ছেলেটার পাশের বাড়িতে থাকত মেয়েটা। অনেকদিনের প্রতিবেশী। ছোট থেকে তারা বড় হয়েছে এখানেই। ছেলেটার চোখে তখন নানা রঙের স্বপ্ন, জীবন জীবিকা প্রেম ভবিষ্যত এবং হয়ত আরো অনেক কিছু নিয়ে। বহুদিনের পরিচিত কমবয়সী মেয়েটার বাড়াবাড়ি আগ্রহ, অহেতুক কাছ ঘেঁষা তাই তেমন করে লক্ষ্যই করেনি সে। বা করলেও গুরুত্ব দেয়নি। একদিন হঠাত করে একটা চিরকুট হাতের মধ্যে গোঁজা পেয়ে তাই খানিকটা অবাক এবং খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়ল ছেলেটা। সরু করে অল্প যে কয়টা লাইন লেখা ছিল সেগুলোতে একটু অনুরোধ ছিল মেয়েটার বড় হবার জন্য অপেক্ষা করার, অনেকটা অনুনয় ছিল তার সমস্ত জমানো ভালবাসা অকুণ্ঠচিত্তে গ্রহণ করার। ছেলেটা আঁকাবাঁকা লেখাগুলোতে কয়েকবার নজর বুলালো। খানিক ভাবল। তারপর হেঁটে গেল পাশের বাড়ির দরজায় মেয়েটাকে কিছু বলার জন্য। সেই পুরানো জবাব, মেয়ে আমি তো অপেক্ষা করে থাকতে পারব না তোমার জন্য, আমার সামনে অবারিত সম্ভাবনা, তুমি ছোট হতে পার কিন্তু আমি তো বড় হয়েছি, জীবনকে আমি বুঝতে পারি। ভেবো না, আর একটুও দুঃখ কোরো না, তুমি অনেক ভাল থাকবে, দারুণ একটা জীবন হবে তোমার, দেখো তোমার এই ক্ষণিকের মোহ কেটে যাবে কিছুদিনেই কারণ একদিন মানুষ আগের ভাললাগাগুলো ভুলে যায়। এরপর সেই পুরানো প্রতিক্রিয়া, মেয়েটার অঝোর ধারায় কান্নাকাটি, প্রত্যাখ্যাত মনের ভার; কিছু না করতে পেরে ছেলেটারও একটু অপরাধবোধ।
কিছুদিন গড়ালে পরিচিত শহর ছাড়ে ছেলেটা। কাজের সন্ধানে জীবিকার তাগিদে স্বপ্নকে বাস্তব করার তাড়নায় অচেনাদের ভীড়ে দূরের নগরে জীবন শুরু করে। এভাবে অনেক দিন কেটে যায়। কিন্তু এখানেও সেই পুরানো গল্প। থেকে থেকে তার মনে পড়ে ফেলে আসা বাড়ি, মা বাবা, বন্ধুরা, আর সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে চিরকুট আর মেয়েটাকে। তার অনুভব হতে থাকে পেছনে ছেড়ে আসা শহর আর মানুষের কাছে তার প্রাণ বাঁধা পড়ে আছে। হঠাৎ করেই সে বুঝে ফেলে তাকে আসলে সেই মেয়েটার কাছে ফিরে যেতে হবে। বাড়ির পথ ধরে ছেলেটা। খুঁজে পাওয়ার আনন্দ আবার সেই সাথে হারিয়ে ফেলার আশংকা বুকে নিয়ে এবার দৌঁড়ে যায় পাশের বাড়ির দরজায়, যদি সব আগের মত ঠিক না থাকে? শেষ পর্যন্ত তাই হল। এবার মেয়েটার কাছ থেকে তাকে জানতে হল, একদিন সবাই সব কিছু ভুলে যেতে পারে, তাই ছেলেটারওসব ভাবনা একদিন বদলে যাবে, মেয়েটাকে না পাওয়া নিয়ে আর কোন দুঃখবোধ থাকবে না।
কিছুদিন ধরে একটা অদ্ভুত ইচ্ছা হচ্ছে। যদি একটা কিছু ঘটত খুব নাটকীয়! যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি সাদা না কালো মত দিতে পারি না, আমাকে ধূসর রঙ বেছে নিয়ে বসে থাকতে হয়, এবং অন্য কাউকে আমার হয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হয়, তাই বের করে নিতে পারছি না ঠিক কি ঘটার জন্য এত লোভ হচ্ছে। তারপরও ভাবছি আমি নিজে বা কেউ কিছু একটা করে বসত, যেটাতে আমার অনেক গুছানো হিসাব নিকাশ বদলে যাবে। আর সেই বদলটা অবশ্যই হবে একেবারেই ধনাত্মক। মাঝে মাঝে যখন মনে হয় হাতের খুব কাছের কোন কিছুকে আমি এড়িয়ে যাচ্ছি কেবল চোখ খুলে তাকাচ্ছি না বলে, তখন আর কেউ কিছু করে দিক এমন ইচ্ছাটা করে। যেভাবে করে সবকিছু হচ্ছে তাকে দুম করে পালটে একটা অন্য কিছু করে দিতে পারলে কেমন হত? এমন কিছু যেটা কখনো ধারণা করি নি। জানি না জীবনে ঘোলা দৃষ্টির ভুলে বা বোকা চিন্তার শিকার হয়ে কখনো মূল্যবান কিছু হারিয়ে গেছে কিনা। যদি হারিয়েই থাকে তবে পরে কখনো সেটা টের না পেলেই ভাল।
গল্পটা কনওয়ে টুইটির ‘ডোন্ট ক্রাই জোনি’ গানের। ভাল লাগা গানটা অনেকেরই শোনা। লিংক দিতে গিয়ে আমি ভুল করে ফেলি বলে আর দেয়া হল না।
Monday, December 28, 2009
Sunday, December 20, 2009
দৃষ্টিসঙ্গী
ক্লাস সেভেনে থাকতে ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলার সময় আমি প্রথম টের পাই যে আমি টিভির ডান কোণায় থাকা স্কোর ঠিকমত পড়তে পারছি না, খাটুনি হচ্ছে। কিছুদিন পর ডাক্তার দেখাতে হল। এবং প্রথমবারের মত আমার নাকের গোড়ায় চশমা এঁটে গেল। আমি বুঝতে পারলাম এতদিন যেটুকুকে সবকিছু ঠিকঠাক দেখতে পারা মনে করতাম আসলে তার থেকে বেশি দেখে স্বাভাবিক চোখের মানুষেরা। সেই থেকে চশমা আমার সঙ্গী। প্রথমে ছিল কার্বন ফ্রেমের হালকা খয়েরি একটা চশমা। পরে সেটা হল আরেকটু গাঢ় খয়েরি। বছর ঘুরতেই সোনালি, কারণ তখন চশমার জন্য সোনালিই স্মার্ট ফ্রেম ছিল। সেই সাথে নিয়মিত চেকআপ আর সাথে গুটি গুটি করে কাঁচের শক্তিবৃদ্ধি হওয়া তো ছিলই। ততদিনে আমি অনেক চালাক। শিখে গেছি দূরের জিনিস কম দেখলে মাইনাস হয় আর কাছের জিনিস কম দেখলে হয় প্লাস। প্লাস চশমা থাকে আব্বুদের যারা খালি চোখে থাকলে খবরের কাগজ ভালভাবে পড়তে পারার জন্য মুখের কাছাকাছি না এনে বরং চোখ কুঁচকে দূরে মেলে ধরেন। একবার ডাক্তারের কথা শুনে অবাক হয়েছিলাম। আমি তখন ক্লাস এইটে। ডাক্তার আব্বুকে বললেন, ‘মেয়ের চোখের পাওয়ার তো দিনে দিনে বাড়বে, আপনার একটা কথা জানা থাকা ভাল। সেটা হচ্ছে মেয়ের যখন বিয়ে দিবেন দেখবেন ছেলে যেন মাইনাস পাওয়ারের না হয়। প্লাস হলেও সমস্যা হবে না। কারণ দুইজনই যদি মাইনাস হয় তাহলে বাচ্চারা হবে ডাবল মাইনাস।’ আমি তো শুনে বিশাল বিব্রত। আরে ডাক্তার আমার সামনে এসব কি সব বিয়ের কথা বলে? আমি ছোট না? সেই থেকে কথাটা মনের মধ্যে গেঁথে গেল। তখন আবার প্যাকেজ নাটকের স্বর্ণযুগ। বড় হলে যে একটু আধটু প্রেমপ্রীতি হয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক তা খুব বুঝতাম। ভার্সিটিতে পড়ার সময় যদি কোন মাইনাসওয়ালা ছেলেকে মনে ধরে যায় তাহলে যে মুশকিল হবে সেটা ভেবে একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। ক্লাস টেনে উঠে পদার্থবিদ্যার বইয়ের কল্যাণে জানতে পারলাম আমার প্রবলেমটার নাম হচ্ছে মাইওপিয়া এবং কেউ যদি জিজ্ঞেস করত চশমার পাওয়ার কত তাহলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতাম মাইনাস এত ‘ডাইওপ্টার’।
যাই হোক, সোনালি চশমা চালু থাকা অবস্থাতেই ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে মেন্ডেল এসে আমার রোমান্টিক মনে আরেকটা খোঁচা দিল। তার দ্বিতীয় সূত্র থেকে বের করে ফেললাম আমার চার ছেলেমেয়ের মধ্যে একজনের চোখের সমস্যা থাকবে না। তবু খুশি হবার উপায় ছিল না। কারণ তখনও চশমা পরা ছেলেদেরকেই একটু মুডি লাগলেও আর বেশি পছন্দ হলেও চার চারটা ছেলেমেয়ে বড় করার ঝামেলার কাছে তা ম্লান না হয়ে পারত না। ভার্সিটিতে উঠে চশমাটা বিচ্ছিরি হয়ে গেল, কালো রঙের আজব একটা ফ্রেম। আবার তাড়াতাড়ি সেটা বদলে একটা মোটা কালো হাফরিম। কাঁচ মোটা হওয়ায় রিমলেস পরার শখ কখনোই মিটল না, এখনকার কালো হাফরিমটাই তাই ভরসা। পাশাপাশি আমি বেশ উদারও হয়ে গেছি দিনে দিনে। ডাক্তারের পরামর্শটা অন্যদের শোনালেও চশমা পরলে কাউকে ভাল লাগাটা বাতিল করার কথা মাথায় আসে না আর।
এই চশমার অনুগ্রহে ধীরে ধীরে হুমায়ূন আহমেদের শুভ্রর জ্বালা কিছুটা বুঝতে শেখা হয়েছে। কখনও ইচ্ছা হত একদিন সকালে উঠে যেন দেখি সব ঠিক। কতবার ভেবেছি আমাকে যদি কেউ মরণোত্তর চক্ষুদান করে যেত। মনে মনে চেয়েছি কেউ যদি অনেক টাকা দিয়ে আমাকে ল্যাসিক করিয়ে দিত যেখানে কোন রিস্কই থাকবে না। কেউ যে এমনি এমনিই সব কিছু দেখতে পায় এটা এখন আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। যখন দেখতাম কেউ শখ করে চশমা পরে তখন খুব রাগ হত। ক্লাসের কেউ নতুন চশমা নিলে একধরণের ভাল লাগত, আমি একাই কেন কষ্ট করব, অন্যরাও করুক। কিন্তু অন্যদেরগুলো হত মাথাব্যথার চশমা যেগুলো মাস কয়েকের মধ্যে উধাও হয়, আমার মত গেড়ে বসে না।
আমার চশমাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য কয়েক বছর ধরে ঘরে আছে কন্ট্যাক্ট লেন্স। প্রথম যেদিন চোখে দিই আমি তো অবাক। কত বছর পর আমি চশমা ছাড়াই সত্যি সত্যি সব দেখতে পাচ্ছি! ইচ্ছামত কাজল লাগাতে পারছি। সানগ্লাসও পরতে পারছি। শুধু মন ভরে ঘুমাতে পারছিনা এটা নিয়ে। আর লেন্স পোষাটা চার ছেলেমেয়ে না হোক, জমজ ছেলেমেয়ে লালনপালন করার মত ঝামেলার হয়ে যায় মাঝে মাঝে। তাই চশমাই বেশি প্রিয়।
চোখে এতখানি ঘাটতি থাকার দুঃখটা আমার মত ভুক্তভোগীরা ছাড়া আর কেউ একটুও বুঝতে পারবে না। তারপরও আগের মত খারাপ লাগে না এখন। জানি না সেটা অভ্যাসের জন্য নাকি এমনিতেই। চোখের কমতি পুরোটাই পুষিয়ে নেয়া যাচ্ছে। আজকে যদি পা না থাকত কিংবা হাত, এত সহজে পারতাম একটা সঙ্গী পেতে যে এত বেশি সাহায্য করতে পারে? আর আয়নাতে দেখতেও মন্দ লাগে না। আমার পাওয়া সেরা কমপ্লিমেন্ট আমার নার্সারি পড়ুয়া চাচাতো বোনের যে বক্তব্য দেয়ার আগে কিছুক্ষণ ভেবে নেয়; “রিমি আপু, তোমাকে তো চশমা পরলে বেশ সুন্দর লাগে। আমি তো আগে লক্ষ্য করি নাই।”
উড়ে এসে জুড়ে বসা যন্ত্রণাটাকে ছাড়া এখন কেমন কেমন খালি খালি লাগে।
যাই হোক, সোনালি চশমা চালু থাকা অবস্থাতেই ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে মেন্ডেল এসে আমার রোমান্টিক মনে আরেকটা খোঁচা দিল। তার দ্বিতীয় সূত্র থেকে বের করে ফেললাম আমার চার ছেলেমেয়ের মধ্যে একজনের চোখের সমস্যা থাকবে না। তবু খুশি হবার উপায় ছিল না। কারণ তখনও চশমা পরা ছেলেদেরকেই একটু মুডি লাগলেও আর বেশি পছন্দ হলেও চার চারটা ছেলেমেয়ে বড় করার ঝামেলার কাছে তা ম্লান না হয়ে পারত না। ভার্সিটিতে উঠে চশমাটা বিচ্ছিরি হয়ে গেল, কালো রঙের আজব একটা ফ্রেম। আবার তাড়াতাড়ি সেটা বদলে একটা মোটা কালো হাফরিম। কাঁচ মোটা হওয়ায় রিমলেস পরার শখ কখনোই মিটল না, এখনকার কালো হাফরিমটাই তাই ভরসা। পাশাপাশি আমি বেশ উদারও হয়ে গেছি দিনে দিনে। ডাক্তারের পরামর্শটা অন্যদের শোনালেও চশমা পরলে কাউকে ভাল লাগাটা বাতিল করার কথা মাথায় আসে না আর।
এই চশমার অনুগ্রহে ধীরে ধীরে হুমায়ূন আহমেদের শুভ্রর জ্বালা কিছুটা বুঝতে শেখা হয়েছে। কখনও ইচ্ছা হত একদিন সকালে উঠে যেন দেখি সব ঠিক। কতবার ভেবেছি আমাকে যদি কেউ মরণোত্তর চক্ষুদান করে যেত। মনে মনে চেয়েছি কেউ যদি অনেক টাকা দিয়ে আমাকে ল্যাসিক করিয়ে দিত যেখানে কোন রিস্কই থাকবে না। কেউ যে এমনি এমনিই সব কিছু দেখতে পায় এটা এখন আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। যখন দেখতাম কেউ শখ করে চশমা পরে তখন খুব রাগ হত। ক্লাসের কেউ নতুন চশমা নিলে একধরণের ভাল লাগত, আমি একাই কেন কষ্ট করব, অন্যরাও করুক। কিন্তু অন্যদেরগুলো হত মাথাব্যথার চশমা যেগুলো মাস কয়েকের মধ্যে উধাও হয়, আমার মত গেড়ে বসে না।
আমার চশমাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য কয়েক বছর ধরে ঘরে আছে কন্ট্যাক্ট লেন্স। প্রথম যেদিন চোখে দিই আমি তো অবাক। কত বছর পর আমি চশমা ছাড়াই সত্যি সত্যি সব দেখতে পাচ্ছি! ইচ্ছামত কাজল লাগাতে পারছি। সানগ্লাসও পরতে পারছি। শুধু মন ভরে ঘুমাতে পারছিনা এটা নিয়ে। আর লেন্স পোষাটা চার ছেলেমেয়ে না হোক, জমজ ছেলেমেয়ে লালনপালন করার মত ঝামেলার হয়ে যায় মাঝে মাঝে। তাই চশমাই বেশি প্রিয়।
চোখে এতখানি ঘাটতি থাকার দুঃখটা আমার মত ভুক্তভোগীরা ছাড়া আর কেউ একটুও বুঝতে পারবে না। তারপরও আগের মত খারাপ লাগে না এখন। জানি না সেটা অভ্যাসের জন্য নাকি এমনিতেই। চোখের কমতি পুরোটাই পুষিয়ে নেয়া যাচ্ছে। আজকে যদি পা না থাকত কিংবা হাত, এত সহজে পারতাম একটা সঙ্গী পেতে যে এত বেশি সাহায্য করতে পারে? আর আয়নাতে দেখতেও মন্দ লাগে না। আমার পাওয়া সেরা কমপ্লিমেন্ট আমার নার্সারি পড়ুয়া চাচাতো বোনের যে বক্তব্য দেয়ার আগে কিছুক্ষণ ভেবে নেয়; “রিমি আপু, তোমাকে তো চশমা পরলে বেশ সুন্দর লাগে। আমি তো আগে লক্ষ্য করি নাই।”
উড়ে এসে জুড়ে বসা যন্ত্রণাটাকে ছাড়া এখন কেমন কেমন খালি খালি লাগে।
Tuesday, November 24, 2009
একটা অলস বিকাল
শুনতে কি চাও তুমি সেই অদ্ভূত বেসুরো সুর? ফিরে পেতে চাও কি সেই আনচান করা দুপুর?
দেখতে কি চাও তুমি সেই খেলনাওয়ালাটাকে? তার খেলনার দোতারা সে বাজাচ্ছে কবে থেকে।
স্কুলের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কেনা, সেই অদ্ভূত ফাটা বাঁশ আর মাটির সুর টানা টানা।
দু’দিনের সম্পদ দু’টাকার বাজনার বিস্ময়।
তারপর কখন হঠাৎ সুখের মানে পালটে যায়।
তারপর টিফিনের পয়সা দিয়ে সিগারেট, কলেজগেটে সিনেমা, বান্ধবীর সাথে কাটলেট।
আসে দশটা পাঁচটা সেই এক রুটের বাসটা তারপর।
সবার মতই পরতে হয় যে কাগজের টোপর।
এখন মাসের শেষে মাঝে মধ্যে কান্না পায়, মিনিবাসে দাঁড়িয়ে অফিস যাবার সময়।
এখন বুঝেছি সে অদ্ভূত সুরের কি মানে,
ফিরে তো যাওয়া যায় না যে আর সেখানে।
যেতে হবে যে তোমাকে আমাকে চলে। লুকোনো টেক্কা সংসারের এক্কা দোক্কা ফেলে।
প্রথমে যাবে ঘরদোর দোকানপাট তারপর হৃদয়
কিছুই হল না, বাজানো গেল না সময়।
ইদানিং সে সুরটা শুনতে যে খুব ইচ্ছে হয়,
কিন্তু সে খেলনাওয়ালা আর আসে না পাড়ায়।
হয়ত কোন অন্য অলিগলি ঘুরে, অন্য কোন কাউকে সে টানছে সে অদ্ভূত সুরে।
-অঞ্জনের একটা গান।
শীতের বিকালে একা ঘরে বসে থাকা একটুও সুখের না। মাঝগগন থেকে সূর্য আস্তে আস্তে পাটের পথে নামতে থাকবে আর তোমার মাথার মধ্যে মনের মধ্যে যেন একসাথে অনেকগুলো দরজা জানালার কপাট খুলবে আর বন্ধ হবে, বন্ধ হবে আর খুলবে। তারপর ইতোমধ্যে বেঁচে ফেলা তোমার সবগুলো দিন সেই কপাটগুলোর ওপাশে রাশি রাশি মুখ হয়ে উঁকি দিবে। আবার পালাবে। পুরানো সব সুর তোমার কানে বাজতে থাকবে। মন আনচান করা দুপুরগুলোকে একটা একটা করে ঢেলে দিতে ইচ্ছা করবে ক্যালেন্ডারের অনাগত পাতায়। তুমি যদি একটু বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াও তো চাক্ষুষ দেখবে পথে পড়া হলদে রোদটা কেমন ফিকে হয়ে ঘিয়া রং বাধিয়ে বসছে আস্তে আস্তে। অস্থির ভাবটা লুকিয়ে আদুরে লক্ষ্মীপানা মুখ করে তুমি বলতে চাইবে, দুপুর শেষ তো মা সবাই নেমে গেছে, এবার খেলতে যাই না! ঠিক তখুনি আবার বুঝে ফেলবে কিসের খেলা কিসের কি। আবার হয়ত শালে জড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে ক্যাম্পাসের ফুটপাথে বসতে চাইবে, ধোঁয়া উঠা চায়ে চুমুক দেয়ার জন্য। আশপাশ তাকালেই দেখবে উঁহু সে হবার নয়। আরো যখন বেলা পড়বে, আলো কমতে থাকবে আরো, তখন একটা অদ্ভূত মিষ্টি গন্ধ পাবে। তুমি ঠিক নাম বলতে পারবে না কিসের গন্ধ এটা, ধোঁয়া ধোঁয়া একটা ঘ্রাণ। তোমার ভাল লাগবে। যখন টের পাবে ভাল লাগলেও ভাললাগাগুলোকে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারছ না, তখন আবার খারাপও লাগবে। তারপর পাখপাখালির কিচমিচ শুরু হবে অনেক, কারণ ঘরে ফিরছে তারা। তোমার ভাবতে ভাল লাগবে এই শীতের পড়ন্ত বেলায় কুয়াশা মাথায় করে ফিরতে পেলে বেশ হত। কিন্তু কোথা থেকে কোথায় ফিরবে ঠাহর করতে পারবে না। সন্ধ্যা নেমে যাবে। তুমি ঘরে আসতে চাইবে, আবার বেরিয়ে যেতে চাইবে, কিছু একটা করতে চাইবে আবার কিচ্ছুটা করতে ইচ্ছা হবে না। অনেক কিছুকে তুমি ধরতে ছুঁতে পেতে বুঝতে বা দেখতে চাইবে, যার রহস্য কেবল তুমিই জানো। কিন্তু সেই সবগুলো কিছুই মুঠিতে ধরা পানির মত আঙ্গুলের ফাঁক গলে হারিয়ে যাবে। তোমার একটু দুঃখ দুঃখ লাগবে। শীতের অলস বিকাল বড়ই লক্ষ্মীছাড়া, কিন্তু তুমি অস্বীকারও করবে না যে চাপা একটা কষ্ট দেয় বলেই তুমি তাকে ভালবাস।
দেখতে কি চাও তুমি সেই খেলনাওয়ালাটাকে? তার খেলনার দোতারা সে বাজাচ্ছে কবে থেকে।
স্কুলের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কেনা, সেই অদ্ভূত ফাটা বাঁশ আর মাটির সুর টানা টানা।
দু’দিনের সম্পদ দু’টাকার বাজনার বিস্ময়।
তারপর কখন হঠাৎ সুখের মানে পালটে যায়।
তারপর টিফিনের পয়সা দিয়ে সিগারেট, কলেজগেটে সিনেমা, বান্ধবীর সাথে কাটলেট।
আসে দশটা পাঁচটা সেই এক রুটের বাসটা তারপর।
সবার মতই পরতে হয় যে কাগজের টোপর।
এখন মাসের শেষে মাঝে মধ্যে কান্না পায়, মিনিবাসে দাঁড়িয়ে অফিস যাবার সময়।
এখন বুঝেছি সে অদ্ভূত সুরের কি মানে,
ফিরে তো যাওয়া যায় না যে আর সেখানে।
যেতে হবে যে তোমাকে আমাকে চলে। লুকোনো টেক্কা সংসারের এক্কা দোক্কা ফেলে।
প্রথমে যাবে ঘরদোর দোকানপাট তারপর হৃদয়
কিছুই হল না, বাজানো গেল না সময়।
ইদানিং সে সুরটা শুনতে যে খুব ইচ্ছে হয়,
কিন্তু সে খেলনাওয়ালা আর আসে না পাড়ায়।
হয়ত কোন অন্য অলিগলি ঘুরে, অন্য কোন কাউকে সে টানছে সে অদ্ভূত সুরে।
-অঞ্জনের একটা গান।
শীতের বিকালে একা ঘরে বসে থাকা একটুও সুখের না। মাঝগগন থেকে সূর্য আস্তে আস্তে পাটের পথে নামতে থাকবে আর তোমার মাথার মধ্যে মনের মধ্যে যেন একসাথে অনেকগুলো দরজা জানালার কপাট খুলবে আর বন্ধ হবে, বন্ধ হবে আর খুলবে। তারপর ইতোমধ্যে বেঁচে ফেলা তোমার সবগুলো দিন সেই কপাটগুলোর ওপাশে রাশি রাশি মুখ হয়ে উঁকি দিবে। আবার পালাবে। পুরানো সব সুর তোমার কানে বাজতে থাকবে। মন আনচান করা দুপুরগুলোকে একটা একটা করে ঢেলে দিতে ইচ্ছা করবে ক্যালেন্ডারের অনাগত পাতায়। তুমি যদি একটু বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াও তো চাক্ষুষ দেখবে পথে পড়া হলদে রোদটা কেমন ফিকে হয়ে ঘিয়া রং বাধিয়ে বসছে আস্তে আস্তে। অস্থির ভাবটা লুকিয়ে আদুরে লক্ষ্মীপানা মুখ করে তুমি বলতে চাইবে, দুপুর শেষ তো মা সবাই নেমে গেছে, এবার খেলতে যাই না! ঠিক তখুনি আবার বুঝে ফেলবে কিসের খেলা কিসের কি। আবার হয়ত শালে জড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে ক্যাম্পাসের ফুটপাথে বসতে চাইবে, ধোঁয়া উঠা চায়ে চুমুক দেয়ার জন্য। আশপাশ তাকালেই দেখবে উঁহু সে হবার নয়। আরো যখন বেলা পড়বে, আলো কমতে থাকবে আরো, তখন একটা অদ্ভূত মিষ্টি গন্ধ পাবে। তুমি ঠিক নাম বলতে পারবে না কিসের গন্ধ এটা, ধোঁয়া ধোঁয়া একটা ঘ্রাণ। তোমার ভাল লাগবে। যখন টের পাবে ভাল লাগলেও ভাললাগাগুলোকে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারছ না, তখন আবার খারাপও লাগবে। তারপর পাখপাখালির কিচমিচ শুরু হবে অনেক, কারণ ঘরে ফিরছে তারা। তোমার ভাবতে ভাল লাগবে এই শীতের পড়ন্ত বেলায় কুয়াশা মাথায় করে ফিরতে পেলে বেশ হত। কিন্তু কোথা থেকে কোথায় ফিরবে ঠাহর করতে পারবে না। সন্ধ্যা নেমে যাবে। তুমি ঘরে আসতে চাইবে, আবার বেরিয়ে যেতে চাইবে, কিছু একটা করতে চাইবে আবার কিচ্ছুটা করতে ইচ্ছা হবে না। অনেক কিছুকে তুমি ধরতে ছুঁতে পেতে বুঝতে বা দেখতে চাইবে, যার রহস্য কেবল তুমিই জানো। কিন্তু সেই সবগুলো কিছুই মুঠিতে ধরা পানির মত আঙ্গুলের ফাঁক গলে হারিয়ে যাবে। তোমার একটু দুঃখ দুঃখ লাগবে। শীতের অলস বিকাল বড়ই লক্ষ্মীছাড়া, কিন্তু তুমি অস্বীকারও করবে না যে চাপা একটা কষ্ট দেয় বলেই তুমি তাকে ভালবাস।
Saturday, November 21, 2009
ইচ্ছেগুলো বদলায় না
চাঁদটা বদলে যায় না। গায়ে চিড়িক বিড়িক কালচে দাগ নিয়ে সবাইকে নিশির ডাকের মত করে টেনেই যায়। কখনো বিরাট গোল থালা হয়ে পড়ে। আবার কখনো আধখানি মুখ ঢাকে ছাইরঙা ওড়নায়।
আকাশও ঘুরে ফিরে নীলেরই নানান রূপ ধরে রাখে। সাদা মেঘগুলো দেখলে মনে হয় তুলাগাছের লক্ষ লক্ষ শুকনো ফল ফেটে ছড়িয়ে গেছে আদিগন্ত। আর কালো মেঘগুলো যেন পিচকিরি দিয়ে ছিটানো রংতুলি ধোয়া জল।
হলদে সূর্যটার তো কোনকালেই কিছু হয় না। গনগনে চুল্লির মত আঁচ ছাড়তেই থাকে ছাড়তেই থাকে। মাঝে মাঝে দুঃখ পেলে চোখ বুঁজে ফেলে, তাও একটুক্ষণের জন্য।
বৃষ্টি পাল্টায় না। ঝিরঝির নাহয় ঝমঝম নাহয় টুপটাপ। মন চাইলে যাবার কালে রংধনুটাকে এনে সেঁটে দেয়। সেই চেনা সাতটা রংই সারি দিয়ে বসে।
মানুষই নাকি কেবল বদলায়। ক্ষণেই ক্ষণেই নাকি বদলায়। এতই যদি বদলায় তাহলে দিনে দিনে ইচ্ছেগুলো কেন বদলে যায় না? বেঁচেই থাকে কেবল।
অনেক বছর আগের যেমনটা হত, বিকেল হলেই ছুটে যেতে ইচ্ছে হয় খেলার মাঠে। পাগলা ঝড়ে শিল কুড়াতে ইচ্ছে হয় তেমনই।
লাল রঙের জামা আর লাল মালা পরে পরী হয়ে ঘুরতে ইচ্ছে হয় ছোটবেলার মত। প্রিয় কোন কিছু কাউকে একটুও ধরতে দিতে ভাল লাগে না। ইচ্ছে করে সবাই অনেক কিছু উপহার দিক যেভাবে দিত।
তখনকার মত এখনও ইচ্ছে হয় একটা টাকার গাছ থাকুক। যখন যে চায় যেন অনেক অনেক দিতে পারি। আমার বা কারোরই কোন অভাব থাকবে না এমন ইচ্ছে হয়।
একটু অসুখ করলেই গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে ইচ্ছে হয়, ইচ্ছে হয় মা রাতভর বসে পাখা করুক আর কান্না শুনুক। দাঁত চেপে শুয়ে থাকতে ভালই লাগে না।
আগুপিছু না ভেবে দুম করে অনেক কিছু বলে ফেলতে পারার ইচ্ছে হয়। লোকলজ্জা বা দ্বিধাকে ছুঁড়ে ফেলতে এখনও ইচ্ছে হয়। চাইতেই কেউ চোখের পলকে ফুল পাখি তারা এনে দিক সত্যিই এমনও ইচ্ছে হয়।
অনুচিত জেনেও বার বার কিছু ভুল কিছু অন্যায় করতে প্রচণ্ড ইচ্ছে হয়। কষ্ট দেয়ার বা কষ্ট পাওয়ার লোভটাও মরে যায় না। ইচ্ছে হয় ইচ্ছে হয়।
ইচ্ছেগুলো একটুও উলটে পালটে যায় না। চাঁদ আকাশ সূর্য কিংবা বৃষ্টির মত ধ্রুব হয়ে জড়িয়েই থাকে।
আকাশও ঘুরে ফিরে নীলেরই নানান রূপ ধরে রাখে। সাদা মেঘগুলো দেখলে মনে হয় তুলাগাছের লক্ষ লক্ষ শুকনো ফল ফেটে ছড়িয়ে গেছে আদিগন্ত। আর কালো মেঘগুলো যেন পিচকিরি দিয়ে ছিটানো রংতুলি ধোয়া জল।
হলদে সূর্যটার তো কোনকালেই কিছু হয় না। গনগনে চুল্লির মত আঁচ ছাড়তেই থাকে ছাড়তেই থাকে। মাঝে মাঝে দুঃখ পেলে চোখ বুঁজে ফেলে, তাও একটুক্ষণের জন্য।
বৃষ্টি পাল্টায় না। ঝিরঝির নাহয় ঝমঝম নাহয় টুপটাপ। মন চাইলে যাবার কালে রংধনুটাকে এনে সেঁটে দেয়। সেই চেনা সাতটা রংই সারি দিয়ে বসে।
মানুষই নাকি কেবল বদলায়। ক্ষণেই ক্ষণেই নাকি বদলায়। এতই যদি বদলায় তাহলে দিনে দিনে ইচ্ছেগুলো কেন বদলে যায় না? বেঁচেই থাকে কেবল।
অনেক বছর আগের যেমনটা হত, বিকেল হলেই ছুটে যেতে ইচ্ছে হয় খেলার মাঠে। পাগলা ঝড়ে শিল কুড়াতে ইচ্ছে হয় তেমনই।
লাল রঙের জামা আর লাল মালা পরে পরী হয়ে ঘুরতে ইচ্ছে হয় ছোটবেলার মত। প্রিয় কোন কিছু কাউকে একটুও ধরতে দিতে ভাল লাগে না। ইচ্ছে করে সবাই অনেক কিছু উপহার দিক যেভাবে দিত।
তখনকার মত এখনও ইচ্ছে হয় একটা টাকার গাছ থাকুক। যখন যে চায় যেন অনেক অনেক দিতে পারি। আমার বা কারোরই কোন অভাব থাকবে না এমন ইচ্ছে হয়।
একটু অসুখ করলেই গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে ইচ্ছে হয়, ইচ্ছে হয় মা রাতভর বসে পাখা করুক আর কান্না শুনুক। দাঁত চেপে শুয়ে থাকতে ভালই লাগে না।
আগুপিছু না ভেবে দুম করে অনেক কিছু বলে ফেলতে পারার ইচ্ছে হয়। লোকলজ্জা বা দ্বিধাকে ছুঁড়ে ফেলতে এখনও ইচ্ছে হয়। চাইতেই কেউ চোখের পলকে ফুল পাখি তারা এনে দিক সত্যিই এমনও ইচ্ছে হয়।
অনুচিত জেনেও বার বার কিছু ভুল কিছু অন্যায় করতে প্রচণ্ড ইচ্ছে হয়। কষ্ট দেয়ার বা কষ্ট পাওয়ার লোভটাও মরে যায় না। ইচ্ছে হয় ইচ্ছে হয়।
ইচ্ছেগুলো একটুও উলটে পালটে যায় না। চাঁদ আকাশ সূর্য কিংবা বৃষ্টির মত ধ্রুব হয়ে জড়িয়েই থাকে।
Thursday, November 12, 2009
বে-কা-র!
আগে নাটকে দেখতাম চাকরি না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত বেকার যুবক তার সার্টিফিকেটকে নৌকা বানিয়ে রাস্তার জমে থাকা জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে নাকি জুতার সুকতলি ক্ষয় হয়ে যায় যুবকের। হাতে যাবতীয় দলিলপত্রাদি নিয়ে তারা অফিস থেকে অফিসে ধরনা দেয় আর কাঁচঘেরা দরজাগুলোর গায়ে লেখা থাকে "no vacancy". যুবক মাথা নিচু করে ফিরে যায়।
বেকার যুবকের গালে থাকে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হাই তুলতে তুলতে সে বেলা বারোটায় ঘুম থেকে উঠে। সারাজীবন ন্যায়ের পথে চলা মধ্যবিত্ত বাবা হাঁক দেন, "লাটসাহেবের আজ এত ভোরে ঘুম ভাঙলো যে?" সে সারাদিন পথে পথে ঘুরে, আড্ডাবাজি করে, রাত করে বাড়ি ফিরে ঠাণ্ডা ভাত খেয়ে সিগারেট টানতে টানতে বুকের কষ্ট বুকে চেপে আরেকটা দিনের অপেক্ষা করে।
বেকার যুবক প্রেমিকা হারানোর ঝুঁকিতে থাকে কারণ প্রেমিকার বাবা মেয়েকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগেন। বেকারকে কেউ সম্মান করে কথা বলে না। পাড়ার চাচারা অপদার্থ ভাবেন, চাকরি করা বন্ধুবান্ধবরা ধারের ভয়ে এড়িয়ে চলে, বড় ভাই বড় ভাবী থাকলে তারা নানারকম কথা শোনায়।
ইত্যাদি হল স্কুল আমলে বইপুস্তক আর নাটকের কল্যাণে গড়ে উঠা বেকার যুবকের ভাবমূর্তি। বেকারত্বের গ্লানি বলে একটা কথাও আছে। বেকার তকমাটা ছেলেদের গায়ে সেঁটে দেয়া হয়েছে। একটা মেয়ে একই সমান পড়াশোনা করে কাজ না পেলে তাকে সচরাচর কেউ বেকার বলে না মনে হয়। একটা সুবিধা আছে দেখি মেয়ে হওয়ার। কিন্তু আদপে সুবিধা কই? কম হোক বেশি হোক নিজের টাকা পয়সা কার না দরকার? কিন্তু বেকার শব্দটা আমার পছন্দ না। বেকার ছেলে নাকি পরিবারের বোঝা। এমন একটা ভাব, যেন সে যেচে পড়ে বেকার হয়েছে। শব্দটা শুনতেই তো ভাল না। নিজে নিজেকে বলা যায়। অন্যরা কেন বলবে? 'বেকারত্বের অভিশাপ' বললেই মনে হয় যেন অপরাধী।
আমার এত সহানুভূতির কারণ হল আমি কোন স্কুল কলেজ অফিস আদালতে কিছু করি না। ঘরে বসে মাছি মারি। পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুই মাসের বেশি। বয়স তো কম হল না। দেখতে শুনতে সেটা ভালই বোঝা যায়। তাই কেউ এখন আর কি পড়ি বা কোথায় পড়ি জিজ্ঞেস করে না, জিজ্ঞেস করে কি করি। আমাকে তখন শেষ হয়ে যাওয়া পরীক্ষাটার রেশ টানতে হয়। কি করি তার উত্তর হয় কবে কি করেছিলাম সেটা। তখন আবার কেউ কেউ বলে কি করার প্ল্যান। আহা যেন আমি প্ল্যান নিয়ে বসে আছি, টেন্ডার নোটিশ দেয়া আছে, প্রপোজাল এল বলে। কিংবা প্রশ্ন থাকে কি করার ইচ্ছা। বলতে মন চায় আমার ইচ্ছা সারাদিন আরাম করব। ঘুমাব বই পড়ব ফেসবুক আর সামুতে ঘুরব এবং এসবের জন্য মাস শেষে 'lucrative amount' ব্যাগে ভরব। কিন্তু সেই কথা বলি না। মামা চাচারা এসব বুঝবে না। বুঝলেও বলা যায় না। তাদেরকে তাই বলতে হয় কোন কোন ধরণের কর্পোরেট অফিস অথবা প্রাইভেট ব্যাংক অথবা ইউনিভার্সিটিতে 'try' করি বা করব। তাদের উপদেশ হল, বিসিএস দাও সম্মানের চাকরি কর। পুলিশে ঢুকো। মহিলা পুলিশদের অনেক দাম। আমি মাথা নাড়তে নাড়তে ভাব করি যেন খুব দামী একটা কথা শুনলাম। বিসিএস তো হাতের মোয়া। জিকে নাই কিছু নাই উনিশ বিশ জ্ঞান নাই আমি পারব বিসিএস! আবার বলে পুলিশ। যাই হোক সেটা কথা না। কথা হচ্ছে আমার কাজ করতে ইচ্ছা করে না। আবার কর্মহীন থাকতেও ভাল লাগে না। আস্ত একটা মানুষ আমি, বেলা বারোটায় আমাকে বাসায় পাওয়া যায়। কেউ ফোন করে কোথায় আছি জানতে চাইলে বাসায় বলতে শান্তি লাগে না। সাধ জাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলি আমি তো অফিসে, একটু বিজি আছি। বন্ধুরা অনেকেই ভালমন্দ চাকরি পেয়ে গেছে। কারো নতুন চাকরি পাওয়ার খবর শুনলে খুশি হবার আগে বুকে দুঃখের শেল বিঁধে। মনে মনে বলি, ওরে তুইও আমারে ছাইড়া গেলি রে?
আব্বাজানের একটা আশ্বাস আছে। যদি হায়াত খুব বেশি না নিয়ে এসে থাকি তাহলে বাকি জীবন হালকার উপর ঝাপসা খেয়ে পরে কাটানোর মত টাকা পয়সা দিতে পারবেন তিনি। কিন্তু কাজের বেলায় কিছু না। পঞ্চাশটা টাকার জন্য কৈফিয়ত দিতে লাগে একশটা। রিকশাভাড়া দেয়ার জন্য আজকাল ব্যাগ হাতড়ানোর পরও কিছু মিলতে চায় না। টুটাফাটা যেই টিউশানিটা ছিল, বাচ্চাকাচ্চার পরীক্ষা শেষ হবে কয়দিন পরে, আমার সাপ্লাই হবে পুরাপুরি বন্ধ। আর আমি যে চাকরি খুঁজব, পারিটা কি? ভাল করে চিন্তা করলে দেখি দিনে দিনে বয়স বাড়লেও কাজের কাজ কিছুই আসলে পারি না। অফিসে মানুষ ফাইলের মধ্যে কি কি সব লিখে, আবার দাগ দেয়, কম্পিউটারে ফটফট কি কি যেন টাইপ করে, এগুলি আমি কোনদিন পারব মনে হয় না। আবার সার্কুলার এর মধ্যে কত কি চায়। আমার শুধু কয়েকটা সার্টিফিকেট আছে, কিছু শিখি নাই।
আমি বর্তমানে একজন বেকার যুবমহিলা।
বেকার যুবকের গালে থাকে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হাই তুলতে তুলতে সে বেলা বারোটায় ঘুম থেকে উঠে। সারাজীবন ন্যায়ের পথে চলা মধ্যবিত্ত বাবা হাঁক দেন, "লাটসাহেবের আজ এত ভোরে ঘুম ভাঙলো যে?" সে সারাদিন পথে পথে ঘুরে, আড্ডাবাজি করে, রাত করে বাড়ি ফিরে ঠাণ্ডা ভাত খেয়ে সিগারেট টানতে টানতে বুকের কষ্ট বুকে চেপে আরেকটা দিনের অপেক্ষা করে।
বেকার যুবক প্রেমিকা হারানোর ঝুঁকিতে থাকে কারণ প্রেমিকার বাবা মেয়েকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগেন। বেকারকে কেউ সম্মান করে কথা বলে না। পাড়ার চাচারা অপদার্থ ভাবেন, চাকরি করা বন্ধুবান্ধবরা ধারের ভয়ে এড়িয়ে চলে, বড় ভাই বড় ভাবী থাকলে তারা নানারকম কথা শোনায়।
ইত্যাদি হল স্কুল আমলে বইপুস্তক আর নাটকের কল্যাণে গড়ে উঠা বেকার যুবকের ভাবমূর্তি। বেকারত্বের গ্লানি বলে একটা কথাও আছে। বেকার তকমাটা ছেলেদের গায়ে সেঁটে দেয়া হয়েছে। একটা মেয়ে একই সমান পড়াশোনা করে কাজ না পেলে তাকে সচরাচর কেউ বেকার বলে না মনে হয়। একটা সুবিধা আছে দেখি মেয়ে হওয়ার। কিন্তু আদপে সুবিধা কই? কম হোক বেশি হোক নিজের টাকা পয়সা কার না দরকার? কিন্তু বেকার শব্দটা আমার পছন্দ না। বেকার ছেলে নাকি পরিবারের বোঝা। এমন একটা ভাব, যেন সে যেচে পড়ে বেকার হয়েছে। শব্দটা শুনতেই তো ভাল না। নিজে নিজেকে বলা যায়। অন্যরা কেন বলবে? 'বেকারত্বের অভিশাপ' বললেই মনে হয় যেন অপরাধী।
আমার এত সহানুভূতির কারণ হল আমি কোন স্কুল কলেজ অফিস আদালতে কিছু করি না। ঘরে বসে মাছি মারি। পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুই মাসের বেশি। বয়স তো কম হল না। দেখতে শুনতে সেটা ভালই বোঝা যায়। তাই কেউ এখন আর কি পড়ি বা কোথায় পড়ি জিজ্ঞেস করে না, জিজ্ঞেস করে কি করি। আমাকে তখন শেষ হয়ে যাওয়া পরীক্ষাটার রেশ টানতে হয়। কি করি তার উত্তর হয় কবে কি করেছিলাম সেটা। তখন আবার কেউ কেউ বলে কি করার প্ল্যান। আহা যেন আমি প্ল্যান নিয়ে বসে আছি, টেন্ডার নোটিশ দেয়া আছে, প্রপোজাল এল বলে। কিংবা প্রশ্ন থাকে কি করার ইচ্ছা। বলতে মন চায় আমার ইচ্ছা সারাদিন আরাম করব। ঘুমাব বই পড়ব ফেসবুক আর সামুতে ঘুরব এবং এসবের জন্য মাস শেষে 'lucrative amount' ব্যাগে ভরব। কিন্তু সেই কথা বলি না। মামা চাচারা এসব বুঝবে না। বুঝলেও বলা যায় না। তাদেরকে তাই বলতে হয় কোন কোন ধরণের কর্পোরেট অফিস অথবা প্রাইভেট ব্যাংক অথবা ইউনিভার্সিটিতে 'try' করি বা করব। তাদের উপদেশ হল, বিসিএস দাও সম্মানের চাকরি কর। পুলিশে ঢুকো। মহিলা পুলিশদের অনেক দাম। আমি মাথা নাড়তে নাড়তে ভাব করি যেন খুব দামী একটা কথা শুনলাম। বিসিএস তো হাতের মোয়া। জিকে নাই কিছু নাই উনিশ বিশ জ্ঞান নাই আমি পারব বিসিএস! আবার বলে পুলিশ। যাই হোক সেটা কথা না। কথা হচ্ছে আমার কাজ করতে ইচ্ছা করে না। আবার কর্মহীন থাকতেও ভাল লাগে না। আস্ত একটা মানুষ আমি, বেলা বারোটায় আমাকে বাসায় পাওয়া যায়। কেউ ফোন করে কোথায় আছি জানতে চাইলে বাসায় বলতে শান্তি লাগে না। সাধ জাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলি আমি তো অফিসে, একটু বিজি আছি। বন্ধুরা অনেকেই ভালমন্দ চাকরি পেয়ে গেছে। কারো নতুন চাকরি পাওয়ার খবর শুনলে খুশি হবার আগে বুকে দুঃখের শেল বিঁধে। মনে মনে বলি, ওরে তুইও আমারে ছাইড়া গেলি রে?
আব্বাজানের একটা আশ্বাস আছে। যদি হায়াত খুব বেশি না নিয়ে এসে থাকি তাহলে বাকি জীবন হালকার উপর ঝাপসা খেয়ে পরে কাটানোর মত টাকা পয়সা দিতে পারবেন তিনি। কিন্তু কাজের বেলায় কিছু না। পঞ্চাশটা টাকার জন্য কৈফিয়ত দিতে লাগে একশটা। রিকশাভাড়া দেয়ার জন্য আজকাল ব্যাগ হাতড়ানোর পরও কিছু মিলতে চায় না। টুটাফাটা যেই টিউশানিটা ছিল, বাচ্চাকাচ্চার পরীক্ষা শেষ হবে কয়দিন পরে, আমার সাপ্লাই হবে পুরাপুরি বন্ধ। আর আমি যে চাকরি খুঁজব, পারিটা কি? ভাল করে চিন্তা করলে দেখি দিনে দিনে বয়স বাড়লেও কাজের কাজ কিছুই আসলে পারি না। অফিসে মানুষ ফাইলের মধ্যে কি কি সব লিখে, আবার দাগ দেয়, কম্পিউটারে ফটফট কি কি যেন টাইপ করে, এগুলি আমি কোনদিন পারব মনে হয় না। আবার সার্কুলার এর মধ্যে কত কি চায়। আমার শুধু কয়েকটা সার্টিফিকেট আছে, কিছু শিখি নাই।
আমি বর্তমানে একজন বেকার যুবমহিলা।
Friday, October 30, 2009
তিনা কে...
প্রিয় তিনা,
জানি অবাক হয়ে যাচ্ছিস আমি চিঠি লিখছি দেখে। প্রায় রোজ যার সাথে দেখা হয়, ফোনে এত কথা হয় সে আবার চিঠি লিখতে বসল কেন তাই ভাবছিস হয়ত। কিংবা মনে করেছিস আমি কিছু একটা মুখে বলতে পারছিনা বলে লিখছি। সে তুই যাই ভেবে নে তোর খুশি। আমি এত সাত পাঁচ চিন্তা করে লিখতে বসিনি। আসলে খুব একা লাগলে তোর কথা এত মনে আসে! তুই ছাড়া আমাকে আর কে এতখানি বুঝতে পারে বল!
ওহো! কেমন আছিস তাই তো জিজ্ঞেস করা হল না। খুব যে জবাব জানার জন্য করছি তা না। এমনি করা। আজো আমার নতুন অর্কিডটা দেখতে আসা হল না তোর। সময় তোর হয়ই না। ইস আমরা কত ব্যস্ত হয়ে গেছি না রে? বড় হয়ে গেছি আমরা। এই তো সেদিন যে বয়সের রজতজয়ন্তীটা পার করে দিলাম তাও তো একবছর হতে চলল। কি করে এতগুলো দিন পার হয়ে গেল বল তো? এই সেদিন না বেণী দুলিয়ে স্কুলে যেতাম? আমাদের প্রথম স্কুলে তোকে যে সবাই হুতুম প্যাঁচা ডাকত আমার কি মনে নেই? চোখ পাকাচ্ছিস নাকি? কাউকে বলব না তো!
জানিস আজকাল এত নিয়তিবাদী আর অতীতবাদী হয়ে গেছি আমি! ফেলে আসা সবগুলো দিন মনে পড়ে আর প্রত্যেকটা মুহূর্তে মনে হয় আমার ভাগ্য যেন পালটে যাচ্ছে। আজ থেকে পাঁচটা বা দশটা বছর পর আমি বেঁচে আছি কিনা, থাকলে ঠিক কি করছি তা যে আমি জানি না বা একটুও ভাবতে পারি না এটাও একটা উত্তেজনা এনে দেয় কখনো কখনো। তিনা তোর কি রিজভীর কথা মনে আছে? সেই শান্ত লাজুক ছেলেটা এখন একেবারে কর্পোরেট হয়ে গেছে। সেদিন মার্কেটে দেখা। পাশ থেকে হাসিমুখে বলে, “আরে মিলি না? আমি রিজভী, চিনতে পেরেছ?” আমি চিনব না? আমার স্মৃতিশক্তি যে ভাল এটা তো তোরাই বলিস। দারুণ হয়েছে দেখতে এখন ও। আচ্ছা তিনা সেই যে বৃষ্টির দুপুরে রিজভী ঠাণ্ডায় নাকি আর কিছুতে কাঁপতে কাঁপতে বলেছিল, “মিলি তোমার সাথে কিছু কথা আছে, একটু শুনবে?” তোরা তো ঠিকই বুঝতে পেরেছিলি ও কি বলতে চায়। শুধু তোরা? আমিও কি বুঝতে পারিনি? সেদিন যদি আমি ওর কথাগুলো শুনতাম, ওর বাড়ানো হাতটা যদি ধরতাম তাহলে এখন কি তোকে ঠিক এই চিঠিটাই লিখতাম?
এ্যাই দরকারী একটা কথা, জলদি মাথায় টুকে নে। তুই যে চাকরি পাবার পর খাওয়াবি বলেছিলি, কোথায় সেটা? তোদের লজ্জা লাগে না রে তিনা? খুব তো চখাচখি একসাথে চাকরি পেয়ে গেলি, নিজেরাই পেটপূজা করে বেড়াচ্ছিস। আমি খেতে চাইলে শুধু আমার ওজন নিয়ে খোঁটা দিস। এভাবে করে পার পাবি ভাবিস তুই? আর তোর বাবুসাহেবকে বলিস, কতবার আন্টির চোখ ফাঁকি দিয়ে ওর মেসেজ তোর কাছে চালান করেছি যেন গুণে নেয়। বাব্বাহ তোরা একেকটা কি অকৃতজ্ঞ রে!
কিছু করার পাচ্ছি না, তাই নেটে বসে এটা সেটা দেখছি। পাশের ঘরে ছোটখালা আর আব্বা আম্মা খেতে বসেছে। গুটগাট গল্পও চলছে। আমি কি করেছি জানিস? কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান বাজিয়ে দিয়েছি, যেন ওদের কোন আলোচনা আমার কানে না আসে। কে জানে যদি ওই লম্বুকে নিয়ে কথা বলে? তোদের তো আবার লম্বুকে অনেক পছন্দ। রাজি হয়ে যা মিলু, কি হ্যান্ডসাম, কত সেন্সিবল। উফ তোরা পারিসও। অসহ্য! লম্বুজী আবার সেদিন ফোন করে আমার খোঁজ নেয়। “কেমন আছ মিলি? ইস তোমার ফোনে সমস্যা নাকি? পেতে এতক্ষণ লাগল!” আমিও খুব মিষ্টি করে খুশিমুখে সব কথার জবাব দিয়েছি। অথচ মনে মনে বলছিলাম, “খবরদার! একদম চুপ! আমার নাম্বার কে দিল?” লম্বুকে কি আমি না করে দিব রে তিনা? কেন? সত্যিই যদি না জানিস তো পরে বলব।
আম্মা আমাকে খুব বকে। আমি নাকি একা থাকি। আমি নাকি কথাবার্তা একদম বলি না। আচ্ছা কি কথা বলব আমি বল তো? আমি কি উচ্ছ্বল কিশোরী নাকি যে আমার একগাদা কথা থাকবে? সেজ মামা বললেন কোন কাজ করার নেই দেখেই নাকি আমি চুপচাপ হয়ে থাকি, একটা চাকরি পেলেই ভাল লাগবে। হুঁম খারাপ বলেননি। আসলেই চাকরি দরকার। বাসার কাউকে একদম ভাল লাগে না জানিস? বাবা মা মিহির কাউকে না। মনে হয় সবাই আমাকে জ্বালায়। কেউ যদি একটা কথা বলতে আসে তাতেই আমি বিরক্ত হয়ে যাই। খুব ইচ্ছা করে দূরে কোথাও চলে যাই সব ছেড়েছুড়ে। অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও। তাও কি পারব? আমি তো মেয়ে। বাড়িতে কেউ কোনদিন আমাকে মিহিরের চেয়ে কম কিছু ভাবেনি, ও যা যা পেয়েছে আমিও তাই পেয়েছি, খেলাধুলা পড়াশোনা গানবাজনা সবকিছুর সুযোগ ওর মত করেই ছিল আমার সবসময়। কিন্তু তারপরও একটা মেয়েকে একসময় একটা মেয়েই হয়ে যেতে হয়। তোর একটা কথা আমি মানতাম না কখনো, এখন বুঝি সত্যি কথাই বলিস তুই, ছেলেগুলো ঠিক কেমন কেমন করে যেন ভাল থেকে ফেলে। সব গুছিয়ে ফেলে নিজের মত করে। সততা, নৈতিকতা, অকপটতা এসবের ভক্ত হয়ে পড়ে, কারণ “অনেক হয়েছে, জীবন নিয়ে তো এক্সপেরিমেন্ট চলে না।”
নাহয় আজ তপনদা ভাল থাকত? তুই কি ভুলতে পারবি বীণাদিদি আর তপনদার সাত বছরের ভালবাসার কথা? শুধু একটা দামী চাকরির জন্য তপনদা কেমন করে সব শেষ করে দিয়ে চলে গেল! ঠিকই পুতুলের মত একটা মেয়ে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসার করতে করতে এখন হিল্লি দিল্লি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ এই ভালটা বীণাদিদি থাকতে পারল না। তপনদা জীবনে যেন খুব জিতে গেল। ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটা যদি নকল করে ফার্স্ট হয়ে যায় আর সেই রেজাল্টটাই যদি সবার কাছে সত্যি হয় তাহলে কেমন লাগে ভাব তো তিনা! মাথা কাজ করে না কেন? সবকিছু ঠিকঠাক মত চলে না কেন বল দেখি। তুই তোর সব কোমলতা নিয়েও চোরাপাঁকে বারবার আটকা পড়ে যাবি, আমি চারদিকে আলো ভেবে আলেয়া দেখব এমন কেন হবে? তোর মত আমারও ভাল না লাগা রোগটা বেড়ে চলেছে।
কেমন একটা শূণ্য শূণ্য লাগে জানিস? ঠিক জানি না কেন। জানলেও হয়ত না জানার ভান করব। আমার সব বন্ধুকে একটা প্রশ্ন করি আমি, চোখের পানি উষ্ণ হয় বলে কি তার থেকে বাষ্প উড়তে থাকে? সবাই বলে, না এমন হয় না। আসলে তোরা কেউ তো আমার মত সারাদিন মোটা ফ্রেমের চশমা ঝুলিয়ে রাখিস না, ঘোলা কাঁচ তোরা চিনবি কি করে? অস্থিরতা চেপে আছে। মাঝে মাঝে খাটে শুয়ে নাটকের নায়িকাদের মত খাটের পাশের টেবিল ল্যাম্পটা একবার জ্বালাই একবার নিভাই, আবার জ্বালাই আবার নিভাই। যেন এটা একটা কাজ হল। যেন এভাবে করে খুব দিন কাটানো যায়। সুইচ এর উপর হাতটা চালু রাখলাম। যতক্ষণ শক্তি আছে অফ অন করতেই থাকলাম। একবার আলো একবার আঁধার আবার আলো আবার আঁধার। একসময় হয়ত ঘুম নেমে আসবে। ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগটায় কোন অবস্থাটার সৃষ্টি হবে, আলো না আঁধার, সেটাই একটা খেলা। অবশ্য তখন তো আমার চোখই বন্ধ। চোখ বন্ধ করে রাখা মানুষ কি আলো আর আঁধারের পার্থক্য একটুও বুঝতে পারে?
আজ আর লিখতে ইচ্ছা করছে না রে। রাখি। কথা হবে। ভাল থাকিস। আন্টিকে বলিস আমাকে না বকতে, শীগগিরই একদিন আসব, প্রমিজ।
ইতি তোর বোকা বন্ধু,
মিলু।
জানি অবাক হয়ে যাচ্ছিস আমি চিঠি লিখছি দেখে। প্রায় রোজ যার সাথে দেখা হয়, ফোনে এত কথা হয় সে আবার চিঠি লিখতে বসল কেন তাই ভাবছিস হয়ত। কিংবা মনে করেছিস আমি কিছু একটা মুখে বলতে পারছিনা বলে লিখছি। সে তুই যাই ভেবে নে তোর খুশি। আমি এত সাত পাঁচ চিন্তা করে লিখতে বসিনি। আসলে খুব একা লাগলে তোর কথা এত মনে আসে! তুই ছাড়া আমাকে আর কে এতখানি বুঝতে পারে বল!
ওহো! কেমন আছিস তাই তো জিজ্ঞেস করা হল না। খুব যে জবাব জানার জন্য করছি তা না। এমনি করা। আজো আমার নতুন অর্কিডটা দেখতে আসা হল না তোর। সময় তোর হয়ই না। ইস আমরা কত ব্যস্ত হয়ে গেছি না রে? বড় হয়ে গেছি আমরা। এই তো সেদিন যে বয়সের রজতজয়ন্তীটা পার করে দিলাম তাও তো একবছর হতে চলল। কি করে এতগুলো দিন পার হয়ে গেল বল তো? এই সেদিন না বেণী দুলিয়ে স্কুলে যেতাম? আমাদের প্রথম স্কুলে তোকে যে সবাই হুতুম প্যাঁচা ডাকত আমার কি মনে নেই? চোখ পাকাচ্ছিস নাকি? কাউকে বলব না তো!
জানিস আজকাল এত নিয়তিবাদী আর অতীতবাদী হয়ে গেছি আমি! ফেলে আসা সবগুলো দিন মনে পড়ে আর প্রত্যেকটা মুহূর্তে মনে হয় আমার ভাগ্য যেন পালটে যাচ্ছে। আজ থেকে পাঁচটা বা দশটা বছর পর আমি বেঁচে আছি কিনা, থাকলে ঠিক কি করছি তা যে আমি জানি না বা একটুও ভাবতে পারি না এটাও একটা উত্তেজনা এনে দেয় কখনো কখনো। তিনা তোর কি রিজভীর কথা মনে আছে? সেই শান্ত লাজুক ছেলেটা এখন একেবারে কর্পোরেট হয়ে গেছে। সেদিন মার্কেটে দেখা। পাশ থেকে হাসিমুখে বলে, “আরে মিলি না? আমি রিজভী, চিনতে পেরেছ?” আমি চিনব না? আমার স্মৃতিশক্তি যে ভাল এটা তো তোরাই বলিস। দারুণ হয়েছে দেখতে এখন ও। আচ্ছা তিনা সেই যে বৃষ্টির দুপুরে রিজভী ঠাণ্ডায় নাকি আর কিছুতে কাঁপতে কাঁপতে বলেছিল, “মিলি তোমার সাথে কিছু কথা আছে, একটু শুনবে?” তোরা তো ঠিকই বুঝতে পেরেছিলি ও কি বলতে চায়। শুধু তোরা? আমিও কি বুঝতে পারিনি? সেদিন যদি আমি ওর কথাগুলো শুনতাম, ওর বাড়ানো হাতটা যদি ধরতাম তাহলে এখন কি তোকে ঠিক এই চিঠিটাই লিখতাম?
এ্যাই দরকারী একটা কথা, জলদি মাথায় টুকে নে। তুই যে চাকরি পাবার পর খাওয়াবি বলেছিলি, কোথায় সেটা? তোদের লজ্জা লাগে না রে তিনা? খুব তো চখাচখি একসাথে চাকরি পেয়ে গেলি, নিজেরাই পেটপূজা করে বেড়াচ্ছিস। আমি খেতে চাইলে শুধু আমার ওজন নিয়ে খোঁটা দিস। এভাবে করে পার পাবি ভাবিস তুই? আর তোর বাবুসাহেবকে বলিস, কতবার আন্টির চোখ ফাঁকি দিয়ে ওর মেসেজ তোর কাছে চালান করেছি যেন গুণে নেয়। বাব্বাহ তোরা একেকটা কি অকৃতজ্ঞ রে!
কিছু করার পাচ্ছি না, তাই নেটে বসে এটা সেটা দেখছি। পাশের ঘরে ছোটখালা আর আব্বা আম্মা খেতে বসেছে। গুটগাট গল্পও চলছে। আমি কি করেছি জানিস? কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান বাজিয়ে দিয়েছি, যেন ওদের কোন আলোচনা আমার কানে না আসে। কে জানে যদি ওই লম্বুকে নিয়ে কথা বলে? তোদের তো আবার লম্বুকে অনেক পছন্দ। রাজি হয়ে যা মিলু, কি হ্যান্ডসাম, কত সেন্সিবল। উফ তোরা পারিসও। অসহ্য! লম্বুজী আবার সেদিন ফোন করে আমার খোঁজ নেয়। “কেমন আছ মিলি? ইস তোমার ফোনে সমস্যা নাকি? পেতে এতক্ষণ লাগল!” আমিও খুব মিষ্টি করে খুশিমুখে সব কথার জবাব দিয়েছি। অথচ মনে মনে বলছিলাম, “খবরদার! একদম চুপ! আমার নাম্বার কে দিল?” লম্বুকে কি আমি না করে দিব রে তিনা? কেন? সত্যিই যদি না জানিস তো পরে বলব।
আম্মা আমাকে খুব বকে। আমি নাকি একা থাকি। আমি নাকি কথাবার্তা একদম বলি না। আচ্ছা কি কথা বলব আমি বল তো? আমি কি উচ্ছ্বল কিশোরী নাকি যে আমার একগাদা কথা থাকবে? সেজ মামা বললেন কোন কাজ করার নেই দেখেই নাকি আমি চুপচাপ হয়ে থাকি, একটা চাকরি পেলেই ভাল লাগবে। হুঁম খারাপ বলেননি। আসলেই চাকরি দরকার। বাসার কাউকে একদম ভাল লাগে না জানিস? বাবা মা মিহির কাউকে না। মনে হয় সবাই আমাকে জ্বালায়। কেউ যদি একটা কথা বলতে আসে তাতেই আমি বিরক্ত হয়ে যাই। খুব ইচ্ছা করে দূরে কোথাও চলে যাই সব ছেড়েছুড়ে। অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও। তাও কি পারব? আমি তো মেয়ে। বাড়িতে কেউ কোনদিন আমাকে মিহিরের চেয়ে কম কিছু ভাবেনি, ও যা যা পেয়েছে আমিও তাই পেয়েছি, খেলাধুলা পড়াশোনা গানবাজনা সবকিছুর সুযোগ ওর মত করেই ছিল আমার সবসময়। কিন্তু তারপরও একটা মেয়েকে একসময় একটা মেয়েই হয়ে যেতে হয়। তোর একটা কথা আমি মানতাম না কখনো, এখন বুঝি সত্যি কথাই বলিস তুই, ছেলেগুলো ঠিক কেমন কেমন করে যেন ভাল থেকে ফেলে। সব গুছিয়ে ফেলে নিজের মত করে। সততা, নৈতিকতা, অকপটতা এসবের ভক্ত হয়ে পড়ে, কারণ “অনেক হয়েছে, জীবন নিয়ে তো এক্সপেরিমেন্ট চলে না।”
নাহয় আজ তপনদা ভাল থাকত? তুই কি ভুলতে পারবি বীণাদিদি আর তপনদার সাত বছরের ভালবাসার কথা? শুধু একটা দামী চাকরির জন্য তপনদা কেমন করে সব শেষ করে দিয়ে চলে গেল! ঠিকই পুতুলের মত একটা মেয়ে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসার করতে করতে এখন হিল্লি দিল্লি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ এই ভালটা বীণাদিদি থাকতে পারল না। তপনদা জীবনে যেন খুব জিতে গেল। ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটা যদি নকল করে ফার্স্ট হয়ে যায় আর সেই রেজাল্টটাই যদি সবার কাছে সত্যি হয় তাহলে কেমন লাগে ভাব তো তিনা! মাথা কাজ করে না কেন? সবকিছু ঠিকঠাক মত চলে না কেন বল দেখি। তুই তোর সব কোমলতা নিয়েও চোরাপাঁকে বারবার আটকা পড়ে যাবি, আমি চারদিকে আলো ভেবে আলেয়া দেখব এমন কেন হবে? তোর মত আমারও ভাল না লাগা রোগটা বেড়ে চলেছে।
কেমন একটা শূণ্য শূণ্য লাগে জানিস? ঠিক জানি না কেন। জানলেও হয়ত না জানার ভান করব। আমার সব বন্ধুকে একটা প্রশ্ন করি আমি, চোখের পানি উষ্ণ হয় বলে কি তার থেকে বাষ্প উড়তে থাকে? সবাই বলে, না এমন হয় না। আসলে তোরা কেউ তো আমার মত সারাদিন মোটা ফ্রেমের চশমা ঝুলিয়ে রাখিস না, ঘোলা কাঁচ তোরা চিনবি কি করে? অস্থিরতা চেপে আছে। মাঝে মাঝে খাটে শুয়ে নাটকের নায়িকাদের মত খাটের পাশের টেবিল ল্যাম্পটা একবার জ্বালাই একবার নিভাই, আবার জ্বালাই আবার নিভাই। যেন এটা একটা কাজ হল। যেন এভাবে করে খুব দিন কাটানো যায়। সুইচ এর উপর হাতটা চালু রাখলাম। যতক্ষণ শক্তি আছে অফ অন করতেই থাকলাম। একবার আলো একবার আঁধার আবার আলো আবার আঁধার। একসময় হয়ত ঘুম নেমে আসবে। ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগটায় কোন অবস্থাটার সৃষ্টি হবে, আলো না আঁধার, সেটাই একটা খেলা। অবশ্য তখন তো আমার চোখই বন্ধ। চোখ বন্ধ করে রাখা মানুষ কি আলো আর আঁধারের পার্থক্য একটুও বুঝতে পারে?
আজ আর লিখতে ইচ্ছা করছে না রে। রাখি। কথা হবে। ভাল থাকিস। আন্টিকে বলিস আমাকে না বকতে, শীগগিরই একদিন আসব, প্রমিজ।
ইতি তোর বোকা বন্ধু,
মিলু।
Tuesday, October 27, 2009
আবার এলো শীত
আমলকির ডাল কখনো দেখা হয়নি বলে শীতের হাওয়া তাকে কেমন করে নাচিয়ে যায় তাও জানা হয়ে উঠেনি রবিঠাকুরের মত করে।
আমার কাছে শীত মানে জানালা গলে বিছানার উপর বরফি কাটা রোদ।
সুদূর অতীত হয়েও মনের মাঝে সগর্বে টিকে থাকা নতুন ক্লাসের উত্তেজনা আর নতুন বইখাতার চনমনে গন্ধ।
দাদাবাড়ি নানাবাড়িতে কুয়াশা নিয়ে খেলা।
শীত মানে খলশে মাছের ঝোলে আধডোবা হয়ে থাকা ডুমডুমে ফুলকপির টুকরোর দিকে লোভাতুর চোখে চেয়ে থাকা।
সাতসকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুখ থেকে ধোঁয়া ছোটানোর আপ্রাণ চেষ্টা।
শীত মানে অনেকদিনের আশার বেলুন চকিতে চুপসে গিয়েও আশায় বুক বাঁধা।
আসন্ন গ্রীষ্মের কোন এক দিনের জন্য তিলে তিলে স্বপ্ন বুনে তোলা।
এমন ঋতুটাকে কেন ধূসর আর প্রাণহীন ভেবে কবিতা লেখা হবে তাই নিয়ে মনে মনে প্রতিবাদ।
একটি বছরের বিদায়ের অজানা অকারণ বেদনাকে আরেকটি বছরের সূচনা দিয়ে ঢাকতে না পারা।
নিজের গহীনে লুকিয়ে থাকা ভালবাসাকে একদিন অবাক হয়ে আবিষ্কার।
মায়া জড়ানো দুপুর আর গড়িমসি করে পার করা সন্ধ্যা।
শীত মানে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আয়েশে চোখ বুঁজে আসা।
রঙিন পৃথিবী ঝাপসা চোখে সাদাকালো হয়ে ধরা পড়া।
শীত আমার জন্য জেগে উঠে ঘিরে ফেলা তীব্র কিছু চাওয়া।
হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারি ভাবা অবয়বগুলোর ভোরের স্বপ্ন হয়ে এসেই চলে যাওয়া।
আমার কাছে শীত মানে জানালা গলে বিছানার উপর বরফি কাটা রোদ।
সুদূর অতীত হয়েও মনের মাঝে সগর্বে টিকে থাকা নতুন ক্লাসের উত্তেজনা আর নতুন বইখাতার চনমনে গন্ধ।
দাদাবাড়ি নানাবাড়িতে কুয়াশা নিয়ে খেলা।
শীত মানে খলশে মাছের ঝোলে আধডোবা হয়ে থাকা ডুমডুমে ফুলকপির টুকরোর দিকে লোভাতুর চোখে চেয়ে থাকা।
সাতসকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুখ থেকে ধোঁয়া ছোটানোর আপ্রাণ চেষ্টা।
শীত মানে অনেকদিনের আশার বেলুন চকিতে চুপসে গিয়েও আশায় বুক বাঁধা।
আসন্ন গ্রীষ্মের কোন এক দিনের জন্য তিলে তিলে স্বপ্ন বুনে তোলা।
এমন ঋতুটাকে কেন ধূসর আর প্রাণহীন ভেবে কবিতা লেখা হবে তাই নিয়ে মনে মনে প্রতিবাদ।
একটি বছরের বিদায়ের অজানা অকারণ বেদনাকে আরেকটি বছরের সূচনা দিয়ে ঢাকতে না পারা।
নিজের গহীনে লুকিয়ে থাকা ভালবাসাকে একদিন অবাক হয়ে আবিষ্কার।
মায়া জড়ানো দুপুর আর গড়িমসি করে পার করা সন্ধ্যা।
শীত মানে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আয়েশে চোখ বুঁজে আসা।
রঙিন পৃথিবী ঝাপসা চোখে সাদাকালো হয়ে ধরা পড়া।
শীত আমার জন্য জেগে উঠে ঘিরে ফেলা তীব্র কিছু চাওয়া।
হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারি ভাবা অবয়বগুলোর ভোরের স্বপ্ন হয়ে এসেই চলে যাওয়া।
Monday, October 26, 2009
হারানো ছোট ছোট ভালবাসাগুলো
ছোটবেলায় নতুন ক্লাসে উঠলে একসাথে অনেকগুলো খাতা কেনা হত। খাতাগুলো হত একই ডিজাইনের, কেবল রঙের পার্থক্য। একেকটা বিষয়ের জন্য একেক রং। সেই খাতায় লেখা শুরু করাটা কি আনন্দই না ছিল। আমার খুব পছন্দের একটা খাতা ছিল ক্লাস টুয়ের নীল টমি খাতা। মোটা মলাটের খাতার উপর একটা আদুরে বিড়াল ছিল বলে মনে মনে এমন নাম। সাদা বিড়ালের মায়া মায়া চোখ। খুব সুন্দর ছিল দেখে সেটাকে বানালাম ইংরেজি খাতা। স্কুলে পড়ার সময় ইংরেজি প্রিয় ছিল, সেজন্য নিজেকে স্মার্টও ভাবতাম। অনেকদিন পর আজ সন্ধ্যায় টমি খাতাটার কথা মনে পড়ে নস্ট্যালজিক হয়ে গেলাম। সেই সাথে মনে পড়ল হলুদ খাতাটাকেও, আমার কবিপ্রতিভা যেখানে আবাদ হত। ক্লাস ফোর থেকে ছড়া লিখতে, আর অবসরে সেসব পড়ে মুগ্ধ হতে শুরু করেছিলাম। এই চর্চা চলেছিল মনে হয় বছর তিন চারেক হবে। প্রথম খাতাটাই ছিল হলুদ খাতাটা। মনে আছে ছোট ছোট চিরকুট পদ্য জমে ফুলে উঠেছিল বেশ। কি করে যে হারিয়ে ফেললাম।
মেলা থেকে কেনা খেলনাগুলোর মধ্যে কোন কোনটা বিশেষ ভালবাসা পেত। চাইনিজ দেখতে একটা পুতুল অনেকদিন ছিল আমার কাছে। জানি না কবে থেকে নেই হয়ে গেল। আর একটা কাঠের হাতি এখনো আছে, ওর খাবার ছিল আনারসের মাথার ঝুড়িগুলো। অনেকদিন টিকে ছিল প্লাস্টিকের পশুর একটা সেট। ব্যাটারিওয়ালা মেম পুতুলটার কথা তো না বললেই না। আমি মেম পুতুল বলতাম না। এই নামটা জানা ছিল না, পরে বই পড়ে জেনেছি। পুতুলটা মামার দেয়া। নাম ছিল তুলতুল। গায়ে গোলাপি উলের পোশাক আর টুপি। শান্ত স্বভাব, কখনোই বিরক্ত করেনি।
জীবনের প্রথম গল্পের বইটা অসাধারণ ছিল। ঠাকুরমার ঝুলি। ক্লাস ওয়ানের কথা সেটা। বইটা হারিয়েছি। ওই অসাধারণ গন্ধ আর কোন কিছুতে নেই। ছিল ডালিমকুমার, পঙ্কাবতী আর দৈত্যের গল্প। বাজারে বহু ঠাকুরমার ঝুলি আছে। কিন্তু ঠিক ওই বইটা অনেক খুঁজেও কোথাও পাইনি আমি আর।
এমন আরো কত কিছু। আজকে কেউ নেই।
সত্যি কথা বলতে কি এতদিন পর আমি এদের কাউকেই সত্যিকার অর্থে মিস করি না। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ কেমন যেন মন টানে। খুব হাতে নিতে ইচ্ছা করে টমি খাতা কিংবা ঠাকুরমার ঝুলিটাকে। একটু শুধু আঙুল বোলানো। চিরতরে হারিয়ে গিয়ে এরা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে এই নিছক 'জিনিস'গুলোকে আমি ভালবাসতাম।
অনেককাল পাশে থাকা বস্তুগুলোর সাথেও অজান্তে কি করে যেন ভালবাসা হয়ে যায়। ওরা কখনোই স্বেচ্ছায় ছেড়ে যায় না, আমরাই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ওদেরকে দূরে সরিয়ে দিই। একদিন যখন হাত বাড়াই আর খুঁজে পাই না, অসহায় একটা অনুভূতি হয়। মানুষের বেলায়ও কি এমন?
মেলা থেকে কেনা খেলনাগুলোর মধ্যে কোন কোনটা বিশেষ ভালবাসা পেত। চাইনিজ দেখতে একটা পুতুল অনেকদিন ছিল আমার কাছে। জানি না কবে থেকে নেই হয়ে গেল। আর একটা কাঠের হাতি এখনো আছে, ওর খাবার ছিল আনারসের মাথার ঝুড়িগুলো। অনেকদিন টিকে ছিল প্লাস্টিকের পশুর একটা সেট। ব্যাটারিওয়ালা মেম পুতুলটার কথা তো না বললেই না। আমি মেম পুতুল বলতাম না। এই নামটা জানা ছিল না, পরে বই পড়ে জেনেছি। পুতুলটা মামার দেয়া। নাম ছিল তুলতুল। গায়ে গোলাপি উলের পোশাক আর টুপি। শান্ত স্বভাব, কখনোই বিরক্ত করেনি।
জীবনের প্রথম গল্পের বইটা অসাধারণ ছিল। ঠাকুরমার ঝুলি। ক্লাস ওয়ানের কথা সেটা। বইটা হারিয়েছি। ওই অসাধারণ গন্ধ আর কোন কিছুতে নেই। ছিল ডালিমকুমার, পঙ্কাবতী আর দৈত্যের গল্প। বাজারে বহু ঠাকুরমার ঝুলি আছে। কিন্তু ঠিক ওই বইটা অনেক খুঁজেও কোথাও পাইনি আমি আর।
এমন আরো কত কিছু। আজকে কেউ নেই।
সত্যি কথা বলতে কি এতদিন পর আমি এদের কাউকেই সত্যিকার অর্থে মিস করি না। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ কেমন যেন মন টানে। খুব হাতে নিতে ইচ্ছা করে টমি খাতা কিংবা ঠাকুরমার ঝুলিটাকে। একটু শুধু আঙুল বোলানো। চিরতরে হারিয়ে গিয়ে এরা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে এই নিছক 'জিনিস'গুলোকে আমি ভালবাসতাম।
অনেককাল পাশে থাকা বস্তুগুলোর সাথেও অজান্তে কি করে যেন ভালবাসা হয়ে যায়। ওরা কখনোই স্বেচ্ছায় ছেড়ে যায় না, আমরাই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ওদেরকে দূরে সরিয়ে দিই। একদিন যখন হাত বাড়াই আর খুঁজে পাই না, অসহায় একটা অনুভূতি হয়। মানুষের বেলায়ও কি এমন?
Sunday, September 27, 2009
পতঙ্গের বুকে আমরা
একটা রক্তশোষা ছোট্ট পতঙ্গ। উড়তে উড়তে ঠিক আমার গালের উপর এসে বসল। কখন যেন এক বিন্দু রক্ত খেয়েও নিল। টের পেলাম উড়ে যাবার পর। উড়ে গিয়ে বোকা পোকাটা বসল আবার তোমার সটান করে রাখা হাতে। আমি চেয়ে আছি। সে টেনে নিল আরও একটা ফোঁটা। এবার সে একটু ক্লান্ত বোধ হয়। হেলে দুলে নড়ে চড়ে চলে যাচ্ছে রকমারি ভোজটা শেষ করে। তুমি যেন একটু সতর্ক হয়ে উঠলে। ওকে পিষে মারতে চাও নাকি? আমাদের ব্যথা দিয়েছে বলে রেগে গেলে ওর উপর? কি হয়? কত ছোট্ট একটা প্রাণী। বেচারার খাবার বলতে আমাদের মত মানুষদের দুই এক ফোঁটা রক্তই তো। তুমি পারো চাইলেই, কিন্তু আমার ইচ্ছে হচ্ছে না তুমি ওকে মারো। এক আঘাতে তিন তিনটা প্রাণ কেড়ে নেয়া কি সাজে? অবাক হচ্ছো? বুঝলে না? এই দেখ ওর মাঝে ওর নিজের প্রাণ ছাড়াও আছে আমার রক্ত, তোমার রক্ত; যেন আমার একটু প্রাণ আর তোমার একটু প্রাণ। এই কাঠখোট্টা পৃথিবী, সমাজ সংসার গুরুজন বা বন্ধু, কেউই তোমাকে আর আমাকে এক হয়ে পাশাপাশি বাঁচতে দিচ্ছে না, দিবে না। তোমার বুঝি কখনও কষ্ট হয় না? দেখ না কেমন করে এই নগণ্য পতঙ্গটা আমাদের মিলিয়ে এক করে দিল ওর নিজের মধ্যে। এভাবেই নাহয় কিছুটা সময় আমরা খুব কাছাকাছি রইলাম! আমাকে, তোমাকে আর আমাদের একীভূত হবার অদম্য ইচ্ছেটাকে ও কেমন করে ওর বুকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এটুকু দোষ করলে কি কাউকে পাপী বলা যায়?
... ... ...
কবিতার মধ্যে একটা স্বল্পবুদ্ধির মাথার বোধগম্য গল্প না থাকলে পড়তে ভাল লাগে না। আর ইংরেজি কবিতা? সে তো আরও দূর্গম পথ। উপরের অংশটুকু John Donne এর লেখা The Flea কবিতাটার একটা মোটামুটি ভাবার্থ। মনে ধরেছিল খুব। কিছু মানুষ কেমন করে যেন কারো না কারো ভাবনার কথা, স্বপ্নের কথা বলে দেয়। হয়ত খুব অন্যরকমভাবে, যেমনটা আমরা নিজেরা কখনও ভাবিনি। তবুও সত্যি হয়ে মিলে যায়।
... ... ...
কবিতার মধ্যে একটা স্বল্পবুদ্ধির মাথার বোধগম্য গল্প না থাকলে পড়তে ভাল লাগে না। আর ইংরেজি কবিতা? সে তো আরও দূর্গম পথ। উপরের অংশটুকু John Donne এর লেখা The Flea কবিতাটার একটা মোটামুটি ভাবার্থ। মনে ধরেছিল খুব। কিছু মানুষ কেমন করে যেন কারো না কারো ভাবনার কথা, স্বপ্নের কথা বলে দেয়। হয়ত খুব অন্যরকমভাবে, যেমনটা আমরা নিজেরা কখনও ভাবিনি। তবুও সত্যি হয়ে মিলে যায়।
Tuesday, September 15, 2009
"ভালবাসা"
ছোট্টবেলার প্রেম আমার কালো মেম, কোথায় গেলে হারিয়ে...
ম্যারি অ্যানের সাথে যে আর কখনো অঞ্জনের দেখা হয়নি এমন না। এখনও দু’জন কাছাকাছি এলাকাতেই থাকে। অঞ্জনের পাড়ার উপর দিয়েই তাকে যেতে হয় প্রায়ই। দেখতে এখন সে ভীষণ অন্যরকম। ঝোলা গাল আর পাকা চুলের মাঝবয়েসী ম্যারি অ্যানের ক্ষয়ে যাওয়া নখও তার চোখ এড়ায় না। চোখাচোখি হয়ে যায় হয়ত অঞ্জন যখন মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসছে, বা ম্যারি অ্যান যখন বাবার জন্য ওষুধ কিনছে। দুরন্ত শৈশবে কিংবা অস্থির কৈশোরে ভাল লেগে যাওয়া মানুষগুলোকেকি আমরা আসলেই বিশেষভাবে মনে রাখি? মনে হয় না। বারান্দাতে তোয়ালে শুকাতে দিতে এলে হুট করে যখন রাস্তায় চোখ পড়ে যায়, কালো ফ্রেমের চশমা পরা অজানা আকর্ষণধারী নিষ্পাপ ছেলেটা যে এখন কালচে ঠোঁটের লম্বাটে একজন চোয়াড়ে যুবক, তাকে দেখে তো একমুহূর্তের জন্যও একবিন্দু অনুভূতির জন্ম হয় না। ঠিকই কাপড় গুছিয়ে বিকালের কাজের কথা ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকে পড়ি। কলেজে পড়ার সময় যেই ক্লাসমেট হেঁটে যাবার সময় হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠত, আজকে তার নাম কানে এলে ওই পাগলামির কথা ভেবে কি কারো হাসি পায় না? এমনকি পাঁচ ছয়টা বছরের দ্বিধাহীন পরম ভালবাসাবাসির ফল যখন দু’জনের বুকভাঙা বিচ্ছেদে গিয়ে ঠেকে, সময় না গড়াতেই সেই দু’জন কেমন চমৎকার মানিয়ে নেয়। তাই বলে কি সত্যিই এসবের কোন মূল্য ছিল না বা নেই? কোথাও না কোথাও সবগুলো ভাললাগারই নিশ্চয়ই ভূমিকা আছে। অথচ কি প্রচণ্ড অভিযোজনশীল আমরা। কিছুই মনে রাখতে চাই না। যেই নৌকাতে পা রেখে স্থিরতা আনতে পারি বলে মনে হয়, যেই সম্পর্কটা সমাজের চোখে জ্বলজ্বল করে জ্বলে, সেটাকেই ‘প্রকৃত ভালবাসা’ আখ্যা দিই। বাকিগুলো সব নিছক আকর্ষণ, বা গালভরা নাম ‘ইনফ্যাচুয়েশন’। মেয়েরা একটু আগে সংসারী হয়ে সকল মনোযোগ নতুন জীবনে প্রয়োগ করে, আর ছেলেরা একটু দেরিতে যাত্রা শুরু করায় কিছুদিনের জন্য খুব স্মৃতির জাবর কেটে নিজেকে ব্যথিত প্রমাণ করার সুযোগ পেয়ে যায়। তারপর সব ঠিকঠাক। ভালবাসা এতখানি মরণশীল! না কি না? মানুষ তো আবার ভানের রাজা। কোনটা আসলে ভান কে জানে। এত বছর গড়ালো, তবু সবকিছু একই আছে, কিছুই ভুলিনি-এটা? নাকি ওসব ক্ষণিকের মোহ ছিল, এখন আমি কিছুই ভাবি না-এটা?
নর-নারীর মধ্যকার ভালবাসাটা স্থায়ী একমুখী নাকি অস্থায়ী বহুমুখী? সময় যেদিকে ভাসিয়ে নেয়, বাঁচবার জন্য, ভাল থাকবার জন্য কি অদ্ভুত করেই না ভালবাসার নানারকম সংজ্ঞা তৈরি হয়। আজ এই তো কাল সেই। পরিস্থিতির আনুকূল্য না পেলে মনের খাঁচায় কোন নির্দিষ্ট একটা পাখিকে জীবনভর পুষি না। কারণ সবচেয়ে বড় সত্য হল, সুখেশান্তিতে বেঁচেবর্তে থাকার চেষ্টা করতে হবে, সবাইকে সেটা দেখাতেও হবে।
ম্যারি অ্যানের সাথে যে আর কখনো অঞ্জনের দেখা হয়নি এমন না। এখনও দু’জন কাছাকাছি এলাকাতেই থাকে। অঞ্জনের পাড়ার উপর দিয়েই তাকে যেতে হয় প্রায়ই। দেখতে এখন সে ভীষণ অন্যরকম। ঝোলা গাল আর পাকা চুলের মাঝবয়েসী ম্যারি অ্যানের ক্ষয়ে যাওয়া নখও তার চোখ এড়ায় না। চোখাচোখি হয়ে যায় হয়ত অঞ্জন যখন মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসছে, বা ম্যারি অ্যান যখন বাবার জন্য ওষুধ কিনছে। দুরন্ত শৈশবে কিংবা অস্থির কৈশোরে ভাল লেগে যাওয়া মানুষগুলোকেকি আমরা আসলেই বিশেষভাবে মনে রাখি? মনে হয় না। বারান্দাতে তোয়ালে শুকাতে দিতে এলে হুট করে যখন রাস্তায় চোখ পড়ে যায়, কালো ফ্রেমের চশমা পরা অজানা আকর্ষণধারী নিষ্পাপ ছেলেটা যে এখন কালচে ঠোঁটের লম্বাটে একজন চোয়াড়ে যুবক, তাকে দেখে তো একমুহূর্তের জন্যও একবিন্দু অনুভূতির জন্ম হয় না। ঠিকই কাপড় গুছিয়ে বিকালের কাজের কথা ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকে পড়ি। কলেজে পড়ার সময় যেই ক্লাসমেট হেঁটে যাবার সময় হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠত, আজকে তার নাম কানে এলে ওই পাগলামির কথা ভেবে কি কারো হাসি পায় না? এমনকি পাঁচ ছয়টা বছরের দ্বিধাহীন পরম ভালবাসাবাসির ফল যখন দু’জনের বুকভাঙা বিচ্ছেদে গিয়ে ঠেকে, সময় না গড়াতেই সেই দু’জন কেমন চমৎকার মানিয়ে নেয়। তাই বলে কি সত্যিই এসবের কোন মূল্য ছিল না বা নেই? কোথাও না কোথাও সবগুলো ভাললাগারই নিশ্চয়ই ভূমিকা আছে। অথচ কি প্রচণ্ড অভিযোজনশীল আমরা। কিছুই মনে রাখতে চাই না। যেই নৌকাতে পা রেখে স্থিরতা আনতে পারি বলে মনে হয়, যেই সম্পর্কটা সমাজের চোখে জ্বলজ্বল করে জ্বলে, সেটাকেই ‘প্রকৃত ভালবাসা’ আখ্যা দিই। বাকিগুলো সব নিছক আকর্ষণ, বা গালভরা নাম ‘ইনফ্যাচুয়েশন’। মেয়েরা একটু আগে সংসারী হয়ে সকল মনোযোগ নতুন জীবনে প্রয়োগ করে, আর ছেলেরা একটু দেরিতে যাত্রা শুরু করায় কিছুদিনের জন্য খুব স্মৃতির জাবর কেটে নিজেকে ব্যথিত প্রমাণ করার সুযোগ পেয়ে যায়। তারপর সব ঠিকঠাক। ভালবাসা এতখানি মরণশীল! না কি না? মানুষ তো আবার ভানের রাজা। কোনটা আসলে ভান কে জানে। এত বছর গড়ালো, তবু সবকিছু একই আছে, কিছুই ভুলিনি-এটা? নাকি ওসব ক্ষণিকের মোহ ছিল, এখন আমি কিছুই ভাবি না-এটা?
নর-নারীর মধ্যকার ভালবাসাটা স্থায়ী একমুখী নাকি অস্থায়ী বহুমুখী? সময় যেদিকে ভাসিয়ে নেয়, বাঁচবার জন্য, ভাল থাকবার জন্য কি অদ্ভুত করেই না ভালবাসার নানারকম সংজ্ঞা তৈরি হয়। আজ এই তো কাল সেই। পরিস্থিতির আনুকূল্য না পেলে মনের খাঁচায় কোন নির্দিষ্ট একটা পাখিকে জীবনভর পুষি না। কারণ সবচেয়ে বড় সত্য হল, সুখেশান্তিতে বেঁচেবর্তে থাকার চেষ্টা করতে হবে, সবাইকে সেটা দেখাতেও হবে।
Monday, September 7, 2009
"নিয়তি"
ঠিক বিশ বছর আগের এই দিনটাতে ফিরে যাবার চেষ্টা করলাম। একেবারেই পরিষ্কার না, ভাল লাগছে এই ভেবে যে এখনও ততখানি বুড়ো হয়ে যাইনি যে বিশ বছর আগের দিকে তাকিয়ে নিজেকে মোটামুটি বড় দেখব। না না মনে পড়ছে তো কিছু কিছু, খুশি হলাম, এখনও ততটা বয়স হয়ে যায়নি যে স্মৃতিশক্তি ঝাপসা হবে। সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী বালিকা ক্লাসে কথা বলার অপরাধে পিটুনি খেয়েছিলাম। ওই বছরেরই কোন এক দিনে, হতে পারে এই তারিখই। তারপর পর পর তিন দিন আমাকে স্কুলে দিয়ে আসা হলে একটু পর আমি গেট দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে একা একা বাসায় ফিরেছি, কেমন যেন বমি বমি পেত। একথা স্পষ্ট মনে করতে পারি। বাসা থেকে স্কুল ছিল হাঁটা পথে মিনিট আট দশেক। এখন ভাবলে ভয় হয়। যদি কেউ আমাকে পথের মাঝ থেকে তুলে কোথাও বিক্রি করে দিত? কোন ‘ছেলেধরা’। আজকে কোথায় থাকতাম?
দশ বছর আগের এই সময়টা ছিল এককথায় অসাধারণ। ক্লাস টেন, আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়। সারাদিন ক্লাসে বসে হাসাহাসি। এস এস সির পড়াগুলোও ভালই ছিল। একদিন বিকালে আমি আর আম্মু মার্কেটে যাবার জন্য রিকশা নিয়েছি। আরামবাগের কাছে উল্টোদিক থেকে জোরেসোরে আসা একটা বাস আরেকটু হলে আমাদের রিকশাকে ধাক্কা দিয়ে দিচ্ছিল। আমরা হতভম্ব। একদম শেষ মুহূর্তে বাসটা কেমন করে যেন থেমে যায়। সত্যি যদি ধাক্কাটা লাগত? বাঁচতাম হয়ত কিন্তু কেমন হয়ে? কে জানে।
একবছর আগের এই দিনটা বছরের অন্য অনেক দিনের মত উপভোগ্য ছিল না। আমার সারা গায়ে-মুখে তখন জলবসন্তের জলকেলি। স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি ছিল গুটিকার ঘনত্ব। কোত্থেকে যেন শুনে নিয়েছিলাম যার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা যত বেশি তার বসন্তগোটার সংখ্যা তত বেশি হয়। এই শুনে সুখী হবার সু্যোগ ছিল না জ্বর আর ব্যথায়। একটা সময়ে যখন চোখ লাল হয়ে জ্বালা শুরু হয়ে যায় আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম আমার চোখের মণিতে আক্রমণ হয়েছে এবং আমি জানতাম চোখের মণিতে বসন্ত মানেই আমি অন্ধ হয়ে যাব। মনে পড়ে কেমন প্রচণ্ড একটা আতংক কুঁকড়ে দিয়েছিল আমাকে। কেমন থাকতাম আজকে আমি, যদি সত্যিই চোখ হারাতাম?
একমাস আগের এই দিনটাই নাহয় ধরলাম। এখনও জানি না, কিন্তু হতেও তো পারে ঠিক এই সময়টাতে আমি অল্পের জন্য কিছু একটা থেকে অনের বড় বাঁচা বেঁচে গেছি, বা একটুর জন্য কিছু একটা থেকে নিজেকে শেষ রক্ষা করতে পারিনি। কিসের পরিণতি কি, তা বুঝতে কিছুটা সময় তো লেগেই যায়।
এমন কি হয় না, কয়েক দিন আগে করে ফেলা নেহায়েত খামখেয়ালী একটা কাজ কাউকে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ খুঁজে পাইয়ে দিল। কিংবা এক মিনিটের ভুলে জীবনভর পস্তাতে হল। আমরা যখন জন্মাই আমাদের সাথে ছুটে চলার জন্য জেগে উঠে অনেকগুলি সমান্তরাল সম্ভাবনা। একমুহূর্তের একটা সিদ্ধান্ত বা একপলকের একটা দৈব ঘটনায় নির্ধারিত হয়ে যায় জীবনের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি। সমান্তরাল পথগুলোর একটাতে আমরা হাঁটা ধরি। সেখানেও তৈরি হয় আবার আরো কিছু নতুন সমান্তরাল সারি। তার থেকে আবারও টিকে থাকে কোন একটা। আর আমাদের ‘হলেও হতে পারত’ জীবন বা জীবনগুলোর সম্ভাবনা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। ‘নিয়তি’ চিরকালই একটা রহস্য রয়ে গেল।
দশ বছর আগের এই সময়টা ছিল এককথায় অসাধারণ। ক্লাস টেন, আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়। সারাদিন ক্লাসে বসে হাসাহাসি। এস এস সির পড়াগুলোও ভালই ছিল। একদিন বিকালে আমি আর আম্মু মার্কেটে যাবার জন্য রিকশা নিয়েছি। আরামবাগের কাছে উল্টোদিক থেকে জোরেসোরে আসা একটা বাস আরেকটু হলে আমাদের রিকশাকে ধাক্কা দিয়ে দিচ্ছিল। আমরা হতভম্ব। একদম শেষ মুহূর্তে বাসটা কেমন করে যেন থেমে যায়। সত্যি যদি ধাক্কাটা লাগত? বাঁচতাম হয়ত কিন্তু কেমন হয়ে? কে জানে।
একবছর আগের এই দিনটা বছরের অন্য অনেক দিনের মত উপভোগ্য ছিল না। আমার সারা গায়ে-মুখে তখন জলবসন্তের জলকেলি। স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি ছিল গুটিকার ঘনত্ব। কোত্থেকে যেন শুনে নিয়েছিলাম যার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা যত বেশি তার বসন্তগোটার সংখ্যা তত বেশি হয়। এই শুনে সুখী হবার সু্যোগ ছিল না জ্বর আর ব্যথায়। একটা সময়ে যখন চোখ লাল হয়ে জ্বালা শুরু হয়ে যায় আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম আমার চোখের মণিতে আক্রমণ হয়েছে এবং আমি জানতাম চোখের মণিতে বসন্ত মানেই আমি অন্ধ হয়ে যাব। মনে পড়ে কেমন প্রচণ্ড একটা আতংক কুঁকড়ে দিয়েছিল আমাকে। কেমন থাকতাম আজকে আমি, যদি সত্যিই চোখ হারাতাম?
একমাস আগের এই দিনটাই নাহয় ধরলাম। এখনও জানি না, কিন্তু হতেও তো পারে ঠিক এই সময়টাতে আমি অল্পের জন্য কিছু একটা থেকে অনের বড় বাঁচা বেঁচে গেছি, বা একটুর জন্য কিছু একটা থেকে নিজেকে শেষ রক্ষা করতে পারিনি। কিসের পরিণতি কি, তা বুঝতে কিছুটা সময় তো লেগেই যায়।
এমন কি হয় না, কয়েক দিন আগে করে ফেলা নেহায়েত খামখেয়ালী একটা কাজ কাউকে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ খুঁজে পাইয়ে দিল। কিংবা এক মিনিটের ভুলে জীবনভর পস্তাতে হল। আমরা যখন জন্মাই আমাদের সাথে ছুটে চলার জন্য জেগে উঠে অনেকগুলি সমান্তরাল সম্ভাবনা। একমুহূর্তের একটা সিদ্ধান্ত বা একপলকের একটা দৈব ঘটনায় নির্ধারিত হয়ে যায় জীবনের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি। সমান্তরাল পথগুলোর একটাতে আমরা হাঁটা ধরি। সেখানেও তৈরি হয় আবার আরো কিছু নতুন সমান্তরাল সারি। তার থেকে আবারও টিকে থাকে কোন একটা। আর আমাদের ‘হলেও হতে পারত’ জীবন বা জীবনগুলোর সম্ভাবনা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। ‘নিয়তি’ চিরকালই একটা রহস্য রয়ে গেল।
Tuesday, September 1, 2009
পত্র দিও...
ভাবলাম আমিও একটা চিঠি লিখি। চিঠি না ঠিক, ছোট্ট কোন চিরকুট। কলমে লিখব নাকি পেন্সিলে? সাদা নাকি রুল টানা কাগজে? খাম থাকবে কি থাকবে না? মনে মনে লিখে আকাশের ঠিকানায় ছেড়ে দিলেই হয়। লেখাও হল আবার কেউ পড়তেও পেল না। কিন্তু কাকে লিখি?
মা-কে লিখব একটা? “প্রিয় আম্মু, জীবনভর তো তোমাকে কম জ্বালাতন করলাম না, তবু কখনো মুখ ফিরাওনা। তার জন্য আমি কোন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে যাব না কখনো। অসম্ভব কাজ কি আর করা যায়? তুমি একদিন অনেক বুড়ো হয়ে যাবে, একদিন থাকবে না এটা ভাবলে আমার চেতনা থেমে যেতে চায়। প্লিজ এটা কি বন্ধ করা যায় না?”
সদা নির্লিপ্ত পিতাকে লেখা যায়, “আব্বু, আমার জন্য তোমার যত মায়া সেটা হয়ত সব বাবাদের মধ্যেই আছে। তবে আমি জানিনা সবাই তোমার মত করে গুণে গুণে মেয়ের পছন্দ অপছন্দ হিসাব করে কিনা। ছোটবেলায় আমি ভাবতাম আমার বাবা যদি তুমি না হয়ে অন্য কেউ হত আমি তার সাথে মোটেও কথা বলতাম না, বরং পথে কোথাও তোমার সাথে দেখা হলে আমি তোমাকেই বাবা ডাকতাম। আমার এই ধারণা না এখনও একই আছে। আমার অতি তুচ্ছ বিষয়গুলিতেও তুমি যেভাবে মনোযোগ দাও যে অবাক লাগে। আমার নিজেরই মনে থাকে না আমি কবে কি বলেছিলাম বা চেয়েছিলাম। তুমি দেখি ঠিকই মনে রাখ। সবাইকে একটা করে এমন বাবা দিয়ে দেয়া হোক।”
বুঝুক আর না বুঝুক, সাড়ে পাঁচ বছরের চাচাতো বোনটা আরেকটু ভাল করে পড়তে পারলে নাহয় কিছু লেখা যেত। “তোমার মজার মজার কথা শুনতে কিন্তু আমার বেশ লাগে। বড় হয়ে কিন্তু তোমাকে বড় হতে হবে। আমার বয়সে পৌঁছে আমার মত হাপিত্যেশ করলে তোমার একদম চলবে না। প্রত্যেকটা দিন উপভোগ করে নাও। বড় হলে ছোট থাকার আনন্দ হাজার চেয়েও পাবে না।”
যাদের সাথে দেখা হবার সুযোগ নেই এমন কাউকে লেখা উচিত। “কেমন আছ তাহমিনা? সেই কবে তোমরা এই এলাকা থেকে চলে গেছ। আমি মনে হয় ক্লাস ফোরে পড়তাম। আমাদের খেলার জায়গাটা কিন্তু এখনও একই আছে। একসময় জয়ারাও চলে গিয়েছিল। আমার অনেক নতুন বন্ধু হয়েছলিও পরে। তোমাদের কথা মনে পড়ত না। কোথায় থাক তোমরা কে জানে। আমি কিন্তু এখনও আছি, তবে পাশের বিল্ডিংয়ে। আমার কেন যেন মনে হয় তুমি এখন দেশের বাইরে। সত্যি কি তাই?”
টেন্ডুলকারের কি বিশাল ভক্তই না ছিলাম এককালে। তাকে ইংলিশে লিখে দিব? “বহুদিন তোমার কোন খোঁজ রাখি না টেন্ডুলকার। মাঠে নাম কিনা তাও জানিনা, নাকি মাঠে নামার বয়স চলে গেছে? কি খবর ক্রিকেট দুনিয়ার? একবার স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ভারত ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম মনে আছে? সেই ছিল আমার প্রথম ও শেষ স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাওয়া। আমার চশমাটার কাঁচ ভেঙে পড়েছিল, কি কান্নাই না পেয়ে গেল এত দূরের মাঠ কি করে দেখব ভেবে। কিভাবে কিভাবে করে যেন পরে সামলে নিয়েছিলাম কাঁচটাকে।”
সেই প্রাইমারির গণ্ডি পেরুনোরও আগে রুটিন করে পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত যেই গুন্ডামুখো তাকে বলা যায় কিছু কথা। “তোমার চাহনি খুবই ভয়ংকর ছিল। পরে যখন তোমাকে মাঝে মাঝে দেখেছি, উস্কুখুস্কু ছিলে, আর ভয় লাগত না তখন। তবে জীবনের যেই সময়টাতে দেখতে সবচেয়ে খারাপ ছিলাম, তখনো তুমি আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে মজা পেতে, তোমার ধৈর্য্য আমার চেহারার উপর আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছিল, ধন্যবাদ নিতে পার।”
ইদানিং খুব মনে পড়ছে পিচ্চিকালের হাড় জিরজিরে পলাশ ভাইয়ার কথা। “মনে নেই তোমাকে তুমি করে বলতাম নাকি আপনি করে। প্রায় বিশ বছর হয়ে গেছে। শুনতাম বড় হয়ে যাবার পর তুমি অনেক অসুস্থ থাকতে, ওপেন হার্ট সার্জারির পর তোমাকে আমরা দেখতে গিয়েছিলাম। খুব উত্তেজিত ছিলাম এতগুলো দিন পর তুমি কেমন হয়েছ, আমাকে দেখেই চিনবে কিনা এসব ভেবে। জানো হসপিটালে গিয়ে শুনি তুমি সেদিনই রিলিজে নিয়ে চলে গেছ। সেখান থেকে বড় আপুদের বাসায় গেলাম। ওরা বলল একটু আগেই তোমাকে নিয়ে গিয়েছেন তোমার ভাই। হতাশ লাগছিল খুব। আর কখনো দেখা হয়নি।”
স্যারকে লিখব? ক্লাস নাইন আর টেন অংক করতাম উনার কাছে। “প্রিয় স্যার, সালাম নিবেন। আপনি কেমন আছেন? আমার কথা মনে আছে? সময়ানুবর্তী ছিলেন না একদমই। কিন্তু কত যত্ন করেই না অংক করাতেন। বুঝতে দেরি হলে মাঝে মাঝে মাথার তালুতে হাত দিয়ে দেখতেন ঠাণ্ডা আছে নাকি গরম। কোনরকম বকার কথা মনে পড়ে না। আপনার সাইকেলটা এখন কোথায়?”
আমার একজন গানের টিচারও ছিলেন। মাস শেষে টাকা নেয়ার সময় খুব ইতস্তত করতেন উনি। সম্ভবত এজন্য যে আমি উনার শিক্ষকের মেয়ে। একইরকম করে তো উনাকেও লিখতে পারি, “প্রিয় স্যার, সালাম নিবেন। আপনি কেমন আছেন? আমার কথা মনে আছে? আমি আর গানের চর্চা করিনি। ভাল লাগত না। আপনি কি এখনও গান শেখান? মনে আছে আপনি প্রায়ই বলতেন, স্যার না থাকলে আজকে মানুষ হইতাম না। পিতাগর্বে তখন মনে মনে উচ্ছ্বসিত হতাম খুব।”
অতিপ্রিয় রবীন্দ্রনাথকে লেখার সাহস হবে কিনা বুঝতে পারছি না। “শ্রদ্ধেয় রবিদাদু, তোমার ‘গল্পগুচ্ছ’ আমার অতি অতি পছন্দ। কাবুলিওয়ালার গল্পটা পড়ে আমার কান্না পেয়ে যায়। তোমার গান গুলিও কেমন করে এত অসাধারণ? আর ‘দুই বিঘা জমি’ তো আমার ভাঁজ করে পকেটে পুরে রাখতে ইচ্ছা করে। ওহো আমার জামায় তো পকেট থাকে না। আচ্ছা কি করলে তোমার মত করে লিখতে পারব? আসলে কোনদিন এমনটা আর কেউ পারবে না তাই না? প্রত্যেকটা মানুষই তো আলাদা। তাই কেউ কারো মত হয় না।”
বাসায় প্রথম ইন্টারনেট আসার পর ইটালিয়ান একজন নেটফ্রেন্ড হয়েছিল আমার কিছুদিন। লালচুলো লোকটার নাম লুকা। ইটালির ছবি দেখে খুব আফসোস হত কেন ওইরকম একটা দেশে জন্মালাম না। “হ্যালো লুকা, তোমার শেষ মেইলটার জবাব দিইনি শুধুমাত্র এই কারণে যে ইচ্ছা হচ্ছিল না। সেই যে সুনামি হল, এরপর একদিন হঠাৎ করে মেইল করে লিখেছিলে-আমি তোমাদের ওইদিকে সুনামির কথা জানতে পেরেছি, বন্ধু তুমি ভাল আছ তো? সরি লুকা আমি ভালই ছিলাম কিন্তু কেন যেন উত্তর দিতে ইচ্ছা করেনি। তোমার শেখানো ইটালিয়ান কথাবার্তা সব ভুলে গেছি। মিলানে কি এখন সামার? আশা করি তুমি এবং তোমার মা-ও কুশলে আছ।”
সেই সে হারানো নারিকেল গাছের কাছে লিখলে কি খুব হাসির ব্যাপার হবে? “তোমাকে যেদিন কেটে ফেলা হল, আমি বাথরুমে গিয়ে কি কান্নাই না কাঁদলাম। কলেজে পড়তাম তো, একটা কবিতা ছিল মনে আছে? ‘The Tree At My Window’. তুমি ছিলে আমার জন্য তাই। সেদিনের আগে বুঝতেও পারিনি তোমার জন্য আমার এত টান তৈরি হয়ে গেছে। এখন কিন্তু ভেবে লজ্জা পাই এত বড় বয়সে গাছ নিয়ে আদিখ্যেতা করেছিলাম ভেবে।”
কাউকে পাচ্ছি না কেন? অবাক করে দেয়ার মত খারাপ একজন কোন মানুষ খুঁজেই কি তাহলে চিঠিটা লিখতে হবে? “কেবল খেলার আনন্দের জন্য অন্যের অস্তিত্বকে হত্যাও বুঝি করা যায়? কুশ্রী কোন অপকর্মকে ভুলে থাকার ভান করলেও কি সেই অপকর্ম পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে পাপীর পিছু তাড়া করে না? বিবেকের বিষদাঁত অনেক বেশি ধারালো। ম্যাকবেথের কথা মনে আছে? হাত থেকে রক্তের অদৃশ্য দাগ মোছার জন্য সে পাগলপারা হয়ে গিয়েছিল।”
বরং একটা ভাল মানুষকেই নাহয় লিখলাম। “সততা আর মমতা থাকলে কাউকে অসুখী করা বা নিজের অসুখী হবার ভয় থাকে না তাই না? শুধুমাত্র ভালবাসা দিতে আর নিতে জানলেই জীবনটা অর্থবহ করে তোলা যায়। সৃষ্টিকর্তার কাছে নিশ্চয়ই সবার জন্য কিছু না কিছু আছেই। তাই নয় কি?”
হতে পারে পৃথিবীর আলো দেখেনি এমন কাউকেও কয়েক ছত্র পাঠিয়ে দিলাম। “প্রিয় অনাগত শিশু, জন্মের আগের মুহূর্তগুলো কেমন? আমি মনে করতে পারি না। নিরাপদ আবাস থেকে কাঁটাময় জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছ। উদ্বেগ হয়? হতেই পারে। তবে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে অসীম সম্ভাবনা। অনেক দিকে অনেক পথই খোলা। সুতরাং বেছে নাও। সিনেমায় দেখা আমার খুব পছন্দের একটা কথা বলি তোমাকে, it's the choices that make us who we are. And we can always choose to do what's right. "
জানি কাউকেই লেখা হবে না কিছু। অথচ আকাশের ঠিকানায় পত্র দেয়া কতই না সহজ।
মা-কে লিখব একটা? “প্রিয় আম্মু, জীবনভর তো তোমাকে কম জ্বালাতন করলাম না, তবু কখনো মুখ ফিরাওনা। তার জন্য আমি কোন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে যাব না কখনো। অসম্ভব কাজ কি আর করা যায়? তুমি একদিন অনেক বুড়ো হয়ে যাবে, একদিন থাকবে না এটা ভাবলে আমার চেতনা থেমে যেতে চায়। প্লিজ এটা কি বন্ধ করা যায় না?”
সদা নির্লিপ্ত পিতাকে লেখা যায়, “আব্বু, আমার জন্য তোমার যত মায়া সেটা হয়ত সব বাবাদের মধ্যেই আছে। তবে আমি জানিনা সবাই তোমার মত করে গুণে গুণে মেয়ের পছন্দ অপছন্দ হিসাব করে কিনা। ছোটবেলায় আমি ভাবতাম আমার বাবা যদি তুমি না হয়ে অন্য কেউ হত আমি তার সাথে মোটেও কথা বলতাম না, বরং পথে কোথাও তোমার সাথে দেখা হলে আমি তোমাকেই বাবা ডাকতাম। আমার এই ধারণা না এখনও একই আছে। আমার অতি তুচ্ছ বিষয়গুলিতেও তুমি যেভাবে মনোযোগ দাও যে অবাক লাগে। আমার নিজেরই মনে থাকে না আমি কবে কি বলেছিলাম বা চেয়েছিলাম। তুমি দেখি ঠিকই মনে রাখ। সবাইকে একটা করে এমন বাবা দিয়ে দেয়া হোক।”
বুঝুক আর না বুঝুক, সাড়ে পাঁচ বছরের চাচাতো বোনটা আরেকটু ভাল করে পড়তে পারলে নাহয় কিছু লেখা যেত। “তোমার মজার মজার কথা শুনতে কিন্তু আমার বেশ লাগে। বড় হয়ে কিন্তু তোমাকে বড় হতে হবে। আমার বয়সে পৌঁছে আমার মত হাপিত্যেশ করলে তোমার একদম চলবে না। প্রত্যেকটা দিন উপভোগ করে নাও। বড় হলে ছোট থাকার আনন্দ হাজার চেয়েও পাবে না।”
যাদের সাথে দেখা হবার সুযোগ নেই এমন কাউকে লেখা উচিত। “কেমন আছ তাহমিনা? সেই কবে তোমরা এই এলাকা থেকে চলে গেছ। আমি মনে হয় ক্লাস ফোরে পড়তাম। আমাদের খেলার জায়গাটা কিন্তু এখনও একই আছে। একসময় জয়ারাও চলে গিয়েছিল। আমার অনেক নতুন বন্ধু হয়েছলিও পরে। তোমাদের কথা মনে পড়ত না। কোথায় থাক তোমরা কে জানে। আমি কিন্তু এখনও আছি, তবে পাশের বিল্ডিংয়ে। আমার কেন যেন মনে হয় তুমি এখন দেশের বাইরে। সত্যি কি তাই?”
টেন্ডুলকারের কি বিশাল ভক্তই না ছিলাম এককালে। তাকে ইংলিশে লিখে দিব? “বহুদিন তোমার কোন খোঁজ রাখি না টেন্ডুলকার। মাঠে নাম কিনা তাও জানিনা, নাকি মাঠে নামার বয়স চলে গেছে? কি খবর ক্রিকেট দুনিয়ার? একবার স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ভারত ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম মনে আছে? সেই ছিল আমার প্রথম ও শেষ স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাওয়া। আমার চশমাটার কাঁচ ভেঙে পড়েছিল, কি কান্নাই না পেয়ে গেল এত দূরের মাঠ কি করে দেখব ভেবে। কিভাবে কিভাবে করে যেন পরে সামলে নিয়েছিলাম কাঁচটাকে।”
সেই প্রাইমারির গণ্ডি পেরুনোরও আগে রুটিন করে পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত যেই গুন্ডামুখো তাকে বলা যায় কিছু কথা। “তোমার চাহনি খুবই ভয়ংকর ছিল। পরে যখন তোমাকে মাঝে মাঝে দেখেছি, উস্কুখুস্কু ছিলে, আর ভয় লাগত না তখন। তবে জীবনের যেই সময়টাতে দেখতে সবচেয়ে খারাপ ছিলাম, তখনো তুমি আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে মজা পেতে, তোমার ধৈর্য্য আমার চেহারার উপর আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছিল, ধন্যবাদ নিতে পার।”
ইদানিং খুব মনে পড়ছে পিচ্চিকালের হাড় জিরজিরে পলাশ ভাইয়ার কথা। “মনে নেই তোমাকে তুমি করে বলতাম নাকি আপনি করে। প্রায় বিশ বছর হয়ে গেছে। শুনতাম বড় হয়ে যাবার পর তুমি অনেক অসুস্থ থাকতে, ওপেন হার্ট সার্জারির পর তোমাকে আমরা দেখতে গিয়েছিলাম। খুব উত্তেজিত ছিলাম এতগুলো দিন পর তুমি কেমন হয়েছ, আমাকে দেখেই চিনবে কিনা এসব ভেবে। জানো হসপিটালে গিয়ে শুনি তুমি সেদিনই রিলিজে নিয়ে চলে গেছ। সেখান থেকে বড় আপুদের বাসায় গেলাম। ওরা বলল একটু আগেই তোমাকে নিয়ে গিয়েছেন তোমার ভাই। হতাশ লাগছিল খুব। আর কখনো দেখা হয়নি।”
স্যারকে লিখব? ক্লাস নাইন আর টেন অংক করতাম উনার কাছে। “প্রিয় স্যার, সালাম নিবেন। আপনি কেমন আছেন? আমার কথা মনে আছে? সময়ানুবর্তী ছিলেন না একদমই। কিন্তু কত যত্ন করেই না অংক করাতেন। বুঝতে দেরি হলে মাঝে মাঝে মাথার তালুতে হাত দিয়ে দেখতেন ঠাণ্ডা আছে নাকি গরম। কোনরকম বকার কথা মনে পড়ে না। আপনার সাইকেলটা এখন কোথায়?”
আমার একজন গানের টিচারও ছিলেন। মাস শেষে টাকা নেয়ার সময় খুব ইতস্তত করতেন উনি। সম্ভবত এজন্য যে আমি উনার শিক্ষকের মেয়ে। একইরকম করে তো উনাকেও লিখতে পারি, “প্রিয় স্যার, সালাম নিবেন। আপনি কেমন আছেন? আমার কথা মনে আছে? আমি আর গানের চর্চা করিনি। ভাল লাগত না। আপনি কি এখনও গান শেখান? মনে আছে আপনি প্রায়ই বলতেন, স্যার না থাকলে আজকে মানুষ হইতাম না। পিতাগর্বে তখন মনে মনে উচ্ছ্বসিত হতাম খুব।”
অতিপ্রিয় রবীন্দ্রনাথকে লেখার সাহস হবে কিনা বুঝতে পারছি না। “শ্রদ্ধেয় রবিদাদু, তোমার ‘গল্পগুচ্ছ’ আমার অতি অতি পছন্দ। কাবুলিওয়ালার গল্পটা পড়ে আমার কান্না পেয়ে যায়। তোমার গান গুলিও কেমন করে এত অসাধারণ? আর ‘দুই বিঘা জমি’ তো আমার ভাঁজ করে পকেটে পুরে রাখতে ইচ্ছা করে। ওহো আমার জামায় তো পকেট থাকে না। আচ্ছা কি করলে তোমার মত করে লিখতে পারব? আসলে কোনদিন এমনটা আর কেউ পারবে না তাই না? প্রত্যেকটা মানুষই তো আলাদা। তাই কেউ কারো মত হয় না।”
বাসায় প্রথম ইন্টারনেট আসার পর ইটালিয়ান একজন নেটফ্রেন্ড হয়েছিল আমার কিছুদিন। লালচুলো লোকটার নাম লুকা। ইটালির ছবি দেখে খুব আফসোস হত কেন ওইরকম একটা দেশে জন্মালাম না। “হ্যালো লুকা, তোমার শেষ মেইলটার জবাব দিইনি শুধুমাত্র এই কারণে যে ইচ্ছা হচ্ছিল না। সেই যে সুনামি হল, এরপর একদিন হঠাৎ করে মেইল করে লিখেছিলে-আমি তোমাদের ওইদিকে সুনামির কথা জানতে পেরেছি, বন্ধু তুমি ভাল আছ তো? সরি লুকা আমি ভালই ছিলাম কিন্তু কেন যেন উত্তর দিতে ইচ্ছা করেনি। তোমার শেখানো ইটালিয়ান কথাবার্তা সব ভুলে গেছি। মিলানে কি এখন সামার? আশা করি তুমি এবং তোমার মা-ও কুশলে আছ।”
সেই সে হারানো নারিকেল গাছের কাছে লিখলে কি খুব হাসির ব্যাপার হবে? “তোমাকে যেদিন কেটে ফেলা হল, আমি বাথরুমে গিয়ে কি কান্নাই না কাঁদলাম। কলেজে পড়তাম তো, একটা কবিতা ছিল মনে আছে? ‘The Tree At My Window’. তুমি ছিলে আমার জন্য তাই। সেদিনের আগে বুঝতেও পারিনি তোমার জন্য আমার এত টান তৈরি হয়ে গেছে। এখন কিন্তু ভেবে লজ্জা পাই এত বড় বয়সে গাছ নিয়ে আদিখ্যেতা করেছিলাম ভেবে।”
কাউকে পাচ্ছি না কেন? অবাক করে দেয়ার মত খারাপ একজন কোন মানুষ খুঁজেই কি তাহলে চিঠিটা লিখতে হবে? “কেবল খেলার আনন্দের জন্য অন্যের অস্তিত্বকে হত্যাও বুঝি করা যায়? কুশ্রী কোন অপকর্মকে ভুলে থাকার ভান করলেও কি সেই অপকর্ম পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে পাপীর পিছু তাড়া করে না? বিবেকের বিষদাঁত অনেক বেশি ধারালো। ম্যাকবেথের কথা মনে আছে? হাত থেকে রক্তের অদৃশ্য দাগ মোছার জন্য সে পাগলপারা হয়ে গিয়েছিল।”
বরং একটা ভাল মানুষকেই নাহয় লিখলাম। “সততা আর মমতা থাকলে কাউকে অসুখী করা বা নিজের অসুখী হবার ভয় থাকে না তাই না? শুধুমাত্র ভালবাসা দিতে আর নিতে জানলেই জীবনটা অর্থবহ করে তোলা যায়। সৃষ্টিকর্তার কাছে নিশ্চয়ই সবার জন্য কিছু না কিছু আছেই। তাই নয় কি?”
হতে পারে পৃথিবীর আলো দেখেনি এমন কাউকেও কয়েক ছত্র পাঠিয়ে দিলাম। “প্রিয় অনাগত শিশু, জন্মের আগের মুহূর্তগুলো কেমন? আমি মনে করতে পারি না। নিরাপদ আবাস থেকে কাঁটাময় জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছ। উদ্বেগ হয়? হতেই পারে। তবে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে অসীম সম্ভাবনা। অনেক দিকে অনেক পথই খোলা। সুতরাং বেছে নাও। সিনেমায় দেখা আমার খুব পছন্দের একটা কথা বলি তোমাকে, it's the choices that make us who we are. And we can always choose to do what's right. "
জানি কাউকেই লেখা হবে না কিছু। অথচ আকাশের ঠিকানায় পত্র দেয়া কতই না সহজ।
Saturday, August 29, 2009
দুঃখবিলাস
গানগুলো কি করে মনের কথা বুঝতে পারে? আনন্দের কোন গানের কথা মনে পড়ছে না, কিন্তু দুঃখের গান ঠিক যেন প্রাণের কথা বলে। নানান রকম গান। একেকজনের জন্য একেকটা। একেক সময়ের জন্য একেকটা। একেক ধরণের বিষণ্ণতার জন্য একেকটা। মানুষের চরিত্রের মধ্যে দুঃখবিলাসী একটা প্রবণতা আছে। সুযোগ পেলেই সে ইনিয়ে বিনিয়ে মন খারাপের কোন প্রসঙ্গ টেনে আনে। তারপর খানিক্ষণ সেটাকে নিয়ে রগড়ে রগড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চাই কি একটু চোখের পানিও ঝরানো। খারাপ লাগতে মনে হয় ভাল লাগে। কিভাবে কিভাবে যেন আমাদের কাছে ট্র্যাজিক সব কিছু প্রিয় হয়ে যায়। যেই সিনেমাটায় কোন কাছের কেউ মারা যায় যেই গল্পে বিচ্ছেদ থাকে যেই কবিতায় কান্না কান্না কথা সেসবই বেশি করে ভালবাসি আমরা। এমন কেন হবে? দুঃখকেই কেন আমরা বেশি কাছে টানি? মানুষের না সুখের পেছনে ছোটার কথা?
কোন তপ্ত দুপুর, বিবর্ণ গোধুলি বা নির্ঘুম রাতে অদ্ভুত ছন্নছাড়া লাগে। আমরা এক জীবনে কত কিছুই না হারাই। সেই সব হারানো বিষয়গুলো মিছিল করতে করতে একাকী সময়গুলিতে হানা দেয়। বুকের মধ্যে একটা ডিমের খোসা বা মচমচে শুকনো পাতা গজিয়ে যায় যেটাকে কেউ যেন মুঠির মধ্যে নিয়ে দুমড়াতে থাকে। গানেরা তখন সঙ্গী হয়। নিজেকে সবার থেকে আলাদা সবার থেকে দুঃখী ভেবে নিতে এক রকমের গোপন ভাললাগা কাজ করে। তা সত্যিও হতে পারে। কারণ নিজের কষ্টটাই অনুভূত হয়, অন্যেরটা তো কেবল সহানুভূত হওয়া পর্যন্তই।
Preview
কোন তপ্ত দুপুর, বিবর্ণ গোধুলি বা নির্ঘুম রাতে অদ্ভুত ছন্নছাড়া লাগে। আমরা এক জীবনে কত কিছুই না হারাই। সেই সব হারানো বিষয়গুলো মিছিল করতে করতে একাকী সময়গুলিতে হানা দেয়। বুকের মধ্যে একটা ডিমের খোসা বা মচমচে শুকনো পাতা গজিয়ে যায় যেটাকে কেউ যেন মুঠির মধ্যে নিয়ে দুমড়াতে থাকে। গানেরা তখন সঙ্গী হয়। নিজেকে সবার থেকে আলাদা সবার থেকে দুঃখী ভেবে নিতে এক রকমের গোপন ভাললাগা কাজ করে। তা সত্যিও হতে পারে। কারণ নিজের কষ্টটাই অনুভূত হয়, অন্যেরটা তো কেবল সহানুভূত হওয়া পর্যন্তই।
Preview
Tuesday, August 18, 2009
আমার "স্মার্টনেস"
আচ্ছা আমার মত অনেকের কি এমন হয়? মানে এই যে কোন সুন্দর জায়গায় গিয়ে হোঁচট খাওয়া। ধরা যাক কোন ঝলমলে শপিং মল। এখানে চেহারা পলিশ করা হালফ্যাশনের পোশাক পরা তরুণী কিংবা চুলে স্পাইক জাগানো ছেলেপুলে দেখলে নিজেকে কেমন গাধা গাধা মনে হয় কেন? অতি স্মার্ট কিশোরীদের সামনে পড়লে হঠাৎ করে নিজের জামার দৈর্ঘ্যকে বেমানান চুলকে তেল চিপচিপে আর কাঁধের ব্যাগটাকে জীর্ণশীর্ণ মনে হতে থাকে। দামী দোকানে ঢুকলে বৃথাই কোনটাই ঠিক পছন্দ না হবার ভান করি। আমার প্যাতপ্যাতে চাহনি দেখে সবাই এমনিতেই বুঝতে পারে আমি এসেছি উইন্ডো শপিং করতে, এসব কেনার মুরোদ আমার নেই। কোন কিছু আয়ত্বে কুলিয়ে যাবে ভেবে যদি জিজ্ঞেস করেই বসি, দাম শুনে ঢোঁক গিলতে গিলতে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়। সেই সাথে সতর্ক থাকা লাগে কেউ যেন ঢোঁকের শব্দ শুনতে না পায়।
শুধু কি তাই? নানা সময়ে মুখের কথারও কতরকমই না ছিরিছাঁদ। ধরা যাক বাসায় কোন ফোন আসল এবং আমার হাতেই পড়ল। প্রথমেই খুব মিষ্টি করে বলি, “হ্যালো আসসালামু আলাইকুম"”। এরপর স্রোত কোন দিকে যাবে তা নির্ভর করে ওই পাশের ব্যক্তিটি কে তার উপর। সেটা কি শুধু ফোন? সামনাসামনিও তো তাই। বন্ধুজাতীয় কেউ হলে মুখ খুলে বলে ফেলা যায়, “ওই দোস্ত আর জিগাইস না এগুলার কিসুই আমি জাইন্না"”। বাচ্চা টাইপ পাবলিকের সাথে মুখ বাঁকা করে ন্যাকাও, “ওমা তাই নাকি? আমাকে তোমার একতা পুতুল দাও না”! আবার সেকেন্ড পারসনটা যদি হয় কোন বিশিষ্ট আন্টি বা আংকেল তখন কণ্ঠের ফুলঝুরি দেখে কে? “জ্বী আংকেল/আন্টি আমরা ভাল আছি। আপনার শরীর কেমন?...জ্বী দোয়া করবেন।” সেই সাথে নম্রতা ও ভদ্রতার পরকাষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য উপচে পড়া খুশি খুশি একটা ভাব। এই জাতীয় আরোপিত মিষ্টতা নানান সময়ে কাজে দেয়। দেখা গেল টেবিল ভরা পোলাও কোরমা রেজালা। অনেকখানি খাবার পরও যখন চোখের জুলজুলানি থামে না তখন দেবদূতের মত কেউ একজন হয়ত পাতে আরেকটু কিছু তুলে দেয়ার উদারতা দেখাল। এই উদারতাকে পেটুকের মত খালি হাতে নিয়ে নিতে হয়না। নাসিক্যধ্বনির প্রাবল্য এবং উভয়কূল রক্ষা হয় এমন নমনীয় জোরের সঙ্গে “আল্লাহ এত খাব কি করে? আর না।” বলতে হয় এবং অবশ্যই তা চামচটা বাটি থেকে প্লেট পর্যন্ত দূরত্বের অর্ধেকের বেশি পেরিয়ে আসার পর। আরেকটা যেটা আমি প্রায়ই করি সেটা হল আমার মনে খুশির দোলা দিয়ে হোস্টের হাতের চামচ যখন এগিয়ে আসছে তখন হঠাৎ করে কি কারণে যেন ঘুরে অন্যদিকে তাকাই, বেশিরভাগ সময় পায়ে কি যেন সমস্যা হয়। তারপর যখন ঠিক হয়ে বসি লক্ষ্য করি এই ফাঁকে প্লেট রিচার্জ হয়ে গেছে। আর তখন তো “উফ এত খাওয়া যায়?” সুলভ ভঙ্গী করাটা অনেকখানি জলভাত। এগুলো কোনটাই তেমন মুশকিল না। ঝামেলার কাজটা হল চকচকে কোন অফিসের স্মার্ট রিসেপশনিস্টকে ফেস করা। পারতেসি বলতেসি করতেসি বলা মুখে পারছি করছি বা বলছি বলা যে কেন নাভিশ্বাস তোলার মত এতটা প্রাণঘাতী হয়ে পড়ে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা। সুতরাং বুঝতেসি না-কে বোঝা যাচ্ছে না-তে এবং করতেসি-কে হচ্ছে- তে কনভার্ট কর, এটা অনেকটা আরামদায়ক। একই অবস্থা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের চাল্লু ওয়েটার আর সেলসম্যানদের সামনেও। হাই তুলে “মামা কত হইসে” বললে মানইজ্জতের হালুয়া। বরং মুখ টানটান রেখে “বিল” আর “প্রাইস” জানতে চাইতে হয় “এক্সকিউজ মি” সংযোজনপূর্বক। তখন মনে হয় সবাই আমার দিকে চেয়ে বেকুব ভেবে মনে মনে হাসছে। কেমন আচরণ করলে আমরা “পশ” হব তা আমাদের ইংরেজি আদবকেতা দিয়ে মাপজোখ করা কর্তব্য। কাঁটাচামচ ধরা হাতটা পর্যাপ্ত কোণ করে ঘুরলো কিনা, কোকের গ্লাসে চুমুক দিতে শব্দ হয়ে গেল কিনা, সরি থ্যাংকস আর ইট’স ওকে জায়গামত বলা হল কিনা এসব নিয়ে তটস্থ থাকা লাগে আমার মত ভেতো বাঙালিদের। ইংরেজি প্রশ্নের সামনে পড়লে বুকের মধ্যে দ্রিম দ্রিম শব্দ হয় আর টেন্স এন্ড গ্রামার মিলিয়ে ঠিকঠাক জবাব দিয়ে বসতে পারলে যে কি একটা হনু হনু ভাব হয় কি বলব।
আর এসিসূচক সমস্যা তো আছেই। এটার রিমোট কন্ট্রোল কি করে কাজ করে আমি কোনদিনই তা বুঝে উঠতে পারি না। এসি বাড়ানো বা কমানো বলে কিছু আছে কিনা এবং থাকলে তাপের কোন পরিবর্তনটাকে বাড়ানো আর কোনটাকে কমানো বলে তাও জানিনা। ফলে কেউ যদি ঠাণ্ডা লাগছে বা গরম লাগছে বলে টেম্পারেচার বদল করার হুকুম দেয় তখন আমি যতই সহমত হই না কেন বলে ফেলি, নাহ এভাবেই থাকুক। কারো গাড়িতে উঠতে হলে দেখা যায় দরজা হেঁচড়াহেঁচড়ি করছি খুলতে পারছি না। সুতরাং একটু দেরিতে সামনে আসাই ভাল যখন অলরেডি কেউ দরজা খুলে ফেলেছে। এটা আবার বন্ধ করাটাও আরেক যন্ত্রণা। ধুড়ুম শব্দ করে লাগাতে হয় নাহয় ফাঁক রয়ে যায়। উঁচু হিল পরে হাঁটতে পারি না, পেঁচিয়ে পড়ে যাবার যোগাড় হয়। ঘেমে নেয়ে গেলে ব্যাগ ঘেঁটে টিস্যু টাইপের কিছু খুঁজে পাই না। হুট করে ছাতা খুলতে হলে কোথায় যেন আটকে যায়। বোতলের মুখে পানি খেতে গেলে সামনে কেউ থাকলে প্রায়ই ছলকে পড়ে। সিঁড়িতে বা রাস্তায় দুই পায়ের মধ্যে কমপক্ষে একবার ঠোকাঠুকি আমার লাগবেই।
ছেলেদের সামনে তো বটেই, মেয়েদের সামনেও কতই না অপদস্ত লাগে। কবে যে এসব "ক্ষ্যাত" উপসর্গগুলো দূর করতে পারব!
শুধু কি তাই? নানা সময়ে মুখের কথারও কতরকমই না ছিরিছাঁদ। ধরা যাক বাসায় কোন ফোন আসল এবং আমার হাতেই পড়ল। প্রথমেই খুব মিষ্টি করে বলি, “হ্যালো আসসালামু আলাইকুম"”। এরপর স্রোত কোন দিকে যাবে তা নির্ভর করে ওই পাশের ব্যক্তিটি কে তার উপর। সেটা কি শুধু ফোন? সামনাসামনিও তো তাই। বন্ধুজাতীয় কেউ হলে মুখ খুলে বলে ফেলা যায়, “ওই দোস্ত আর জিগাইস না এগুলার কিসুই আমি জাইন্না"”। বাচ্চা টাইপ পাবলিকের সাথে মুখ বাঁকা করে ন্যাকাও, “ওমা তাই নাকি? আমাকে তোমার একতা পুতুল দাও না”! আবার সেকেন্ড পারসনটা যদি হয় কোন বিশিষ্ট আন্টি বা আংকেল তখন কণ্ঠের ফুলঝুরি দেখে কে? “জ্বী আংকেল/আন্টি আমরা ভাল আছি। আপনার শরীর কেমন?...জ্বী দোয়া করবেন।” সেই সাথে নম্রতা ও ভদ্রতার পরকাষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য উপচে পড়া খুশি খুশি একটা ভাব। এই জাতীয় আরোপিত মিষ্টতা নানান সময়ে কাজে দেয়। দেখা গেল টেবিল ভরা পোলাও কোরমা রেজালা। অনেকখানি খাবার পরও যখন চোখের জুলজুলানি থামে না তখন দেবদূতের মত কেউ একজন হয়ত পাতে আরেকটু কিছু তুলে দেয়ার উদারতা দেখাল। এই উদারতাকে পেটুকের মত খালি হাতে নিয়ে নিতে হয়না। নাসিক্যধ্বনির প্রাবল্য এবং উভয়কূল রক্ষা হয় এমন নমনীয় জোরের সঙ্গে “আল্লাহ এত খাব কি করে? আর না।” বলতে হয় এবং অবশ্যই তা চামচটা বাটি থেকে প্লেট পর্যন্ত দূরত্বের অর্ধেকের বেশি পেরিয়ে আসার পর। আরেকটা যেটা আমি প্রায়ই করি সেটা হল আমার মনে খুশির দোলা দিয়ে হোস্টের হাতের চামচ যখন এগিয়ে আসছে তখন হঠাৎ করে কি কারণে যেন ঘুরে অন্যদিকে তাকাই, বেশিরভাগ সময় পায়ে কি যেন সমস্যা হয়। তারপর যখন ঠিক হয়ে বসি লক্ষ্য করি এই ফাঁকে প্লেট রিচার্জ হয়ে গেছে। আর তখন তো “উফ এত খাওয়া যায়?” সুলভ ভঙ্গী করাটা অনেকখানি জলভাত। এগুলো কোনটাই তেমন মুশকিল না। ঝামেলার কাজটা হল চকচকে কোন অফিসের স্মার্ট রিসেপশনিস্টকে ফেস করা। পারতেসি বলতেসি করতেসি বলা মুখে পারছি করছি বা বলছি বলা যে কেন নাভিশ্বাস তোলার মত এতটা প্রাণঘাতী হয়ে পড়ে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা। সুতরাং বুঝতেসি না-কে বোঝা যাচ্ছে না-তে এবং করতেসি-কে হচ্ছে- তে কনভার্ট কর, এটা অনেকটা আরামদায়ক। একই অবস্থা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের চাল্লু ওয়েটার আর সেলসম্যানদের সামনেও। হাই তুলে “মামা কত হইসে” বললে মানইজ্জতের হালুয়া। বরং মুখ টানটান রেখে “বিল” আর “প্রাইস” জানতে চাইতে হয় “এক্সকিউজ মি” সংযোজনপূর্বক। তখন মনে হয় সবাই আমার দিকে চেয়ে বেকুব ভেবে মনে মনে হাসছে। কেমন আচরণ করলে আমরা “পশ” হব তা আমাদের ইংরেজি আদবকেতা দিয়ে মাপজোখ করা কর্তব্য। কাঁটাচামচ ধরা হাতটা পর্যাপ্ত কোণ করে ঘুরলো কিনা, কোকের গ্লাসে চুমুক দিতে শব্দ হয়ে গেল কিনা, সরি থ্যাংকস আর ইট’স ওকে জায়গামত বলা হল কিনা এসব নিয়ে তটস্থ থাকা লাগে আমার মত ভেতো বাঙালিদের। ইংরেজি প্রশ্নের সামনে পড়লে বুকের মধ্যে দ্রিম দ্রিম শব্দ হয় আর টেন্স এন্ড গ্রামার মিলিয়ে ঠিকঠাক জবাব দিয়ে বসতে পারলে যে কি একটা হনু হনু ভাব হয় কি বলব।
আর এসিসূচক সমস্যা তো আছেই। এটার রিমোট কন্ট্রোল কি করে কাজ করে আমি কোনদিনই তা বুঝে উঠতে পারি না। এসি বাড়ানো বা কমানো বলে কিছু আছে কিনা এবং থাকলে তাপের কোন পরিবর্তনটাকে বাড়ানো আর কোনটাকে কমানো বলে তাও জানিনা। ফলে কেউ যদি ঠাণ্ডা লাগছে বা গরম লাগছে বলে টেম্পারেচার বদল করার হুকুম দেয় তখন আমি যতই সহমত হই না কেন বলে ফেলি, নাহ এভাবেই থাকুক। কারো গাড়িতে উঠতে হলে দেখা যায় দরজা হেঁচড়াহেঁচড়ি করছি খুলতে পারছি না। সুতরাং একটু দেরিতে সামনে আসাই ভাল যখন অলরেডি কেউ দরজা খুলে ফেলেছে। এটা আবার বন্ধ করাটাও আরেক যন্ত্রণা। ধুড়ুম শব্দ করে লাগাতে হয় নাহয় ফাঁক রয়ে যায়। উঁচু হিল পরে হাঁটতে পারি না, পেঁচিয়ে পড়ে যাবার যোগাড় হয়। ঘেমে নেয়ে গেলে ব্যাগ ঘেঁটে টিস্যু টাইপের কিছু খুঁজে পাই না। হুট করে ছাতা খুলতে হলে কোথায় যেন আটকে যায়। বোতলের মুখে পানি খেতে গেলে সামনে কেউ থাকলে প্রায়ই ছলকে পড়ে। সিঁড়িতে বা রাস্তায় দুই পায়ের মধ্যে কমপক্ষে একবার ঠোকাঠুকি আমার লাগবেই।
ছেলেদের সামনে তো বটেই, মেয়েদের সামনেও কতই না অপদস্ত লাগে। কবে যে এসব "ক্ষ্যাত" উপসর্গগুলো দূর করতে পারব!
বৃষ্টি বৃষ্টি
যার যা নেই তাই পেয়ে গেলে উচ্ছ্বাস হয় বলে জানি। অথচ আমরা এই বৃষ্টির দেশের মানুষেরা প্রতিটা বৃষ্টিতেই কেমন ছেলেমানুষের মত মেতে উঠি। এই যে এই ভর বিকালে হঠাৎ করে তুমুল ঝাপটা বয়ে গেল, এই নিয়ে সদাব্যস্ত মনগুলো একটু কি থমকে দাঁড়ালো না? যার মনে অনেক আনন্দ সে ভেবে পেল তার সাথে সন্ধি করে আকাশ আজ প্রকৃতিকে ধুয়ে মুছে সাজিয়ে দিল। যার হৃদয়ে ক্ষরণ সে বুঝে নিল তার চোখের জল লুকাতে এই বারিধারার বর্ষণ। কেমন করে মাটি থেকে সাগর থেকে জল শুষে গিয়ে হাজার মাইল উপরে উঠে পরস্পরকে সইতে না পেরে ধাক্কাধাক্কি করে ফের আদিনিবাসে নেমে আসে এই ব্যাখ্যায় মন ভরানোর সময় কোথায়? প্রয়োজনটাই বা কি? বৃষ্টি বৃষ্টিই। আর এই প্রিয় বৃষ্টির প্রিয় একটা কাজ হল সে একবার হলেও অনেক পুরানো কোন স্মৃতিকে নাড়িয়ে দিয়ে যাবেই। এখন তুমি নিজেই বুঝে নাও এই অবসরে মন ভাল করে নেবে নাকি খারাপ।
Monday, August 17, 2009
জীবন একটা পুঁতির মালা
একটা বিজ্ঞাপন আছে, আপনার জীবনের গল্পগুলোই আমাদের প্রেরণা। কথাটায় একটু খাদ রয়ে গেছে। বলা উচিত ছিল আপনার জীবনের সুন্দর গল্পগুলোই আমাদের প্রেরণা। অন্যের অসুন্দর গল্পকে কেউ প্রেরণা হিসেবে নেয় না। যখনি এই বিলবোর্ডের দিকে চোখ পড়ে সাথে সাথেই রাস্তার বাকি মানুষগুলোর দিকে নজর চলে যায়। প্রত্যেকটা মানুষই না জানি কত গল্প পকেটে পুরে হেঁটে চলেছে। নিজের গল্প দিয়ে গাঁথা অদৃশ্য মালা থেকে একটা বা একেকটা পুঁতি খুলে দেখালেই হয়ত চমকে উঠব। কোন পুঁতি বর্ণহীন স্বচ্ছ, কোনটা ধুলো মাখানো নোংরা, কোনটা আবার নানা রঙে ঝলমলে। কোনটা একটু ছোট, কোনটা অনেক বড়। হতে পারে বাজারের মালার মত রঙের সাথে রঙের আকারের সাথে আকারের সামঞ্জস্য বজায় নেই অথচ এই অনিয়মিত বিন্যাসই এখানে বিন্যস্ততা। আমরা সময়ে অসময়ে মালাটা বের করে গোপনে হাতড়ে হাতড়ে দেখি। পুঁতিগুলোর উপর হাত বুলাই। নিজেদের কৃতিত্ব বা ভুল কিংবা বিধাতার লীলাখেলার নমুনা আমাদের ছোটখাট জীবনে কি কি ছাপ রেখে গেছে তা নিয়ে পুনর্বার মস্তিষ্ককে ব্যতিব্যস্ত করি। এই মুহূর্তে বারান্দার বাইরে রাস্তায় যেই পোড় খাওয়া চেহারার প্রৌঢ়া বসে আছেন সাহায্যের আশায় না জানি তার গল্পের ঝুলিতে কি কি আছে। পাশের বাসার তেজোদীপ্ত বাচ্চা মেয়েটারও নিশ্চয়ই এতদিনে দেখা আর বোঝা হয়ে গেছে পৃথিবীর অনেক কিছুই। এভাবে করেই দিনে দিনে মালায় পুঁতির সংখ্যা বাড়তে থাকে। অদ্ভুত ব্যাপার হল প্রত্যেকটা পুঁতিকেই আমরা একইভাবে যত্ন করে পেলে পুষে রাখি। চকচকেগুলোকেও যেমন, ম্যাড়ম্যাড়েগুলোকেও তেমনি। কারণ আমরা জানি কিছুমাত্র বৈষম্য করতে গেলেই সুতো ছিঁড়তে হয় নতুবা পুঁতি ভেঙে জায়গাগুলো ফোকলা করে নিতে হয়। কিন্তু তাহলে কি আর তাকে সত্যিকার মালা বলা চলে?
Monday, April 27, 2009
ইভানা
মৃত্যুর সময় ইভানার বয়স ছিল ছয়। স্কুলে ভর্তি হয়েছিল হয়ত ওই বছর ঠিক মনে পড়ছে না। ওদের বাসা ছিল চিটাগাং এর কদমতলীতে। বেশ সুন্দর একটা ছোট বাসা, আশপাশের জায়গাটা বেশ সুন্দর। ওর অসুখ ধরা পড়ার পর জীবনে প্রথমবারের মত ঢাকায় আসে ইভানা। খালা খালু তাদের দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাদের বাসায়ই ওঠেন। উদ্দেশ্য ইভানাকে ডাক্তার দেখানো। ঢাকায় এসে নিশ্চিত হওয়া গেল ওর ব্লাড ক্যান্সার। তখনো সম্ভবত খুব খারাপ অবস্থায় পৌঁছেনি অসুখটা। পিজিতে ভর্তি করা হল ওকে। খালা আর ইভানার অস্থায়ী বাসস্থান হল হাসপাতাল। খালু কখনো আমাদের বাসা কখনো হাসপাতালে থাকতেন। ইভানার ভাই রিংকু ছিল আমার মাত্র মাস দুয়েকের বড়। ফলে ওর সাথে আমার সখ্য ছিল খুব। আমরা দুইজনই সেবার নতুন ক্লাস ফোরে উঠেছি। জানুয়ারি মাস। রিংকু আমাদের বাসায় বেশ কিছুদিন থাকবে, আমার আনন্দের সীমা ছিল না। আমাদের দিনকাল খুব আনন্দে কাটতে লাগল। নাটকের কল্যাণে ব্লাড ক্যান্সার নামটা তখন জানা ছিল কিন্তু ইভানার এই অসুখ হয়েছে আমাদের ছোটদেরকে কেউ এটা বলেনি। আর রোগটা এত বেশি বিস্তৃত হয়ে পড়েছে একথা তখনো কেউ জানত না। ফলে এমন একটা অসুখ নিয়ে বাচ্চা একটা মেয়ে দিনের পর দিন সাদা বিছানায় পড়ে আছে বিষয়টা আমাদের দুইজনকে মোটেও ভাবিত করেনি। মনে আছে আমার আর রিংকুর প্রতিটা দিন ছিল খুশির। এতদিন একসাথে থাকা হয়নি আগে কখনো। নানুর বাড়িতে মাত্র দুই দিনের জন্য দেখা হত, খেলেধুলে মন ভরতো না। এখন ভাবলে অবাক লাগে সেই সময়টায় আমাদের প্রিয় খেলনা ছিল এক গাদা সুঁইবিহীন নানা আকৃতির সিরিঞ্জ। ইভানার ছোটখাট শরীরে ওই বিশাল বিশাল সিরিঞ্জ দিয়ে ওষুধ ঢোকানো হত। কিন্তু এসব বাসায় কেন বয়ে আনা হত বা আমাদের হাতেই বা অবলীলায় কেন দেয়া হত জানিনা। কয়েকবার ওকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। দেখতে খারাপ হয়ে গিয়েছিল ইভানা। কিন্তু স্বভাবসুলভ মজার মজার কথা বলত তখনো। বেশ কিছুদিন ওষুধপত্র চলার পর বাসার উদ্দেশ্যে ওরা ঢাকা ছাড়ে। জানা গিয়েছিল রোগটা সারবে না। তার অল্প কিছুদিন পরেই ওর মৃত্যুর খবর আসে। সেই ষোল বছরেরও বেশি সময় আগের অনেক কিছুই স্পষ্ট মনে আছে। পিজি হাসপাতাল, ওদের আসার ঠিক আগে আগে আমার জন্মদিনের কেকের রঙ, খেলার কাজে লাগানো আমাদের ব্যাগ ভরা নানা রঙের কাগজের রকেট। আমি আর রিংকু একটা গান শুনে খুব হাসতাম সুরসহ সেই গানটার লাইনগুলো মনে আছে, কোন এক শুক্রবারে আমরা কিভাবে বসে দুইজন স্যুপ খেতে খেতে টিভিতে অলিভার টুইস্ট দেখেছিলাম একথা মনে আছে, এমনকি তার মাঝেই একদিন আমি দুইটা স্ট্যাম্প কিনেছিলাম গ্রানাডার তাদের ডিজাইনও আমার খুব ভাল মনে আছে। এমন অনেক ছোটখাটো কথাবার্তা পরিষ্কার ছবির মত মনে আছে। এসব কিছুর পাশে সবচেয়ে অস্পষ্ট ছবি ইভানা নিজে। শুধু একবার কোন এক অনুষ্ঠানে খালা বলেছিলেন, আজকে ইভানা থাকলে তোদের মতই শাড়ি পরে ঘুরত। ওই মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে ওকে কল্পনায় বসালাম, পাছে খালার কাছে ধরা পড়ি আমি ওকে মনে রাখিনি। শ্যামলা, মাথার সাথে লেগে থাকা ছোট চুল, ঠোঁট বেঁকে পড়া হাসি, আবছা চেহারাটায় কি কি ছিল তা মনে আছে অনেকটা তথ্যের মত করে, কিন্তু পুরো মানুষটাকে দাঁড় করাতে পারি না কিছুতেই। মনেও পড়ে না এমন কেউ আদৌ ছিল। মৃত মানুষরা কত সহজেই না স্মৃতি থেকে হালকা হতে থাকে, আর এক সময় হয়ে পড়ে শূণ্য। খুব কাছের মানুষরাও বিশেষ দিবস ছাড়া তেমন একটা মনে রাখে না। অলস দুপুর বা বিষণ্ণ বিকালে কখনো দীর্ঘশ্বাস হয়ে হারানো আপনজন ভেসে আসে। একটু পরেই বাস্তবতার টোকায় ফিরে আসতে হয়। হয়ত বেঁচে থাকার জন্য, জীবনের স্থবিরতা এড়ানোর জন্য এটাই জরুরী।
Saturday, February 21, 2009
রাত নির্ঘুম, বসে আছি আমি
অনেক রাত হয়েছে। আমার খুব সহজে ঘুম পেয়ে যায়। আজকে কেন যেন চোখের দুই পাতার মধ্যে আকর্ষণ নেই। সেই সাথে মাথাটাও ফাঁকা। গভীর রাতে হালকা চালের বই পড়া আমার জন্য ভাল। হুমায়ূন আহমেদের একটা বই পড়ছিলাম সেটাও ভাল লাগছেনা চালিয়ে যেতে। সত্যি কথা বলতে কি একটু ভয় ভয় লাগছিল। গভীর রাতে বই পড়ে বা সিনেমা দেখে ভয় পাওয়ার সাহস আমার নেই। সমস্যা হল কি করব বুঝে উঠতে পারছিনা। দুম করে যে খাতা খুলে বসলাম এটাই বা কি করে এগিয়ে নেব জানি না। ঠিক এই সময়ে কত জায়গায় কত জন জেগে আছে! কারো মন ভাল কারো মন খারাপ কেউ হয়ত আমার মত মাঝামাঝি। প্রকৃতি দেখতে পারলে ভাল লাগত। পুরানো বাসাটার কথা মনে পড়ছে। সেখানে উঁচুতলায় বিশাল আকাশ দেখা যেত। ভাল না লাগলে লাগোয়া বাচ্চা বারান্দায় বসে পড়লেও চলত। এখানে জানালায় আকাশ তো মন ভরে দেখা যায়ই না, বারান্দার নাগাল পেতে হলেও অভিভাবক পাড়া ডিঙিয়ে যেতে হবে। সুতরাং নিজের ঘরের মধ্যেই ঘুরপাক খাওয়া শ্রেয়। বুঝতে পারছি শুয়ে পড়া উচিত। নতুবা সকালে গা তোলা মুশকিল হয়ে যায়। ধাড়ি মেয়ের মাঝসকালে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে বিছানা ছাড়াটা পরিবারের চোখে দৃষ্টিকটু। যখনই শুই না কেন ঠিক সময়ে গাত্রোত্থান করতে হবে। ফলে ঘুমটা ঠিকমত হয়না। এরকম কয়েকদিন চললে চোখের নিচে খানিকটা কালো হয়ে আসে। কিছু বছর আগে হলেও চোখের কোলে কালচে দেখা গেলে সমব্যাথী কেউ কেউ জানতে চাইত রাতে ঘুম হয়না কিসের চিন্তায়। আঁতেল টাইপ কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি জানিয়ে দিতাম না যে ভাই আমি সময়মতই ঘুমাই, জন্ম থেকে আমার চোখই এমন। বরং একটা ভাব ধরতাম যেন আসলে আমার মনে অনেক দুশ্চিন্তা, তোমরা কেউ বুঝবে না আমার বুকে কত পাথর চাপা কষ্ট। দুঃখের কথা হল আজকাল কেউ কিছু প্রশ্নও করে না। যেন বড় মেয়েদের পড়াশোনা বা টেনশানের কারণে রাত জাগতেই হয় তাই চোখের নিচে কালি পড়ে যেতেই পারে।
আমি ঠিক করলাম যখন মাথা ধরবে বা ঘুম পাবে তখন শুতে যাব, তার আগে না। জিনিসটা শীঘ্রই হবে। সুতরাং এই অল্প সময়টাতে সুন্দর কিছু ভাবা যায়। সুন্দর না ভাবতে চাইলে খারাপ কিছুও ভাবা যায়। খারাপ কোন কিছু মনে আনতে চাইলে কিছু ছাড়া ছাড়া বিষয় সামনে আসে। বিচ্ছিরি কোন বস্তু নৃশংস কোন দৃশ্য সবকিছুই আসে আলাদা আলাদা। অথচ সুন্দর কিছু ভাবতে গেলেই চলে আসে একটা ধারাবাহিক ছবি। তৈরি হয় একটা গল্প। সেই সুন্দর কাহিনীগুলোতে মানুষ নিজেকে অংশীভূত করে ফেলে। এর কারণ কি এই যে আমরা সুন্দরকে ভালবাসি, তাকে ধারণ করতে চাই নাকি আমরা সুন্দরের অভাবে আছি বলে স্বপ্নে তা-ই ফিরে ফিরে আসে? হবে এর মাঝে কোন একটা। বা তৃতীয় কোন কারণ। আমি রাত কাটানোর জন্য এই উচ্চমার্গীয় প্রশ্নটার উত্তর হাতড়াতে পারি। উদ্ভট কথা ভেবে ফেলেও রাখতে পারি। কারণ আমার চোখের ভেভরের কোন একটা অংশ বিদ্রোহ করছে। এবার বিশ্রামে পর্যবসিত হওয়া উচিত। কম্পিউটার অফ করার ঝক্কিকর কাজটা এখন করতেই হবে। তাছাড়া অর্থহীন লাগামছাড়া কথাবার্তা কতক্ষণই বা চালিয়ে যাব। নেহায়েত নিজের খাতা বলে যা খুশি তাই করে যাচ্ছি।
অনেক অনেক দিন পর লিখতে বসলাম। পুরোপুরি আবর্জনা হলেও তোয়াক্কা করতে চাচ্ছিনা। সুস্থ মস্তিষ্কে পড়ে দেখে যদি বিরক্ত হই ধরে নেব এটা খাতার পেছনের রাফের পাতা ছিল। ছিঁড়ে গিয়েছিল বলে সামনে গুঁজে রেখেছি।
আমি ঠিক করলাম যখন মাথা ধরবে বা ঘুম পাবে তখন শুতে যাব, তার আগে না। জিনিসটা শীঘ্রই হবে। সুতরাং এই অল্প সময়টাতে সুন্দর কিছু ভাবা যায়। সুন্দর না ভাবতে চাইলে খারাপ কিছুও ভাবা যায়। খারাপ কোন কিছু মনে আনতে চাইলে কিছু ছাড়া ছাড়া বিষয় সামনে আসে। বিচ্ছিরি কোন বস্তু নৃশংস কোন দৃশ্য সবকিছুই আসে আলাদা আলাদা। অথচ সুন্দর কিছু ভাবতে গেলেই চলে আসে একটা ধারাবাহিক ছবি। তৈরি হয় একটা গল্প। সেই সুন্দর কাহিনীগুলোতে মানুষ নিজেকে অংশীভূত করে ফেলে। এর কারণ কি এই যে আমরা সুন্দরকে ভালবাসি, তাকে ধারণ করতে চাই নাকি আমরা সুন্দরের অভাবে আছি বলে স্বপ্নে তা-ই ফিরে ফিরে আসে? হবে এর মাঝে কোন একটা। বা তৃতীয় কোন কারণ। আমি রাত কাটানোর জন্য এই উচ্চমার্গীয় প্রশ্নটার উত্তর হাতড়াতে পারি। উদ্ভট কথা ভেবে ফেলেও রাখতে পারি। কারণ আমার চোখের ভেভরের কোন একটা অংশ বিদ্রোহ করছে। এবার বিশ্রামে পর্যবসিত হওয়া উচিত। কম্পিউটার অফ করার ঝক্কিকর কাজটা এখন করতেই হবে। তাছাড়া অর্থহীন লাগামছাড়া কথাবার্তা কতক্ষণই বা চালিয়ে যাব। নেহায়েত নিজের খাতা বলে যা খুশি তাই করে যাচ্ছি।
অনেক অনেক দিন পর লিখতে বসলাম। পুরোপুরি আবর্জনা হলেও তোয়াক্কা করতে চাচ্ছিনা। সুস্থ মস্তিষ্কে পড়ে দেখে যদি বিরক্ত হই ধরে নেব এটা খাতার পেছনের রাফের পাতা ছিল। ছিঁড়ে গিয়েছিল বলে সামনে গুঁজে রেখেছি।
Subscribe to:
Posts (Atom)