ছোটবেলায় নতুন ক্লাসে উঠলে একসাথে অনেকগুলো খাতা কেনা হত। খাতাগুলো হত একই ডিজাইনের, কেবল রঙের পার্থক্য। একেকটা বিষয়ের জন্য একেক রং। সেই খাতায় লেখা শুরু করাটা কি আনন্দই না ছিল। আমার খুব পছন্দের একটা খাতা ছিল ক্লাস টুয়ের নীল টমি খাতা। মোটা মলাটের খাতার উপর একটা আদুরে বিড়াল ছিল বলে মনে মনে এমন নাম। সাদা বিড়ালের মায়া মায়া চোখ। খুব সুন্দর ছিল দেখে সেটাকে বানালাম ইংরেজি খাতা। স্কুলে পড়ার সময় ইংরেজি প্রিয় ছিল, সেজন্য নিজেকে স্মার্টও ভাবতাম। অনেকদিন পর আজ সন্ধ্যায় টমি খাতাটার কথা মনে পড়ে নস্ট্যালজিক হয়ে গেলাম। সেই সাথে মনে পড়ল হলুদ খাতাটাকেও, আমার কবিপ্রতিভা যেখানে আবাদ হত। ক্লাস ফোর থেকে ছড়া লিখতে, আর অবসরে সেসব পড়ে মুগ্ধ হতে শুরু করেছিলাম। এই চর্চা চলেছিল মনে হয় বছর তিন চারেক হবে। প্রথম খাতাটাই ছিল হলুদ খাতাটা। মনে আছে ছোট ছোট চিরকুট পদ্য জমে ফুলে উঠেছিল বেশ। কি করে যে হারিয়ে ফেললাম।
মেলা থেকে কেনা খেলনাগুলোর মধ্যে কোন কোনটা বিশেষ ভালবাসা পেত। চাইনিজ দেখতে একটা পুতুল অনেকদিন ছিল আমার কাছে। জানি না কবে থেকে নেই হয়ে গেল। আর একটা কাঠের হাতি এখনো আছে, ওর খাবার ছিল আনারসের মাথার ঝুড়িগুলো। অনেকদিন টিকে ছিল প্লাস্টিকের পশুর একটা সেট। ব্যাটারিওয়ালা মেম পুতুলটার কথা তো না বললেই না। আমি মেম পুতুল বলতাম না। এই নামটা জানা ছিল না, পরে বই পড়ে জেনেছি। পুতুলটা মামার দেয়া। নাম ছিল তুলতুল। গায়ে গোলাপি উলের পোশাক আর টুপি। শান্ত স্বভাব, কখনোই বিরক্ত করেনি।
জীবনের প্রথম গল্পের বইটা অসাধারণ ছিল। ঠাকুরমার ঝুলি। ক্লাস ওয়ানের কথা সেটা। বইটা হারিয়েছি। ওই অসাধারণ গন্ধ আর কোন কিছুতে নেই। ছিল ডালিমকুমার, পঙ্কাবতী আর দৈত্যের গল্প। বাজারে বহু ঠাকুরমার ঝুলি আছে। কিন্তু ঠিক ওই বইটা অনেক খুঁজেও কোথাও পাইনি আমি আর।
এমন আরো কত কিছু। আজকে কেউ নেই।
সত্যি কথা বলতে কি এতদিন পর আমি এদের কাউকেই সত্যিকার অর্থে মিস করি না। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ কেমন যেন মন টানে। খুব হাতে নিতে ইচ্ছা করে টমি খাতা কিংবা ঠাকুরমার ঝুলিটাকে। একটু শুধু আঙুল বোলানো। চিরতরে হারিয়ে গিয়ে এরা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে এই নিছক 'জিনিস'গুলোকে আমি ভালবাসতাম।
অনেককাল পাশে থাকা বস্তুগুলোর সাথেও অজান্তে কি করে যেন ভালবাসা হয়ে যায়। ওরা কখনোই স্বেচ্ছায় ছেড়ে যায় না, আমরাই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ওদেরকে দূরে সরিয়ে দিই। একদিন যখন হাত বাড়াই আর খুঁজে পাই না, অসহায় একটা অনুভূতি হয়। মানুষের বেলায়ও কি এমন?
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment