Tuesday, September 1, 2009

পত্র দিও...

ভাবলাম আমিও একটা চিঠি লিখি। চিঠি না ঠিক, ছোট্ট কোন চিরকুট। কলমে লিখব নাকি পেন্সিলে? সাদা নাকি রুল টানা কাগজে? খাম থাকবে কি থাকবে না? মনে মনে লিখে আকাশের ঠিকানায় ছেড়ে দিলেই হয়। লেখাও হল আবার কেউ পড়তেও পেল না। কিন্তু কাকে লিখি?

মা-কে লিখব একটা? “প্রিয় আম্মু, জীবনভর তো তোমাকে কম জ্বালাতন করলাম না, তবু কখনো মুখ ফিরাওনা। তার জন্য আমি কোন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে যাব না কখনো। অসম্ভব কাজ কি আর করা যায়? তুমি একদিন অনেক বুড়ো হয়ে যাবে, একদিন থাকবে না এটা ভাবলে আমার চেতনা থেমে যেতে চায়। প্লিজ এটা কি বন্ধ করা যায় না?”

সদা নির্লিপ্ত পিতাকে লেখা যায়, “আব্বু, আমার জন্য তোমার যত মায়া সেটা হয়ত সব বাবাদের মধ্যেই আছে। তবে আমি জানিনা সবাই তোমার মত করে গুণে গুণে মেয়ের পছন্দ অপছন্দ হিসাব করে কিনা। ছোটবেলায় আমি ভাবতাম আমার বাবা যদি তুমি না হয়ে অন্য কেউ হত আমি তার সাথে মোটেও কথা বলতাম না, বরং পথে কোথাও তোমার সাথে দেখা হলে আমি তোমাকেই বাবা ডাকতাম। আমার এই ধারণা না এখনও একই আছে। আমার অতি তুচ্ছ বিষয়গুলিতেও তুমি যেভাবে মনোযোগ দাও যে অবাক লাগে। আমার নিজেরই মনে থাকে না আমি কবে কি বলেছিলাম বা চেয়েছিলাম। তুমি দেখি ঠিকই মনে রাখ। সবাইকে একটা করে এমন বাবা দিয়ে দেয়া হোক।”

বুঝুক আর না বুঝুক, সাড়ে পাঁচ বছরের চাচাতো বোনটা আরেকটু ভাল করে পড়তে পারলে নাহয় কিছু লেখা যেত। “তোমার মজার মজার কথা শুনতে কিন্তু আমার বেশ লাগে। বড় হয়ে কিন্তু তোমাকে বড় হতে হবে। আমার বয়সে পৌঁছে আমার মত হাপিত্যেশ করলে তোমার একদম চলবে না। প্রত্যেকটা দিন উপভোগ করে নাও। বড় হলে ছোট থাকার আনন্দ হাজার চেয়েও পাবে না।”

যাদের সাথে দেখা হবার সুযোগ নেই এমন কাউকে লেখা উচিত। “কেমন আছ তাহমিনা? সেই কবে তোমরা এই এলাকা থেকে চলে গেছ। আমি মনে হয় ক্লাস ফোরে পড়তাম। আমাদের খেলার জায়গাটা কিন্তু এখনও একই আছে। একসময় জয়ারাও চলে গিয়েছিল। আমার অনেক নতুন বন্ধু হয়েছলিও পরে। তোমাদের কথা মনে পড়ত না। কোথায় থাক তোমরা কে জানে। আমি কিন্তু এখনও আছি, তবে পাশের বিল্ডিংয়ে। আমার কেন যেন মনে হয় তুমি এখন দেশের বাইরে। সত্যি কি তাই?”

টেন্ডুলকারের কি বিশাল ভক্তই না ছিলাম এককালে। তাকে ইংলিশে লিখে দিব? “বহুদিন তোমার কোন খোঁজ রাখি না টেন্ডুলকার। মাঠে নাম কিনা তাও জানিনা, নাকি মাঠে নামার বয়স চলে গেছে? কি খবর ক্রিকেট দুনিয়ার? একবার স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ভারত ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম মনে আছে? সেই ছিল আমার প্রথম ও শেষ স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাওয়া। আমার চশমাটার কাঁচ ভেঙে পড়েছিল, কি কান্নাই না পেয়ে গেল এত দূরের মাঠ কি করে দেখব ভেবে। কিভাবে কিভাবে করে যেন পরে সামলে নিয়েছিলাম কাঁচটাকে।”

সেই প্রাইমারির গণ্ডি পেরুনোরও আগে রুটিন করে পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত যেই গুন্ডামুখো তাকে বলা যায় কিছু কথা। “তোমার চাহনি খুবই ভয়ংকর ছিল। পরে যখন তোমাকে মাঝে মাঝে দেখেছি, উস্কুখুস্কু ছিলে, আর ভয় লাগত না তখন। তবে জীবনের যেই সময়টাতে দেখতে সবচেয়ে খারাপ ছিলাম, তখনো তুমি আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে মজা পেতে, তোমার ধৈর্য্য আমার চেহারার উপর আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছিল, ধন্যবাদ নিতে পার।”

ইদানিং খুব মনে পড়ছে পিচ্চিকালের হাড় জিরজিরে পলাশ ভাইয়ার কথা। “মনে নেই তোমাকে তুমি করে বলতাম নাকি আপনি করে। প্রায় বিশ বছর হয়ে গেছে। শুনতাম বড় হয়ে যাবার পর তুমি অনেক অসুস্থ থাকতে, ওপেন হার্ট সার্জারির পর তোমাকে আমরা দেখতে গিয়েছিলাম। খুব উত্তেজিত ছিলাম এতগুলো দিন পর তুমি কেমন হয়েছ, আমাকে দেখেই চিনবে কিনা এসব ভেবে। জানো হসপিটালে গিয়ে শুনি তুমি সেদিনই রিলিজে নিয়ে চলে গেছ। সেখান থেকে বড় আপুদের বাসায় গেলাম। ওরা বলল একটু আগেই তোমাকে নিয়ে গিয়েছেন তোমার ভাই। হতাশ লাগছিল খুব। আর কখনো দেখা হয়নি।”

স্যারকে লিখব? ক্লাস নাইন আর টেন অংক করতাম উনার কাছে। “প্রিয় স্যার, সালাম নিবেন। আপনি কেমন আছেন? আমার কথা মনে আছে? সময়ানুবর্তী ছিলেন না একদমই। কিন্তু কত যত্ন করেই না অংক করাতেন। বুঝতে দেরি হলে মাঝে মাঝে মাথার তালুতে হাত দিয়ে দেখতেন ঠাণ্ডা আছে নাকি গরম। কোনরকম বকার কথা মনে পড়ে না। আপনার সাইকেলটা এখন কোথায়?”

আমার একজন গানের টিচারও ছিলেন। মাস শেষে টাকা নেয়ার সময় খুব ইতস্তত করতেন উনি। সম্ভবত এজন্য যে আমি উনার শিক্ষকের মেয়ে। একইরকম করে তো উনাকেও লিখতে পারি, “প্রিয় স্যার, সালাম নিবেন। আপনি কেমন আছেন? আমার কথা মনে আছে? আমি আর গানের চর্চা করিনি। ভাল লাগত না। আপনি কি এখনও গান শেখান? মনে আছে আপনি প্রায়ই বলতেন, স্যার না থাকলে আজকে মানুষ হইতাম না। পিতাগর্বে তখন মনে মনে উচ্ছ্বসিত হতাম খুব।”

অতিপ্রিয় রবীন্দ্রনাথকে লেখার সাহস হবে কিনা বুঝতে পারছি না। “শ্রদ্ধেয় রবিদাদু, তোমার ‘গল্পগুচ্ছ’ আমার অতি অতি পছন্দ। কাবুলিওয়ালার গল্পটা পড়ে আমার কান্না পেয়ে যায়। তোমার গান গুলিও কেমন করে এত অসাধারণ? আর ‘দুই বিঘা জমি’ তো আমার ভাঁজ করে পকেটে পুরে রাখতে ইচ্ছা করে। ওহো আমার জামায় তো পকেট থাকে না। আচ্ছা কি করলে তোমার মত করে লিখতে পারব? আসলে কোনদিন এমনটা আর কেউ পারবে না তাই না? প্রত্যেকটা মানুষই তো আলাদা। তাই কেউ কারো মত হয় না।”

বাসায় প্রথম ইন্টারনেট আসার পর ইটালিয়ান একজন নেটফ্রেন্ড হয়েছিল আমার কিছুদিন। লালচুলো লোকটার নাম লুকা। ইটালির ছবি দেখে খুব আফসোস হত কেন ওইরকম একটা দেশে জন্মালাম না। “হ্যালো লুকা, তোমার শেষ মেইলটার জবাব দিইনি শুধুমাত্র এই কারণে যে ইচ্ছা হচ্ছিল না। সেই যে সুনামি হল, এরপর একদিন হঠাৎ করে মেইল করে লিখেছিলে-আমি তোমাদের ওইদিকে সুনামির কথা জানতে পেরেছি, বন্ধু তুমি ভাল আছ তো? সরি লুকা আমি ভালই ছিলাম কিন্তু কেন যেন উত্তর দিতে ইচ্ছা করেনি। তোমার শেখানো ইটালিয়ান কথাবার্তা সব ভুলে গেছি। মিলানে কি এখন সামার? আশা করি তুমি এবং তোমার মা-ও কুশলে আছ।”

সেই সে হারানো নারিকেল গাছের কাছে লিখলে কি খুব হাসির ব্যাপার হবে? “তোমাকে যেদিন কেটে ফেলা হল, আমি বাথরুমে গিয়ে কি কান্নাই না কাঁদলাম। কলেজে পড়তাম তো, একটা কবিতা ছিল মনে আছে? ‘The Tree At My Window’. তুমি ছিলে আমার জন্য তাই। সেদিনের আগে বুঝতেও পারিনি তোমার জন্য আমার এত টান তৈরি হয়ে গেছে। এখন কিন্তু ভেবে লজ্জা পাই এত বড় বয়সে গাছ নিয়ে আদিখ্যেতা করেছিলাম ভেবে।”

কাউকে পাচ্ছি না কেন? অবাক করে দেয়ার মত খারাপ একজন কোন মানুষ খুঁজেই কি তাহলে চিঠিটা লিখতে হবে? “কেবল খেলার আনন্দের জন্য অন্যের অস্তিত্বকে হত্যাও বুঝি করা যায়? কুশ্রী কোন অপকর্মকে ভুলে থাকার ভান করলেও কি সেই অপকর্ম পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে পাপীর পিছু তাড়া করে না? বিবেকের বিষদাঁত অনেক বেশি ধারালো। ম্যাকবেথের কথা মনে আছে? হাত থেকে রক্তের অদৃশ্য দাগ মোছার জন্য সে পাগলপারা হয়ে গিয়েছিল।”

বরং একটা ভাল মানুষকেই নাহয় লিখলাম। “সততা আর মমতা থাকলে কাউকে অসুখী করা বা নিজের অসুখী হবার ভয় থাকে না তাই না? শুধুমাত্র ভালবাসা দিতে আর নিতে জানলেই জীবনটা অর্থবহ করে তোলা যায়। সৃষ্টিকর্তার কাছে নিশ্চয়ই সবার জন্য কিছু না কিছু আছেই। তাই নয় কি?”

হতে পারে পৃথিবীর আলো দেখেনি এমন কাউকেও কয়েক ছত্র পাঠিয়ে দিলাম। “প্রিয় অনাগত শিশু, জন্মের আগের মুহূর্তগুলো কেমন? আমি মনে করতে পারি না। নিরাপদ আবাস থেকে কাঁটাময় জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছ। উদ্বেগ হয়? হতেই পারে। তবে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে অসীম সম্ভাবনা। অনেক দিকে অনেক পথই খোলা। সুতরাং বেছে নাও। সিনেমায় দেখা আমার খুব পছন্দের একটা কথা বলি তোমাকে, it's the choices that make us who we are. And we can always choose to do what's right. "

জানি কাউকেই লেখা হবে না কিছু। অথচ আকাশের ঠিকানায় পত্র দেয়া কতই না সহজ।

7 comments:

রাফি said...

আশ্চর্য তো; আমি গতকাল চিঠির ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলাম;চিঠি লেখার কথা, চিঠি পাবার কথা...।

তবে আপনার লেখাটা ঢের ভালো হয়েছে।

শুকতারা said...

ধন্যবাদ রাফি। লিখে ফেলুন। আপনারটা আমারটার চেয়ে ঢের ভাল হতেই পারে। :-)

blue-spark said...

lekha ta valo hoichay. 4.25/5 dilam :)

শুকতারা said...

thank uuuu blue spark. :-) 'A' pailam.

সবুজ হক said...

How are you ?
Onekdin jogajog hoini...

Tomar lekha porchilaam ... khoob bhalo laaglo.

Onek onek mongol kamonai ...

SH

সবুজ হক said...

How are you ?
Onekdin jogajog hoini...

Tomar lekha porchilaam ... khoob bhalo laaglo.

Onek onek mongol kamonai ...

SH

শুকতারা said...

thanks a lot SH. আছি আমি মন্দ না। আপনি কেমন আছেন?
লেখা ভাল লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। ভাল থাকবেন।