ছিল এমন যে প্রকৃতি নারীদের তৈরি করেছে সীমাহীন দোষের আধার করে। তার সংকল্প সে কখনোই বিয়ে করবে না। নিজের শিল্প নিয়েই জীবন কাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছা তার। একদিন সে একটা মূর্তি তৈরি করল, খুব সুন্দর এক মেয়ের। কারণ হতে পারে, জীবন থেকে যত সহজে সরিয়ে রাখতে পেরেছে মন থেকে তত সহজে নারীচিন্তাকে সে দূরে রাখতে পারেনি। অথবা হয়ত একটা নিখুঁত নিষ্প্রাণ নারী তৈরি করে সে পুরুষদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিল সত্যিকার নারীদের খুঁতগুলো। অসামান্য একটা ভাস্কর্য জন্ম নিল তার হাতের ছোঁয়ায়। আর এটাই প্যাগম্যালিয়নের জন্য কাল হয়ে উঠল।
দিনরাত খাটতে লাগল সে মূর্তিটার পেছনে। ধীরে ধীরে তা হতে লাগল আরো বেশি মনোহর, আরো বেশি চোখজুড়ানো। দেখে বোঝাই যায়না এ কোন মানবী না বরং সাধারণ একটা মূর্তি। প্যাগমিলিয়ন তার সৃষ্টির গভীর প্রেমে পড়ে গেল। বাস্তবের প্রেমিকার মতই আচরণ পেতে লাগল সেই পাথরের টুকরা। যতই সুন্দর পোশাক গায়ে চড়াক, যেভাবেই ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিক, যেমনই যত্ন নিক, এক বিন্দু আবেগের জন্ম দিতে পারলো না সে মূর্তিটার মাঝে। প্রবল দুঃখে উন্মাদপ্রায় প্যাগম্যালিয়ন। কারণ সারাজীবন এই নিষ্প্রাণকেই ভালবাসতে হবে তার। এমন অদ্ভুত প্রেমিক মনোযোগ কাড়ল প্রেমের দেবী ভেনাসের। তার ইচ্ছা হল এই ভগ্নহৃদয় তরুণের জন্য কিছু করার। ভেনাসের ভোজের দিন, সারা সাইপ্রাস দ্বীপে উৎসব। বেদীতে বেদীতে ধূপের সুবাস। রাজ্যের সমাগত প্রেমিকদের মধ্যে ছিল প্যাগম্যালিয়নও। তার প্রার্থনা, সে যেন তার মূর্তিটির মত মোহনীয় কোন পার্থিব রমণীকে খুঁজে পায়। কিন্তু ভেনাস ঠিকই বুঝতে পারলেন ভাস্কর আসলে ঠিক কি চায়।
বাড়ি ফিরে প্যাগম্যালিয়ন দাঁড়াল তার ভালবাসার প্রস্তরকীর্তির সামনে। হাত বুলিয়ে দিল তার গায়ে। চমকে গেল সে। তার কি মনের ভুল নাকি সত্যিই সে উষ্ণতা টের পেল? মূর্তির ঠোঁট, নাক, মুখ, বাহু সারা শরীর আস্তে আস্তে পালটে যেতে লাগল। কব্জির নীচে ধমনীর স্পন্দন জন্ম নিল। কাঠিন্য সরে গিয়ে জেগে উঠতে লাগল প্রাণ। বিস্মিত তরুণের গভীর আলিঙ্গনের স্পর্শে প্রাণহীন মূর্তি মানবীতে পরিণত হল। তার চোখের দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসি দিল তার আরাধ্য। প্যাগম্যালিয়নের এই আত্মার আত্মীয়ের নাম রাখা হল গ্যালাটি। ভেনাস নিজে উপস্থিত থেকে তাদের বিয়েতে আশীর্বাদ দিলেন।
Tuesday, October 23, 2007
ছোট্ট জীবন
মাঝে মাঝে একটা কথা ভাবলে খুবই দুঃখ লাগে। সেটা হল আমি কত কত কিছু জানিনা। পৃথিবীতে জ্ঞানের কোন সীমা নেই আর আমি কিনা এখনো কিছুই জানলাম না। ইতিহাস বলি, বিজ্ঞান বলি, শিল্প বলি বা দর্শন বলি কত কি আছে জানার আর শেখার অথচ আমরা বাঁচি অল্প কয়টা বছর। তার মধ্যে বইপুস্তক ধরে দেখার সুবিধাটাই বা পায় কয়জন আর ধরে দেখে তাকে ধারণ করার চেষ্টাই বা করে কয়জন। গ্রন্থগত বিদ্যার কথা বাদই দিলাম, জীবনকে চোখ মেলে দেখার মত সময়টা সুযোগটাও হয় কয়টা মানুষের। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে গিয়ে অন্যের যাপিত জীবন বা নিজের অযাপিত জীবন নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা মাথাতেও কি আসে? হঠাৎ জন্ম হঠাৎ মৃত্যু, তার মাঝে কিছুদিন কেবল একটু শ্বাস-প্রশ্বাস। পৃথিবীতে এসে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতেই আবার বিদায় নিতে হয়। মানুষ আরো অনেক বছর বাঁচতো যদি! আসলে কি আদৌ কোন লাভ হত? পৌরাণিক চরিত্র টিথোনাস অমরত্ব চেয়ে নিয়েছিল। কিন্তু অসীম যৌবন চাওয়ার কথা তার মনে আসেনি। তার ফল হল এই যে সে বেঁচে থাকছে তো থাকছেই, মৃত্যু আর আসে না, কিন্তু সে বেঁচে আছে একটা জরাগ্রস্ত লৌলচর্ম বৃদ্ধ হয়ে। আসলে আয়ুর দোষ দিয়েও বা কি হবে। জ্ঞান পুরোপুরি আয়ুর সাথে সম্পর্কিত না। সারাটা জীবন আমরা একটা ছককাটা ঘরের মধ্যেই কাটিয়ে দিই। এই ঘর থেকে ওই ঘর আবার ওই ঘর থেকে এই ঘর। উপনিষদে মানবজীবনকে চারটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। শেষভাগটা হল সন্ন্যাস। সাংসারিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে অরণ্যাচারী হয়ে দিন কাটানোর মত বলা যায়। কিন্তু মানুষ তো সমাজজীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। আশা ভালবাসার সঙ্গীর মত উপহারও সমাজ থেকে আসে, আবার সারাটা রাত গাছের নীচে জোনাকীর নাচ দেখার ইচ্ছাটাকেও ধামাচাপা দেয় সমাজ। লোকচক্ষুর বোঝা থেকেও মুক্তি নেই, জনজীবন থেকে সরে গিয়ে বাঁচতেও বাধা।
Sunday, October 21, 2007
আমার ডায়রি লেখা
আমি জানতাম “পিকুর ডায়েরী” সত্যজিৎ রায়ের কোন উপন্যাস। আজকে দেখলাম এটা একটা ছোটগল্প। বইটা ছোটগল্পের, তাই উপন্যাসের কোন অংশকে সংক্ষিপ্ত করে তুলে দেয়াও হতে পারে। পিকু সাত আট বছরের বাচ্চা একটা ছেলে। ডায়রি লেখে খুব আগ্রহ করে। অজস্র বানান আর যতির ভুল, তবু মূল বিষয়টা ধরতে পারা যায়। আমার মনে হয় এটা খুব কঠিন, বড়দের পক্ষে ছোটদের সাইকোলজি বোঝা। ছোটদের মনের গলি-ঘুপচি চিনে চিনে ঘুরতে পারাটা চাট্টিখানি কথা না। মানুষের বয়স বাড়লে তারা শৈশব মনে রাখে ঠিকই কিন্তু সূক্ষ্ম বিষয়গুলো হারিয়ে যায়। হঠাৎ করে বই পড়তে পড়তে কখনো মনে পড়ে যায়, আরে তাই তো, আমিও তো এমন সময়ে এমন কোন ঘটনার পর এমন করেই ভাবতাম। বই পুস্তকে অনেকবার পড়েছিলাম যে ডায়রি লেখা একটা খুব ভাল অভ্যাস। রোজনামচা লিখে রাখলাম, তারপর সেটা থেকে অনেক সময়ে আমরা দেখে অনেক কিছু শিখব। এসব জেনেছিলাম। তাই কয়েকবার খুব আঁটঘাট বেঁধে মোটাসোটা ডায়রি যোগাড় করে লেখা শুরু করেছিলাম। প্রায় প্রতিবারই কাজটা মাঝপথে থেমে গেছে। সারাদিনের ঘটনাপঞ্জী লিখতে হলে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আর রাতেরবেলা পায় ঘুম। কিসের ডায়রি লেখালেখি। পরে কলেজ পাশ করার পর স্কুলজীবনের অর্ধসমাপ্ত একেকটা ডায়রির পাতা উল্টে দেখতে খারাপ লাগত না। অতি তুচ্ছ সব ঘটনা। জামার রঙ নকশা বা স্কুলের ঘন্টার শব্দ কেমন অথবা নারকেল গাছের অপমৃত্যু সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য। লিখতে লিখতে ভাবতাম, বড় হলে হয়ত এই ডায়রি ঘেঁটে দেখতে গেলে শিক্ষণীয় বিষয়গুলি চোখেই পড়বে না বরং হাসাহাসি করব। বড়রা দরকারি ব্যাপার নিয়ে হাসাহাসি করতে পছন্দ করে। সত্যি সত্যি যখন পড়তে গেলাম, হাসি পায়নি। তবে তুচ্ছ মনে হয়েছে বেশিরভাগ লেখার সাবজেক্টই। সবচেয়ে মজার যেটা লক্ষ্য করেছি তা হ্ল, সব লেখাতেই একটা এমন ছাপ আছে যে আমার বয়স কম হলেও আমি অনেক কিছুই বুঝি, অনেক কিছুই জানি যেটা মানুষ আমাকে দেখে ধারণাই করতে পারবে না। ডায়রিগুলো আমি রাখিনি। মনে হয়েছে আমি ঠিক কোন মুহূর্তে কি ভেবেছিলাম তার খুঁটিনাটি বর্ণনা আমার প্রয়োজন নেই। কখনো যদি কেউ দেখে ফেলে? আমার নিজের ব্যাপার শুধু আমার নিজের জন্য। সেসবকে যেই পরিস্থিতিতে যেভাবে বিবেচনা করব সেটাই যথেষ্ট। তাছাড়া প্রত্যেকেরই কিছু কিছু ভাবনা থাকে যার কোন লিখিত ডকুমেন্ট থাকা উচিত না। কেবল হৃদয় আর মস্তিষ্ক মিলে যতটুকু ধরে রাখবে ততটুকুই থাকবে।
Friday, October 19, 2007
বই
কিছুদিন আগে স্কুলজীবনে কেনা একটা বই অনেকদিন পর আবার পড়লাম। প্রজাপতি প্রকাশনের ‘রবিনহুড’। বিষয়বস্তু সেই মধ্যযুগের কিংবদন্তী রবিনহুড। বইয়ের শুরুতেই বলে নেয়া আছে, আদপেই যে এই নামের ঠিক এই চরিত্রের কোন লোক কখনো ছিল সে ব্যাপারটা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। সেটা নিয়ে আমি কখনোই মাথা ঘামাইনি। নটিংহ্যাম শহর, শেরউড জঙ্গল, ব্লু বোর সরাইখানা, তীর ছোঁড়া প্রতিযোগিতা সব মিলিয়ে রবিনহুডের দস্যুজীবনটা রঙ চড়ানো গল্পে খুব আকর্ষণীয় লাগার কথা। আমার লেগেছে। এখন এরকম কোন মানুষ থাকলে খারাপ হত না। পুকুরচোরদের শিক্ষা হত। সেই সময় রবিনহুড আমার খুব প্রিয় একটা চরিত্র ছিল। চরিত্র না বলে বলা উচিত ব্যাক্তিত্ব। আফসোস হত কেন কয়েকশ বছর আগে নটিংহ্যামে জন্ম নিলাম না। তাহলে আমি অবশ্যই শেরউডে থাকতাম। তখন জেনেছিলাম একটা ছবিও আছে কেভিন কস্টনারের, Robinhood, the prince of thieves. ছবির নামে আমার আপত্তি, রবিনহুড কখনোই ‘চোর’ ছিল না। এতদিন পর বইটা পড়ে ভাল লাগলেও শেরউডে চরে বেড়াতে মোটেও ইচ্ছা হয়নি। আগের মত মুগ্ধও হইনি। যখন খুব ভাল লাগা পুরানো কোন বই আবার পড়ি, আমি একটু বিচার করারও চেষ্টা করি আমার দৃষ্টিভঙ্গী, মানসিকতা কতখানি বদলেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুভূতি প্রথমবারের চেয়ে অনেকটা অন্যরকম হয়। একই ঘটনাকেই মস্তিষ্ক ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে। বনফুলের ছোটগল্প ‘পাঠকের মৃত্যু’র মত, যেখানে একটা খুব ভাল লাগা গল্পের বই কয়েক বছরের ব্যবধানে একজন পাঠকের কাছে নিতান্ত পানসে হয়ে যায়। ভাগ্যিস মানুষ বইয়ের মত স্থির না। সময়ের সঙ্গে মানুষ যদি না বদলাতো তাহলে কিছুতেই একজন মানুষকে বেশিদিন ভাল লাগতো না।
Tuesday, October 16, 2007
পার্থক্য
আজকে টিভিতে একটা জিনিস দেখে খুবই মেজাজ খারাপ হল। প্রায়ই দেখা যায় কোন ছেলে যখন আরেকজন ছেলেকে চ্যালেঞ্জ করতে যায় বা তার ‘পৌরুষ’ নিয়ে টিটকারি দিতে চেষ্টা করে, তখন বলা হয়, সে যদি অমুক কাজটা না পারে বা তমুক করতে ভয় পায় তাহলে যেন সে চুড়ি পরে বসে থাকে। ছেলেদের কাছে এটা আঁতে ঘা লাগার মত একটা কথা, চুড়ি পরতে বলা। অর্থাৎ প্রকারান্তরে তাকে মেয়ে বলা। আমি ভাবছি। চুড়ি পরা কি ভীতুর লক্ষণ? মেয়েরা বুঝি খুব ভীতু। কি সর্বনাশের কথা! রিনিক ঝিনিক চুড়ির ঝংকার নিয়ে কত গান কত কাব্য লেখা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ছেলেরাও তো খুব ফ্যাশনেবল ভাব নিয়ে চুড়ি পরে। নাকি ওইটার ব্রেসলেট বা অন্য নাম বলতে হয়? না না আসলে ‘পুরুষ’ কে ‘নারী’ বলা মানে তাকে চরম অপমান করা। যেমন আমরা জানি মানুষ হল সৃষ্টির সেরা; এখন আমাকে কেউ গরু গাধা খ্যাঁকশিয়াল এসব কিছু বললে আমি কি হাসিমুখে মেনে নেব? কিন্তু কথা হচ্ছে মেয়েরা নিম্ন শ্রেণী হল কেন? ভীতুই বা কিভাবে হল? ধরলাম, নির্জন পথঘাট পেলে মেয়েরা দল বেঁধে বিপরীত লিঙ্গকে আক্রমণ করে না, মেয়েরা কথায় কথায় জোর খাটায় না, মেয়েরা পরিবারের সুখের জন্য প্রয়োজনে নিজের সাধ আহ্লাদ ভুলে গিয়েও খুশি থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু এসব এমন খারাপ ব্যাপার কিসের? কত ছেলেও তো এরকম হয়। মানে মানুষ হলে এমন স্বভাব থাকার কথা। আমরা উপলব্ধি করিনা আমাদের একেকজনের জন্মের পেছনে, আমাদের বড় হয়ে ওঠার পরোক্ষে একজন ব্যক্তির দীর্ঘকালের পরিশ্রমের কথা। যেসব মানুষগুলো দিনের পর দিন কষ্ট চেপে আরেকটা প্রাণকে নিজের মধ্যে ধারণ করার, তার জীবনের সাফল্যের জন্য নিজেদের সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকার তীব্র সাহস আর ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে, তাদেরকে ভীতু, নীচু বা হেয় ভাবার প্রবণতা কি অক্ষমদের হীনমন্যতা থেকেই সৃষ্টি নয়?
ঈদ
এবারের ঈদটা চলে গেল দেখতে দেখতে। ঈদের দিন রাস্তায় বের হওয়া রঙিন রঙিন মানুষ দেখতে বেশ লাগে। সামর্থ্যবান সবার গায়ে নতুন পোশাক। ছোটদের হাতে আবার বেলুন। সকালের দিকে মেঘ মেঘ ছিল। কয়েকটা ফোঁটাও পড়েছিল। পরে আর থাকেনি সেটা। অনেকদিন ঈদের দিন বৃষ্টি হয়না। নাকি আমার মনে পড়ছেনা? সে যাই হোক, রোজার চলে যাওয়ায় এখন একটু খারাপও লাগছে। আবার সেই হিসাব করা প্রতিদিনকার জীবন শুরু হচ্ছে। ঘুম থেকে ওঠ, ভার্সিটি যাও, বাসায় ফেরো, বইপত্রে হাত লাগানোর চেষ্টা কর, খাও, ঘুমাও এই তো। কিছুদিন পরপর দারুণ দারুণ সব ঘটনা ঘটলে মন্দ হয়না।
Friday, October 12, 2007
অলস সময়, অলস ভাবনা
ঘুম নিয়ে আমার একটা বক্তব্য আছে। সেটা হল, the less you sleep, the more you get to enjoy. ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমরা কত সময়ই না নষ্ট করি। অল্প কয়েক বছরের ছোটখাট জীবন, তার তিন ভাগের এক ভাগ নাকি মানুষ ঘুমিয়ে কাটায়। এই পরিসংখ্যানটা অবশ্য আমার না, পেপারে পড়েছিলাম। কি অপচয়! সুতরাং সুস্থ থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ঘুমালেই হল। মজার ব্যাপার হল ঘুম খুবই আকর্ষণীয় বস্তু। মাতাল ঘুমের মাঝখান থেকে ডেকে তুলে স্বর্গেও নেয়া যাবেনা। সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি হল তন্দ্রা, তীব্র ঘুম চেপে বসার আগের সময়টা। আর সেই সাথে যদি একটা রোমাঞ্চকর স্বপ্ন দেখে ফেলা যায় তাহলে তো ষোলআনা। অপচয়ের মাত্রা খানিকটা কমে আসবে।
ইউনিভার্সিটি প্রায় দুই মাস ধরে বন্ধ। এসময় যেই জিনিসটা সবচেয়ে ভাল শিখেছি তা হল ঘুম কত প্রকার ও কি কি। যেহেতু রুটিনমাফিক ক্লাসে যাওয়া আসা নেই তাই দিনের কাজকর্মে একটা জড়তা এসে গেছে। ছক এলোমেলো হয়ে গেছে। তার মধ্যে আবার রোজার দিন। দেরীতে ঘুমাই দেরীতে উঠি। আজকে দুপুরে এক বন্ধুর সঙ্গে বসে একটা ছবি দেখলাম। বেশ পুরানো। ব্যাক টু দ্য ফিউচার, ফার্স্ট পার্ট। হলিউদের ছবিজগতে বেশ পরিচিত নাম। মনে আছে এই ছবিটা আমি প্রথম দেখি ক্লাস সিক্সের শেষ দিকে, বা সেভেনের প্রথম হবে। বিটিভিতে মুভি অব দ্য উইক নামে একটা স্লট ছিল, এখন আছে কিনা আমি জানিনা। সেখানেই পরপর তিন সপ্তাহে তিনটা পার্ট দেখেছিলাম। এবার দেখে যতখানি বুঝেছি তখন এত বুঝিনি। তবুও খুব ভাল লেগেছিল। তারপর ক্লাসে গিয়ে আলোচনা। কি মজার একটা ছবি, নায়কটা কি কিউট। যত দূর মনে পড়ে একটা এরকম ভাবও এসেছিল, হ্যাঁ আমি ইংলিশ মুভি দেখি তো, বুঝি তো, না বোঝার কি আছে। হ্যাঁ যারা অভিনয় করে তাদেরকেও চিনি, যেমন, মাইকেল জে ফক্স। তার বেশ কিছু বছর পর জেনেছিলাম, মাইকেল জে ফক্সের কি যেন একটা কঠিন অসুখ হয়েছে, বেশিদিন বাঁচবে না। মন খারাপ লেগেছিল। আহা বাচ্চা বাচ্চা টাইপের লোকটা, মারাই যাবে এত তাড়াতাড়ি? পরে সম্ভবত তার অসুখটা সেরে গেছে। এখন কি সে অভিনয় করে? নাম তো শুনিনি অনেকদিন। ইন্টারনেট ঘেঁটে খুঁজে দেখা যেতে পারে।
আমাদের ছোটবেলায় একটাই টিভি চ্যানেল ছিল। অবশ্য সেই ছোটবেলা মিলিয়ে যাবার আগেই দেশে স্যাটেলাইট চলে আসে। অবাক লাগত। একসঙ্গে কয়েকটা চ্যানেল? মানে কয়েকরকম অনুষ্ঠান চলবে, দেখা যাবে যেটা খুশি? অনেকদিন পর্যন্ত এটা উচ্চবিত্ত পরিবারেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমাদের জন্য ছিল বিটিভি। সেখানে অয়োময় (এই শব্দটার মানে এখনো জানা হয়ে ওঠেনি), কোথাও কেউ নেই, রূপনগর এমন আরও অনেক নাটক মনোযোগ দিয়ে দেখতাম আমরা, মানে সেই সময়কার বাচ্চারা। আমাদের বাসায় কম্পিউটার, টেলিফোন এসব তখন ছিল না। ডাকবিভাগের হলুদ রঙের সিল মারা খামে চিঠি আসত চাচাদের...ভাইয়া, পত্রে শতকোটি সালাম নিবেন, ভাবীকেও তদ্রূপ জানাবেন...তারপর দেশের বাড়ির নানা খবর। এখনও কি স্কুলের বইয়ে প্রিয় শখ লেখা হয় ডাকটিকেট সংগ্রহ? এখন নিশ্চয়ই ছোটরা শখ বদলে ফেলেছে। ফেলে দেয়া প্রিপেইড কার্ড বা পোকেমনের স্টিকার বরং যোগাড় করা সহজ। কিংবা সিরিয়াস ধরণের শিশুরা হয়ত ন্যাশনাল জিওগ্রাফি দেখে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করে। যস্মিন যুগে যদাচার।
ইউনিভার্সিটি প্রায় দুই মাস ধরে বন্ধ। এসময় যেই জিনিসটা সবচেয়ে ভাল শিখেছি তা হল ঘুম কত প্রকার ও কি কি। যেহেতু রুটিনমাফিক ক্লাসে যাওয়া আসা নেই তাই দিনের কাজকর্মে একটা জড়তা এসে গেছে। ছক এলোমেলো হয়ে গেছে। তার মধ্যে আবার রোজার দিন। দেরীতে ঘুমাই দেরীতে উঠি। আজকে দুপুরে এক বন্ধুর সঙ্গে বসে একটা ছবি দেখলাম। বেশ পুরানো। ব্যাক টু দ্য ফিউচার, ফার্স্ট পার্ট। হলিউদের ছবিজগতে বেশ পরিচিত নাম। মনে আছে এই ছবিটা আমি প্রথম দেখি ক্লাস সিক্সের শেষ দিকে, বা সেভেনের প্রথম হবে। বিটিভিতে মুভি অব দ্য উইক নামে একটা স্লট ছিল, এখন আছে কিনা আমি জানিনা। সেখানেই পরপর তিন সপ্তাহে তিনটা পার্ট দেখেছিলাম। এবার দেখে যতখানি বুঝেছি তখন এত বুঝিনি। তবুও খুব ভাল লেগেছিল। তারপর ক্লাসে গিয়ে আলোচনা। কি মজার একটা ছবি, নায়কটা কি কিউট। যত দূর মনে পড়ে একটা এরকম ভাবও এসেছিল, হ্যাঁ আমি ইংলিশ মুভি দেখি তো, বুঝি তো, না বোঝার কি আছে। হ্যাঁ যারা অভিনয় করে তাদেরকেও চিনি, যেমন, মাইকেল জে ফক্স। তার বেশ কিছু বছর পর জেনেছিলাম, মাইকেল জে ফক্সের কি যেন একটা কঠিন অসুখ হয়েছে, বেশিদিন বাঁচবে না। মন খারাপ লেগেছিল। আহা বাচ্চা বাচ্চা টাইপের লোকটা, মারাই যাবে এত তাড়াতাড়ি? পরে সম্ভবত তার অসুখটা সেরে গেছে। এখন কি সে অভিনয় করে? নাম তো শুনিনি অনেকদিন। ইন্টারনেট ঘেঁটে খুঁজে দেখা যেতে পারে।
আমাদের ছোটবেলায় একটাই টিভি চ্যানেল ছিল। অবশ্য সেই ছোটবেলা মিলিয়ে যাবার আগেই দেশে স্যাটেলাইট চলে আসে। অবাক লাগত। একসঙ্গে কয়েকটা চ্যানেল? মানে কয়েকরকম অনুষ্ঠান চলবে, দেখা যাবে যেটা খুশি? অনেকদিন পর্যন্ত এটা উচ্চবিত্ত পরিবারেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমাদের জন্য ছিল বিটিভি। সেখানে অয়োময় (এই শব্দটার মানে এখনো জানা হয়ে ওঠেনি), কোথাও কেউ নেই, রূপনগর এমন আরও অনেক নাটক মনোযোগ দিয়ে দেখতাম আমরা, মানে সেই সময়কার বাচ্চারা। আমাদের বাসায় কম্পিউটার, টেলিফোন এসব তখন ছিল না। ডাকবিভাগের হলুদ রঙের সিল মারা খামে চিঠি আসত চাচাদের...ভাইয়া, পত্রে শতকোটি সালাম নিবেন, ভাবীকেও তদ্রূপ জানাবেন...তারপর দেশের বাড়ির নানা খবর। এখনও কি স্কুলের বইয়ে প্রিয় শখ লেখা হয় ডাকটিকেট সংগ্রহ? এখন নিশ্চয়ই ছোটরা শখ বদলে ফেলেছে। ফেলে দেয়া প্রিপেইড কার্ড বা পোকেমনের স্টিকার বরং যোগাড় করা সহজ। কিংবা সিরিয়াস ধরণের শিশুরা হয়ত ন্যাশনাল জিওগ্রাফি দেখে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করে। যস্মিন যুগে যদাচার।
স্কেচ
এমন কারো সাথে আমার পরিচয় নেই যে পেন্সিল স্কেচ করতে পারে। থাকলে যে আমার খুব লাভ হবে তা না। এমনিতেই। ছবি আঁকা বিষয়টার উপর আমার একটা মায়া আছে। একজন চিত্রশিল্পী আমার কাছে ঈর্ষণীয় ব্যাক্তি। আর সে যদি পেন্সিল স্কেচ করায় হাত পাকিয়ে থাকে তাহলে তো আরো। দাবি করব না যে আমি পেইন্টিং খুব বুঝি। বরং বলা যায়, বিমূর্ত চিত্রকলা জাতীয় কোনকিছুর থেকে আমি সাধারণ পেইন্টিংই বেশি পছন্দ করি। যেটার অর্থ একটু ভালভাবে তাকিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, উচ্চমার্গীয় তত্ত্ব হাতড়াতে হয়না। আমাদে পেপারের সাহিত্য সাময়িকীতে একটা কলাম দেয়। গুণীজনদের ভাললাগা মন্দলাগা নিয়ে। একটা প্রশ্ন থাকে, কোন ছবি এখনও চোখে লেগে আছে। তারা সবাই কমবেশি নানা দেশ ঘুরে আসা মানুষজন। কারো পছন্দ গুয়ের্নিকা, কারো সানফ্লাওয়ার, কারো মোনালিসা বা দ্য লাস্ট সাপার। আমারও একটা পছন্দের ছবি আছে। আমাকে তো কেউ জিজ্ঞেস করে না, তাই নিজেকেই আগ বাড়িয়ে বলতে হয়। একবার চারুকলার এক এক্সিবিশনে একটা পেন্সিল স্কেচ দেখেছিলাম। ছবির বিষয় মতিঝিলের দিককার একটা স্কাই ভিউ। খুব সম্ভবত সেখানকার কোন উঁচুতলার ছাদ থেকে তোলা কোন ফটোগ্রাফ দেখে আঁকা হয়েছে। যেভাবেই আঁকা হোক না কেন, এখনও পর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর ছবি সেটা। সেটা যে আসলে একটা সাদাকালো ফটো না, হাতে আঁকা ছবি, বিশ্বাস করা কঠিন। দুঃখের কথা হল সেই ছবিটার নাম বা আঁকিয়ের নাম আমার মনে নেই। একটা প্রতিযোগিতার প্রথম বা দ্বিতীয় ছবি ছিল। সেখানেই আরো কিছু চমৎকার পেইন্টিং দেখেছি। সবই পেন্সিলে করা। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা দুমড়ানো কনডেন্সড মিল্কের কৌটা, খাটের নীচের ফিতা খোলা কেডস, কুঁচকানো টেবিলক্লথ সবকিছু এত বেশি নিখুঁত! মানুষ যে কেমন করে এত সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকতে পারে!
Thursday, October 11, 2007
ফেমিনিন+ইজম
নারীবাদ বলে একটা শব্দ আছে। ইংরেজিতে যেটা নাকি হচ্ছে ফেমিনিজম। অক্সফোর্ড ডিকশনারির মতে, ফেমিনিজম মানে নারীদের জন্য অধিকার দাবির পক্ষে মতবাদ। আমার মোটেও পছন্দ না এসব ঘোলাটে অর্থ। নারীর আবার আলাদা অধিকার কি? তার মানে কি মানুষের অধিকার বলে কিছু নেই? পুরুষ আর নারীর জন্য দুই রকম? আবার তা থেকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত হলে সেটার পুনরুদ্ধার নিয়ে যদি কেউ সোচ্চার হয়, তখন তাকে একটা বিশেষ মতবাদের অনুসারী বলে মানতে হবে? এসব পুরুষদের তৈরী নিশ্চয়ই।
আজকে এক বন্ধুর রেজাল্ট জেনে একটা কথা মনে পড়ল। ছেলেরা এমনটা প্রায়ই বলে থাকে, বিশেষ করে কোন পরীক্ষার রেজাল্টের পর যদি দেখা যায় তালিকায় মেয়েদের রেজাল্ট তুলনামূলকভাবে বেশি ভাল। সেটা হল, মেয়েরা সারাদিন ঘরে থাকে, বেশি পড়াশোনা করে, তাদের রেজাল্ট তাই ভাল হয়। আর তারা বাইরে থাকে, তাই এত পড়ালেখা করা হয়ে ওঠেনা। বড়ই হাস্যকর কথা। যেন ফলাফলের মধ্যে ছেলে আর মেয়ের আলাদা রাঙ্কিং একটা দরকারি বিষয়, যেন তাদেরকে একটা যুক্তি দেখাতে হবে কেন মেয়েরা তাদের চেয়ে ভাল করল এবং যেন তাদেরকে কেউ মাথার দিব্যি দিয়েছে, বাইরে বাইরে সময় কাটানোর জন্য। ঘরে থাকলেই পড়াশোনা হয়ে যায়, আর মেয়েরাও ঘরে বসে কেবল বই খাতার মাঝেই ডুবে থাকে। সে যাক, টিন এজারদের কত রকম কমপ্লেক্স থাকে। কিন্তু একদিন টিভিতে একই ধরণের একটা অনুষ্ঠান দেখে বিরক্তিবোধ হল। বেশ একটা নারী পুরুষ নিয়ে টক শো। ভাবলাম হয়ত ইন্টারেস্টিং কিছু হবে। কিন্তু হতাশ হতে হল। টিন এজ অনেক আগেই পেরিয়ে আসা তরুণ তরুণীরা সেই একই কাসুন্দি ঘাঁটতে ব্যস্ত। ছেলেরা আগোছালো, তারা টাকা পয়সার হিসাব গুলিয়ে ফেলে, মেয়েরা সাজতে বেশি সময় নেয়, তারা শপিং করতে গেলে সারাদিন লাগিয়ে দেয় এইসব নিয়ে তর্ক পাল্টা তর্ক। ওই বন্ধু পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। ভাবছি তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে সে বাইরে ব্যস্ত না হয়ে বেশি বেশি বাসায় থাকতো কিনা।
আজকে এক বন্ধুর রেজাল্ট জেনে একটা কথা মনে পড়ল। ছেলেরা এমনটা প্রায়ই বলে থাকে, বিশেষ করে কোন পরীক্ষার রেজাল্টের পর যদি দেখা যায় তালিকায় মেয়েদের রেজাল্ট তুলনামূলকভাবে বেশি ভাল। সেটা হল, মেয়েরা সারাদিন ঘরে থাকে, বেশি পড়াশোনা করে, তাদের রেজাল্ট তাই ভাল হয়। আর তারা বাইরে থাকে, তাই এত পড়ালেখা করা হয়ে ওঠেনা। বড়ই হাস্যকর কথা। যেন ফলাফলের মধ্যে ছেলে আর মেয়ের আলাদা রাঙ্কিং একটা দরকারি বিষয়, যেন তাদেরকে একটা যুক্তি দেখাতে হবে কেন মেয়েরা তাদের চেয়ে ভাল করল এবং যেন তাদেরকে কেউ মাথার দিব্যি দিয়েছে, বাইরে বাইরে সময় কাটানোর জন্য। ঘরে থাকলেই পড়াশোনা হয়ে যায়, আর মেয়েরাও ঘরে বসে কেবল বই খাতার মাঝেই ডুবে থাকে। সে যাক, টিন এজারদের কত রকম কমপ্লেক্স থাকে। কিন্তু একদিন টিভিতে একই ধরণের একটা অনুষ্ঠান দেখে বিরক্তিবোধ হল। বেশ একটা নারী পুরুষ নিয়ে টক শো। ভাবলাম হয়ত ইন্টারেস্টিং কিছু হবে। কিন্তু হতাশ হতে হল। টিন এজ অনেক আগেই পেরিয়ে আসা তরুণ তরুণীরা সেই একই কাসুন্দি ঘাঁটতে ব্যস্ত। ছেলেরা আগোছালো, তারা টাকা পয়সার হিসাব গুলিয়ে ফেলে, মেয়েরা সাজতে বেশি সময় নেয়, তারা শপিং করতে গেলে সারাদিন লাগিয়ে দেয় এইসব নিয়ে তর্ক পাল্টা তর্ক। ওই বন্ধু পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। ভাবছি তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে সে বাইরে ব্যস্ত না হয়ে বেশি বেশি বাসায় থাকতো কিনা।
Wednesday, October 10, 2007
ফুল
বেশ মেঘলা আজকের দিন, আজকের রাত। মেঘ মন্দ না। বৃষ্টিটাই যা মাঝেমাঝে বাড়াবাড়ি করে রাগিয়ে দেয়। এই রাতেও বাইরে মানুষজনের শব্দ। একটা অপরিচিত ফুলের ঝাঁঝও যেন আসছে। কিছুদিন আগে একটা নতুন জিনিস জানলাম। সেটা হল শিউলি ফুলের আরেক নাম হচেছ সেঁউতি। শিউলি ফুল আমার খুব পছন্দ। সাদা রঙের ফুল আমার সবচেয়ে ভাল লাগে। বেশির ভাগ সাদা ফুল মনে হয় রাতের বেলা ফোটে। গন্ধটা হয় একটু কড়া। খুব ছোটবেলায় আমরা যে বাসাটায় থাকতাম তার সামনে একটা কামিনীর গাছ ছিল। গভীর রাতে সুন্দর গন্ধ আসত। আর সকালে দেখা যেত নিচে একরাশ সাদা ফুল পড়ে আছে। তখন থেকেই কামিনী গাছ মানেই আমার কাছে রূপকথার গাছ। গাঢ় বাকল আর পাতাওয়ালা অভিজাত একটা গাছ। এখনও আমি সেটা মানি। আমাদের সবারই কিছু ধারণা আছে যেগুলো আমরা শৈশব থেকে লালন করি। অর্থহীন, ভিত্তিহীন কিন্তু আমারা তবু সেসবকে মনের মধ্যে পুষে রাখি। এটা কোন ছেলেমানুষি না। এটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
Subscribe to:
Posts (Atom)