Friday, October 30, 2009

তিনা কে...

প্রিয় তিনা,

জানি অবাক হয়ে যাচ্ছিস আমি চিঠি লিখছি দেখে। প্রায় রোজ যার সাথে দেখা হয়, ফোনে এত কথা হয় সে আবার চিঠি লিখতে বসল কেন তাই ভাবছিস হয়ত। কিংবা মনে করেছিস আমি কিছু একটা মুখে বলতে পারছিনা বলে লিখছি। সে তুই যাই ভেবে নে তোর খুশি। আমি এত সাত পাঁচ চিন্তা করে লিখতে বসিনি। আসলে খুব একা লাগলে তোর কথা এত মনে আসে! তুই ছাড়া আমাকে আর কে এতখানি বুঝতে পারে বল!

ওহো! কেমন আছিস তাই তো জিজ্ঞেস করা হল না। খুব যে জবাব জানার জন্য করছি তা না। এমনি করা। আজো আমার নতুন অর্কিডটা দেখতে আসা হল না তোর। সময় তোর হয়ই না। ইস আমরা কত ব্যস্ত হয়ে গেছি না রে? বড় হয়ে গেছি আমরা। এই তো সেদিন যে বয়সের রজতজয়ন্তীটা পার করে দিলাম তাও তো একবছর হতে চলল। কি করে এতগুলো দিন পার হয়ে গেল বল তো? এই সেদিন না বেণী দুলিয়ে স্কুলে যেতাম? আমাদের প্রথম স্কুলে তোকে যে সবাই হুতুম প্যাঁচা ডাকত আমার কি মনে নেই? চোখ পাকাচ্ছিস নাকি? কাউকে বলব না তো!

জানিস আজকাল এত নিয়তিবাদী আর অতীতবাদী হয়ে গেছি আমি! ফেলে আসা সবগুলো দিন মনে পড়ে আর প্রত্যেকটা মুহূর্তে মনে হয় আমার ভাগ্য যেন পালটে যাচ্ছে। আজ থেকে পাঁচটা বা দশটা বছর পর আমি বেঁচে আছি কিনা, থাকলে ঠিক কি করছি তা যে আমি জানি না বা একটুও ভাবতে পারি না এটাও একটা উত্তেজনা এনে দেয় কখনো কখনো। তিনা তোর কি রিজভীর কথা মনে আছে? সেই শান্ত লাজুক ছেলেটা এখন একেবারে কর্পোরেট হয়ে গেছে। সেদিন মার্কেটে দেখা। পাশ থেকে হাসিমুখে বলে, “আরে মিলি না? আমি রিজভী, চিনতে পেরেছ?” আমি চিনব না? আমার স্মৃতিশক্তি যে ভাল এটা তো তোরাই বলিস। দারুণ হয়েছে দেখতে এখন ও। আচ্ছা তিনা সেই যে বৃষ্টির দুপুরে রিজভী ঠাণ্ডায় নাকি আর কিছুতে কাঁপতে কাঁপতে বলেছিল, “মিলি তোমার সাথে কিছু কথা আছে, একটু শুনবে?” তোরা তো ঠিকই বুঝতে পেরেছিলি ও কি বলতে চায়। শুধু তোরা? আমিও কি বুঝতে পারিনি? সেদিন যদি আমি ওর কথাগুলো শুনতাম, ওর বাড়ানো হাতটা যদি ধরতাম তাহলে এখন কি তোকে ঠিক এই চিঠিটাই লিখতাম?

এ্যাই দরকারী একটা কথা, জলদি মাথায় টুকে নে। তুই যে চাকরি পাবার পর খাওয়াবি বলেছিলি, কোথায় সেটা? তোদের লজ্জা লাগে না রে তিনা? খুব তো চখাচখি একসাথে চাকরি পেয়ে গেলি, নিজেরাই পেটপূজা করে বেড়াচ্ছিস। আমি খেতে চাইলে শুধু আমার ওজন নিয়ে খোঁটা দিস। এভাবে করে পার পাবি ভাবিস তুই? আর তোর বাবুসাহেবকে বলিস, কতবার আন্টির চোখ ফাঁকি দিয়ে ওর মেসেজ তোর কাছে চালান করেছি যেন গুণে নেয়। বাব্বাহ তোরা একেকটা কি অকৃতজ্ঞ রে!

কিছু করার পাচ্ছি না, তাই নেটে বসে এটা সেটা দেখছি। পাশের ঘরে ছোটখালা আর আব্বা আম্মা খেতে বসেছে। গুটগাট গল্পও চলছে। আমি কি করেছি জানিস? কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান বাজিয়ে দিয়েছি, যেন ওদের কোন আলোচনা আমার কানে না আসে। কে জানে যদি ওই লম্বুকে নিয়ে কথা বলে? তোদের তো আবার লম্বুকে অনেক পছন্দ। রাজি হয়ে যা মিলু, কি হ্যান্ডসাম, কত সেন্সিবল। উফ তোরা পারিসও। অসহ্য! লম্বুজী আবার সেদিন ফোন করে আমার খোঁজ নেয়। “কেমন আছ মিলি? ইস তোমার ফোনে সমস্যা নাকি? পেতে এতক্ষণ লাগল!” আমিও খুব মিষ্টি করে খুশিমুখে সব কথার জবাব দিয়েছি। অথচ মনে মনে বলছিলাম, “খবরদার! একদম চুপ! আমার নাম্বার কে দিল?” লম্বুকে কি আমি না করে দিব রে তিনা? কেন? সত্যিই যদি না জানিস তো পরে বলব।

আম্মা আমাকে খুব বকে। আমি নাকি একা থাকি। আমি নাকি কথাবার্তা একদম বলি না। আচ্ছা কি কথা বলব আমি বল তো? আমি কি উচ্ছ্বল কিশোরী নাকি যে আমার একগাদা কথা থাকবে? সেজ মামা বললেন কোন কাজ করার নেই দেখেই নাকি আমি চুপচাপ হয়ে থাকি, একটা চাকরি পেলেই ভাল লাগবে। হুঁম খারাপ বলেননি। আসলেই চাকরি দরকার। বাসার কাউকে একদম ভাল লাগে না জানিস? বাবা মা মিহির কাউকে না। মনে হয় সবাই আমাকে জ্বালায়। কেউ যদি একটা কথা বলতে আসে তাতেই আমি বিরক্ত হয়ে যাই। খুব ইচ্ছা করে দূরে কোথাও চলে যাই সব ছেড়েছুড়ে। অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও। তাও কি পারব? আমি তো মেয়ে। বাড়িতে কেউ কোনদিন আমাকে মিহিরের চেয়ে কম কিছু ভাবেনি, ও যা যা পেয়েছে আমিও তাই পেয়েছি, খেলাধুলা পড়াশোনা গানবাজনা সবকিছুর সুযোগ ওর মত করেই ছিল আমার সবসময়। কিন্তু তারপরও একটা মেয়েকে একসময় একটা মেয়েই হয়ে যেতে হয়। তোর একটা কথা আমি মানতাম না কখনো, এখন বুঝি সত্যি কথাই বলিস তুই, ছেলেগুলো ঠিক কেমন কেমন করে যেন ভাল থেকে ফেলে। সব গুছিয়ে ফেলে নিজের মত করে। সততা, নৈতিকতা, অকপটতা এসবের ভক্ত হয়ে পড়ে, কারণ “অনেক হয়েছে, জীবন নিয়ে তো এক্সপেরিমেন্ট চলে না।”

নাহয় আজ তপনদা ভাল থাকত? তুই কি ভুলতে পারবি বীণাদিদি আর তপনদার সাত বছরের ভালবাসার কথা? শুধু একটা দামী চাকরির জন্য তপনদা কেমন করে সব শেষ করে দিয়ে চলে গেল! ঠিকই পুতুলের মত একটা মেয়ে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসার করতে করতে এখন হিল্লি দিল্লি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ এই ভালটা বীণাদিদি থাকতে পারল না। তপনদা জীবনে যেন খুব জিতে গেল। ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটা যদি নকল করে ফার্স্ট হয়ে যায় আর সেই রেজাল্টটাই যদি সবার কাছে সত্যি হয় তাহলে কেমন লাগে ভাব তো তিনা! মাথা কাজ করে না কেন? সবকিছু ঠিকঠাক মত চলে না কেন বল দেখি। তুই তোর সব কোমলতা নিয়েও চোরাপাঁকে বারবার আটকা পড়ে যাবি, আমি চারদিকে আলো ভেবে আলেয়া দেখব এমন কেন হবে? তোর মত আমারও ভাল না লাগা রোগটা বেড়ে চলেছে।

কেমন একটা শূণ্য শূণ্য লাগে জানিস? ঠিক জানি না কেন। জানলেও হয়ত না জানার ভান করব। আমার সব বন্ধুকে একটা প্রশ্ন করি আমি, চোখের পানি উষ্ণ হয় বলে কি তার থেকে বাষ্প উড়তে থাকে? সবাই বলে, না এমন হয় না। আসলে তোরা কেউ তো আমার মত সারাদিন মোটা ফ্রেমের চশমা ঝুলিয়ে রাখিস না, ঘোলা কাঁচ তোরা চিনবি কি করে? অস্থিরতা চেপে আছে। মাঝে মাঝে খাটে শুয়ে নাটকের নায়িকাদের মত খাটের পাশের টেবিল ল্যাম্পটা একবার জ্বালাই একবার নিভাই, আবার জ্বালাই আবার নিভাই। যেন এটা একটা কাজ হল। যেন এভাবে করে খুব দিন কাটানো যায়। সুইচ এর উপর হাতটা চালু রাখলাম। যতক্ষণ শক্তি আছে অফ অন করতেই থাকলাম। একবার আলো একবার আঁধার আবার আলো আবার আঁধার। একসময় হয়ত ঘুম নেমে আসবে। ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগটায় কোন অবস্থাটার সৃষ্টি হবে, আলো না আঁধার, সেটাই একটা খেলা। অবশ্য তখন তো আমার চোখই বন্ধ। চোখ বন্ধ করে রাখা মানুষ কি আলো আর আঁধারের পার্থক্য একটুও বুঝতে পারে?

আজ আর লিখতে ইচ্ছা করছে না রে। রাখি। কথা হবে। ভাল থাকিস। আন্টিকে বলিস আমাকে না বকতে, শীগগিরই একদিন আসব, প্রমিজ।

ইতি তোর বোকা বন্ধু,
মিলু।

Tuesday, October 27, 2009

আবার এলো শীত

আমলকির ডাল কখনো দেখা হয়নি বলে শীতের হাওয়া তাকে কেমন করে নাচিয়ে যায় তাও জানা হয়ে উঠেনি রবিঠাকুরের মত করে।
আমার কাছে শীত মানে জানালা গলে বিছানার উপর বরফি কাটা রোদ।
সুদূর অতীত হয়েও মনের মাঝে সগর্বে টিকে থাকা নতুন ক্লাসের উত্তেজনা আর নতুন বইখাতার চনমনে গন্ধ।
দাদাবাড়ি নানাবাড়িতে কুয়াশা নিয়ে খেলা।
শীত মানে খলশে মাছের ঝোলে আধডোবা হয়ে থাকা ডুমডুমে ফুলকপির টুকরোর দিকে লোভাতুর চোখে চেয়ে থাকা।
সাতসকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুখ থেকে ধোঁয়া ছোটানোর আপ্রাণ চেষ্টা।
শীত মানে অনেকদিনের আশার বেলুন চকিতে চুপসে গিয়েও আশায় বুক বাঁধা।
আসন্ন গ্রীষ্মের কোন এক দিনের জন্য তিলে তিলে স্বপ্ন বুনে তোলা।
এমন ঋতুটাকে কেন ধূসর আর প্রাণহীন ভেবে কবিতা লেখা হবে তাই নিয়ে মনে মনে প্রতিবাদ।
একটি বছরের বিদায়ের অজানা অকারণ বেদনাকে আরেকটি বছরের সূচনা দিয়ে ঢাকতে না পারা।
নিজের গহীনে লুকিয়ে থাকা ভালবাসাকে একদিন অবাক হয়ে আবিষ্কার।
মায়া জড়ানো দুপুর আর গড়িমসি করে পার করা সন্ধ্যা।
শীত মানে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আয়েশে চোখ বুঁজে আসা।
রঙিন পৃথিবী ঝাপসা চোখে সাদাকালো হয়ে ধরা পড়া।
শীত আমার জন্য জেগে উঠে ঘিরে ফেলা তীব্র কিছু চাওয়া।
হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারি ভাবা অবয়বগুলোর ভোরের স্বপ্ন হয়ে এসেই চলে যাওয়া।

Monday, October 26, 2009

হারানো ছোট ছোট ভালবাসাগুলো

ছোটবেলায় নতুন ক্লাসে উঠলে একসাথে অনেকগুলো খাতা কেনা হত। খাতাগুলো হত একই ডিজাইনের, কেবল রঙের পার্থক্য। একেকটা বিষয়ের জন্য একেক রং। সেই খাতায় লেখা শুরু করাটা কি আনন্দই না ছিল। আমার খুব পছন্দের একটা খাতা ছিল ক্লাস টুয়ের নীল টমি খাতা। মোটা মলাটের খাতার উপর একটা আদুরে বিড়াল ছিল বলে মনে মনে এমন নাম। সাদা বিড়ালের মায়া মায়া চোখ। খুব সুন্দর ছিল দেখে সেটাকে বানালাম ইংরেজি খাতা। স্কুলে পড়ার সময় ইংরেজি প্রিয় ছিল, সেজন্য নিজেকে স্মার্টও ভাবতাম। অনেকদিন পর আজ সন্ধ্যায় টমি খাতাটার কথা মনে পড়ে নস্ট্যালজিক হয়ে গেলাম। সেই সাথে মনে পড়ল হলুদ খাতাটাকেও, আমার কবিপ্রতিভা যেখানে আবাদ হত। ক্লাস ফোর থেকে ছড়া লিখতে, আর অবসরে সেসব পড়ে মুগ্ধ হতে শুরু করেছিলাম। এই চর্চা চলেছিল মনে হয় বছর তিন চারেক হবে। প্রথম খাতাটাই ছিল হলুদ খাতাটা। মনে আছে ছোট ছোট চিরকুট পদ্য জমে ফুলে উঠেছিল বেশ। কি করে যে হারিয়ে ফেললাম।

মেলা থেকে কেনা খেলনাগুলোর মধ্যে কোন কোনটা বিশেষ ভালবাসা পেত। চাইনিজ দেখতে একটা পুতুল অনেকদিন ছিল আমার কাছে। জানি না কবে থেকে নেই হয়ে গেল। আর একটা কাঠের হাতি এখনো আছে, ওর খাবার ছিল আনারসের মাথার ঝুড়িগুলো। অনেকদিন টিকে ছিল প্লাস্টিকের পশুর একটা সেট। ব্যাটারিওয়ালা মেম পুতুলটার কথা তো না বললেই না। আমি মেম পুতুল বলতাম না। এই নামটা জানা ছিল না, পরে বই পড়ে জেনেছি। পুতুলটা মামার দেয়া। নাম ছিল তুলতুল। গায়ে গোলাপি উলের পোশাক আর টুপি। শান্ত স্বভাব, কখনোই বিরক্ত করেনি।

জীবনের প্রথম গল্পের বইটা অসাধারণ ছিল। ঠাকুরমার ঝুলি। ক্লাস ওয়ানের কথা সেটা। বইটা হারিয়েছি। ওই অসাধারণ গন্ধ আর কোন কিছুতে নেই। ছিল ডালিমকুমার, পঙ্কাবতী আর দৈত্যের গল্প। বাজারে বহু ঠাকুরমার ঝুলি আছে। কিন্তু ঠিক ওই বইটা অনেক খুঁজেও কোথাও পাইনি আমি আর।

এমন আরো কত কিছু। আজকে কেউ নেই।

সত্যি কথা বলতে কি এতদিন পর আমি এদের কাউকেই সত্যিকার অর্থে মিস করি না। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ কেমন যেন মন টানে। খুব হাতে নিতে ইচ্ছা করে টমি খাতা কিংবা ঠাকুরমার ঝুলিটাকে। একটু শুধু আঙুল বোলানো। চিরতরে হারিয়ে গিয়ে এরা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে এই নিছক 'জিনিস'গুলোকে আমি ভালবাসতাম।

অনেককাল পাশে থাকা বস্তুগুলোর সাথেও অজান্তে কি করে যেন ভালবাসা হয়ে যায়। ওরা কখনোই স্বেচ্ছায় ছেড়ে যায় না, আমরাই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ওদেরকে দূরে সরিয়ে দিই। একদিন যখন হাত বাড়াই আর খুঁজে পাই না, অসহায় একটা অনুভূতি হয়। মানুষের বেলায়ও কি এমন?