Tuesday, January 8, 2008

নস্ট্যালজিক আমি

কবি কবি চেহারা, কাঁধেতে ঝোলানো ব্যাগ,
মুছে যাবে অমলের নামটা;
একটা কবিতা তার হল না কোথাও ছাপা,
পেল না সে প্রতিভার দামটা... ... ...

নস্ট্যালজিয়া নিয়ে যত বাংলা গান হয়েছে তার মধ্যে ‘কফি হাউস’ একেবারে প্রথম দিকের একটা। গানটা আমি প্রথম শুনি পপির মুখে। আমরা তখন ক্লাস সেভেনে পড়তাম। পপির গানের গলা ছিল খুবই সুন্দর। টিচার না আসলে বা ক্লাসে বেশি চেঁচামেচি হলে ও ডায়াসে উঠে গান গেয়ে শোনাত। এই গানটা বেশ কয়েকবার গেয়েছিল ও, কারণ এটা ছিল শ্রোতাদের বিশেষ পছন্দ । আমরা গানের কথার মর্ম উপলব্ধি করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। (এখন ক্লাস সেভেন পড়ুয়াদেরকে বাচ্চা মনে হয়, কিন্তু আসলে এটা মোটেও বাচ্চাদের ক্লাস না) এও বুঝতাম যে লাখপতি স্বামী আছে বলেই সুজাতাকে সুখী বলে ফেলা ঠিক হচ্ছে না। এখন গানটা নিজে বাজিয়ে শুনি। কখনো রেডিওতে শোনা হয়। সাত বন্ধুর মধ্যে আমার দুঃখ এখনও পর্যন্ত অমলের জন্যই বেশি। বলা হয়েছে জীবন তাকে ক্ষমা করেনি। তাহলে অমল কোন অপরাধ করেছিল নিশ্চয়ই, আর সেটা সম্ভবত নিজের জীবন নিয়েই। কি ভুল করেছিল অমল? ডি সুজা কিভাবে মরল? অসুখ না আর কিছু? আর যে সবাইকে নিয়ে গান গায়, তার নামটা পাওয়া যায় না। সে কোথায় কি অবস্থায় আছে তাও জানা হয় না। টিভিতে কফি হাউস অবলম্বনে একটা নাটক হয়েছিল, কিছুটা চেঞ্জ করে, দেখার ইচ্ছা হয়নি। সেখানে নাম না জানা ব্যক্তিটার নাম ছিল খুব সম্ভবত আদিত্য।


আমরা নিজেরাও তো এমনই। মাঝে মাঝে স্কুলজীবনের হারিয়ে যাওয়া সহপাঠীদের কথা ভাবলে মনে হয় যেন সবাই কত যোজন দূরে। হতে পারে একই শহরে বাস করি সেই কোকিলকণ্ঠী পপির কাছাকাছি কোথাও । কিন্তু কে আছে কোথায় কে জানে। মিতুল ছিল শান্ত স্বভাবের কিন্তু খুব হাসত। লুনা নামের সুন্দর দেখতে একটা মেয়ে ছিল। মিতু ছিল গোলগাল হাসিখুশি একজন। পাশার ভবিষ্যত পরিকল্পনা ছিল বড় হয়ে প্রধানমন্ত্রী হবে। কে যে কোন স্রোতের টানে কোন মোহনার দিকে ভেসে গেছে আমি বলতে পারব না। কেউ কেউ বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়েছে। অনেকে বসার তোড়জোড় করছে। এরা তো কেবল সহপাঠী। কাছের বন্ধুদেরকেই এখন সবাইকে একসঙ্গে করা যায় না। ব্যাট বল মেলে না। শুধু ফোনেই যা কথা হয়। মাঝে মাঝে একথা ভাবতে খুব ক্লান্তি এসে যায়, কত দিকে ডালপালা মেলেছে আমাদের জীবন। কোন কমন বিষয় কি এখন আদৌ আছে আলোচনার জন্য? কখনো একসঙ্গে হলে ক্যারিয়ার পরিবার সম্পর্ক এসব নিয়ে গিজগিজ করা মাথাগুলো কি তুচ্ছাতিতুচ্ছ কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ার মত হালকা হবে? অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ক্রিকেটারটা আসলে কাকে পেয়ে ধন্য হবে জন্য এটা নিয়ে কোন দুইজনের মধ্যে বাগযুদ্ধও হবে না আর কখনো। প্যারোডি কবিতা বানানোর মত মুড নেই আমাদের, অবসর নেই কারো কথার বলার স্টাইল নকল করে আনন্দ পাওয়ারও।

আমি মনে হয় একটু বেশিই retrospective. এতটা হওয়া উচিত না, অন্তত এই বয়সে তো না-ই। গড় আয়ুর অর্ধেক হতেও যখন ঢের বাকি, তখন এসব হাপিত্যেস একেবারেই মানায় না। ধরলাম আমি একজন বিখ্যাত লেখক বা কবি গোছের কিছু একটা হয়ে গেলাম। তখন তো আমাকে নিয়ে অনেক পড়তে হবে ছাত্রছাত্রীদের ( মানে যেমন আমরা John Donne বা Robert Browning কে সিলেবাসে পাই )। তো আমার মূলভাবটা ধরে ফেলা খুব সহজ হবে ওদের জন্য...লেখকের মধ্যে অতীত হাতড়ে নিঃশ্বাস ফেলার প্রবণতা প্রবল... কিন্তু এত সহজে তো ধরা দেয়া চলবে না। ঠিক আছে মহান লেখক বা বিরাট কবি টাইপের কিছু হওয়ার চিন্তা বাদই দিলাম। কিন্তু একথা সত্যি যে আমি ছোটবেলাটা পার করে ফেলে একটু দুঃখিতই। কিশোরদের জন্য লেখা একটা বইয়ে পড়েছিলাম, লেখক ভূমিকায় বলছেন, তার সবচেয়ে বড় দুঃখ হল তার শৈশব শেষ হয়ে গেছে। কথাটা মনে হয় ভুল না। অদ্ভুত চিন্তাধারা আমাদের! ছোটবেলায় ছোট থাকলাম কেন, বড় হয়ে বড় হলাম কেন আর বার্ধক্যের কথা তো বাদই দিলাম। মানুষ কোনমতেই নিজেকে নিয়ে সুখী থাকতে পারে না। মাটির দেহের খাঁচায় বায়বীয় অসন্তুষ্টি। যতদিন এই মাটি, ততদিন সেই বায়ু।

No comments: