ঠিক বিশ বছর আগের এই দিনটাতে ফিরে যাবার চেষ্টা করলাম। একেবারেই পরিষ্কার না, ভাল লাগছে এই ভেবে যে এখনও ততখানি বুড়ো হয়ে যাইনি যে বিশ বছর আগের দিকে তাকিয়ে নিজেকে মোটামুটি বড় দেখব। না না মনে পড়ছে তো কিছু কিছু, খুশি হলাম, এখনও ততটা বয়স হয়ে যায়নি যে স্মৃতিশক্তি ঝাপসা হবে। সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী বালিকা ক্লাসে কথা বলার অপরাধে পিটুনি খেয়েছিলাম। ওই বছরেরই কোন এক দিনে, হতে পারে এই তারিখই। তারপর পর পর তিন দিন আমাকে স্কুলে দিয়ে আসা হলে একটু পর আমি গেট দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে একা একা বাসায় ফিরেছি, কেমন যেন বমি বমি পেত। একথা স্পষ্ট মনে করতে পারি। বাসা থেকে স্কুল ছিল হাঁটা পথে মিনিট আট দশেক। এখন ভাবলে ভয় হয়। যদি কেউ আমাকে পথের মাঝ থেকে তুলে কোথাও বিক্রি করে দিত? কোন ‘ছেলেধরা’। আজকে কোথায় থাকতাম?
দশ বছর আগের এই সময়টা ছিল এককথায় অসাধারণ। ক্লাস টেন, আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়। সারাদিন ক্লাসে বসে হাসাহাসি। এস এস সির পড়াগুলোও ভালই ছিল। একদিন বিকালে আমি আর আম্মু মার্কেটে যাবার জন্য রিকশা নিয়েছি। আরামবাগের কাছে উল্টোদিক থেকে জোরেসোরে আসা একটা বাস আরেকটু হলে আমাদের রিকশাকে ধাক্কা দিয়ে দিচ্ছিল। আমরা হতভম্ব। একদম শেষ মুহূর্তে বাসটা কেমন করে যেন থেমে যায়। সত্যি যদি ধাক্কাটা লাগত? বাঁচতাম হয়ত কিন্তু কেমন হয়ে? কে জানে।
একবছর আগের এই দিনটা বছরের অন্য অনেক দিনের মত উপভোগ্য ছিল না। আমার সারা গায়ে-মুখে তখন জলবসন্তের জলকেলি। স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি ছিল গুটিকার ঘনত্ব। কোত্থেকে যেন শুনে নিয়েছিলাম যার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা যত বেশি তার বসন্তগোটার সংখ্যা তত বেশি হয়। এই শুনে সুখী হবার সু্যোগ ছিল না জ্বর আর ব্যথায়। একটা সময়ে যখন চোখ লাল হয়ে জ্বালা শুরু হয়ে যায় আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম আমার চোখের মণিতে আক্রমণ হয়েছে এবং আমি জানতাম চোখের মণিতে বসন্ত মানেই আমি অন্ধ হয়ে যাব। মনে পড়ে কেমন প্রচণ্ড একটা আতংক কুঁকড়ে দিয়েছিল আমাকে। কেমন থাকতাম আজকে আমি, যদি সত্যিই চোখ হারাতাম?
একমাস আগের এই দিনটাই নাহয় ধরলাম। এখনও জানি না, কিন্তু হতেও তো পারে ঠিক এই সময়টাতে আমি অল্পের জন্য কিছু একটা থেকে অনের বড় বাঁচা বেঁচে গেছি, বা একটুর জন্য কিছু একটা থেকে নিজেকে শেষ রক্ষা করতে পারিনি। কিসের পরিণতি কি, তা বুঝতে কিছুটা সময় তো লেগেই যায়।
এমন কি হয় না, কয়েক দিন আগে করে ফেলা নেহায়েত খামখেয়ালী একটা কাজ কাউকে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ খুঁজে পাইয়ে দিল। কিংবা এক মিনিটের ভুলে জীবনভর পস্তাতে হল। আমরা যখন জন্মাই আমাদের সাথে ছুটে চলার জন্য জেগে উঠে অনেকগুলি সমান্তরাল সম্ভাবনা। একমুহূর্তের একটা সিদ্ধান্ত বা একপলকের একটা দৈব ঘটনায় নির্ধারিত হয়ে যায় জীবনের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি। সমান্তরাল পথগুলোর একটাতে আমরা হাঁটা ধরি। সেখানেও তৈরি হয় আবার আরো কিছু নতুন সমান্তরাল সারি। তার থেকে আবারও টিকে থাকে কোন একটা। আর আমাদের ‘হলেও হতে পারত’ জীবন বা জীবনগুলোর সম্ভাবনা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। ‘নিয়তি’ চিরকালই একটা রহস্য রয়ে গেল।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
3 comments:
"আমরা যখন জন্মাই আমাদের সাথে ছুটে চলার জন্য জেগে উঠে অনেকগুলি সমান্তরাল সম্ভাবনা। একমুহূর্তের একটা সিদ্ধান্ত বা একপলকের একটা দৈব ঘটনায় নির্ধারিত হয়ে যায় জীবনের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি। সমান্তরাল পথগুলোর একটাতে আমরা হাঁটা ধরি। সেখানেও তৈরি হয় আবার আরো কিছু নতুন সমান্তরাল সারি। তার থেকে আবারও টিকে থাকে কোন একটা। আর আমাদের ‘হলেও হতে পারত’ জীবন বা জীবনগুলোর সম্ভাবনা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।"
চমৎকার বলেছেন......
ঠিক বুঝতে পারি না আসলে নিয়তি আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে নাকি আমরা নিয়তিকে। কিংবা কে জানে হয়ত একেক সময় একেকটা সত্য।
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ রাফি।
Post a Comment