প্রায় সপ্তাহ দুয়েক পর কুরবানির ঈদ। ঈদ আমার কাছে আহামরি কোন আনন্দের বিষয় না। তার উপর এবার আমাকে থাকতে হবে আমাদের গ্রামের বাড়িতে। দাদাবাড়িতে ঈদ আর ঈদের দুই দিন পর নানাবাড়িতে সফর। এই বাসৎরিক বেড়ানোটা একসময় ছিল খুবই আনন্দের। ঢাকায় ফিরে আসার আগে আমি কান্নাকাটি জুড়ে দিতাম। তখন উঠান দাপিয়ে খেলার সঙ্গী ছিল, খবরদারি করার জন্য কলেজে পড়া বড় আপুরা ছিল, সারাদিন মাঠেঘাটে চরে বেড়ানোর আগ্রহও ছিল। এখন সেই তুলনায় আমি নিঃসঙ্গ। বড়রা নিজের পরিবার গড়ে নিয়েছে, সমবয়সীদের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্য নেই, আর ছোটরা একটু বেশিই ছোট। তবে সময়টা খারাপ কাটে না। গৎবাঁধা রোজনামচার একঘেয়েমি দূর হয়। এখন শীতকাল, তাই গ্রামে বেড়ানোটা বরং ভাল হবে। তবে একটা জিনিস খুব মিস করব; কচুরীপানার ফুল। আগে গ্রামে যাবার পথে রাস্তায় ধারে ধারে পুকুর ভরা কচুরীপানার ফুল দেখা যেত। আর আমি বেবিট্যাক্সি থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতাম। এই কয়েক বছরে ঈদটা সরে আসার কারণে ফুল ফোটার সময়টা ধরতে পারিনা। আর হয়ত পানা পুকুরের সংখ্যাও আগের মত নেই। দুঃখের ব্যাপার! আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলোর তালিকা করতে চাইলে এক অথবা দুই নাম্বারে থাকবে জংলা পুকুর ভর্তি জ্বলজ্বলে কচুরীপানার ফুল। গাঢ় সবুজের পটভূমিতে হালকা বেগুনি রঙের স্থির আগুন। শুধু যে দেখতে সুন্দর তা না, দৃষ্টি ছাড়িয়ে যেন মনস্তত্ত্বে পৌঁছে যায়। জলজ উদ্ভিদ বলে চোখকাড়া উজ্জ্বল রঙ। এই ফুলটা আবার ছিঁড়ে আনলে বিবর্ণ দেখায়, তাছাড়া নেতিয়েও পড়ে একটু পর। এজন্য কখনো ঢাকার ফুলের দোকানে একে দেখা যায় না। আমার সবচেয়ে প্রিয় ফুল কোনটা একথা কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে না কেন? কচুরীপানা নিয়ে আদিখ্যেতা করার একটা সুযোগ পেতাম। বেলী তো কেবল বিপুল ভোটের ব্যাবধানে দ্বিতীয় নাম।
আমার দাদাবাড়ির গ্রামে ইলেকট্রিসিটির নামসর্বস্ব খুঁটি এখনো বসেনি। নিকট ভবিষ্যতেও পৌঁছার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং সন্ধ্যার পর হ্যারিকেনের রাজত্ব। আমি অনেকদিন পর জানতে পেরেছি যে গ্রামে একেকটা পরিবারের অংশকে বলতে হয় ঘর, আর অনেকগুলো ঘর নিয়ে একেকটা বাড়ি। তাই বাড়ি সাধারণত অনেক বড় হয়। এখানে ঘর বলতে রুম বুঝি, ওখানে বাসার পুরো জায়গাটা নিয়েই নাকি ঘর। একটু অদ্ভুত। আমাদের ‘বাড়ি’টা বেশ ছোট, অল্প কয়েকটা ‘ঘর’। তাই বেড়াতে গেলে আশেপাশের সবার সঙ্গে দেখা হয়, আদর যত্ন পাই। খুব ভাল লাগে তখন। চুপচাপ ধরণের। উপভোগ্য আরেকটা জিনিস হল ধোঁয়ার গন্ধ, পাতা পোড়ানোর গন্ধের সাথে অচেনা অন্য কিছু একটার মিশেল। খুব সুন্দর নেশা নেশা গন্ধটা। আমি নাক উঁচু করে খানিকটা খেয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। সেখানে চা হয় অন্যরকম। কোনটাতে গরুর দুধের তীব্র ঘ্রাণ, কোনটা আবার খুব কড়া মিষ্টি। সেই তুলনায় নানাবাড়ি বেশ বড়, মানুষও বেশি। ইলেকট্রিসিটি শেষ বিকাল থেকে রাতের খাবার সময় পর্যন্ত ছুটিতে থাকে। আমার স্বস্তিবোধটা কেন যেন এখানে কিছুটা কম। ছোটদের দলে ভিড়তে বাধে আর বড়দের আলাপের বিষয়বস্তু আমার ভাল লাগেনা। এই বয়সেও বার তের বছরের জ্যাঠা ছেলে ফটিকের মত নো ম্যান’স ল্যান্ডে পড়ে থাকি। সে যাই হোক, কুরবানির ঈদে গ্রামের বাড়ি যাওয়া বাধ্যতামূলক। যেতে হয় সাধারণত ঈদের আগের দিন। আর কি ভয়ংকর জ্যাম রাস্তায়! সাত সকালে বাসের জন্য স্টপেজে গিয়ে অপেক্ষা করতেই থাকি করতেই থাকি। সেই বাস যদিও একসময় আসে, গন্তব্যে পৌঁছতে কখনো কখনো সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। গ্রামে গেলেই টিভি নিউজপেপার আর ইন্টারনেটের জগত থেকে বিচ্ছেদ। মোবাইলের নেটওয়ার্কও বেশিরভাগ সময় খুব দুর্বল থাকে। তখন হঠাৎ করেই বোদ্ধা হয়ে পড়ি, যেন এসব আমি খুব বুঝি, এসব ছাড়া আমার যেন চলেই না। সব মিলিয়ে খারাপ যায় না সময়টা। সপ্তাহ খানেক পরে যখন ঢাকায় ফিরে আসি সেটাও আবার একটা আনন্দ; Home, sweet home টাইপের। তাই আমি এখন মনে মনে রেডি হচ্ছি ঈদের জন্য।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
1 comment:
অনেকদিন পরে তোমার ব্লগ পড়লাম। লিখে তো পাতা ভরে ফেলেছ! দেশ, কাল, সমাজ সব নিয়ে তো কপচে ফেলেছ দেখি! হা হা! যাই হোক, তোমার লেখা পড়ে নিজেরও কিছু লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে।
ভাল লেগেছে লেখাগুলো।
Post a Comment