Sunday, September 27, 2009

পতঙ্গের বুকে আমরা

একটা রক্তশোষা ছোট্ট পতঙ্গ। উড়তে উড়তে ঠিক আমার গালের উপর এসে বসল। কখন যেন এক বিন্দু রক্ত খেয়েও নিল। টের পেলাম উড়ে যাবার পর। উড়ে গিয়ে বোকা পোকাটা বসল আবার তোমার সটান করে রাখা হাতে। আমি চেয়ে আছি। সে টেনে নিল আরও একটা ফোঁটা। এবার সে একটু ক্লান্ত বোধ হয়। হেলে দুলে নড়ে চড়ে চলে যাচ্ছে রকমারি ভোজটা শেষ করে। তুমি যেন একটু সতর্ক হয়ে উঠলে। ওকে পিষে মারতে চাও নাকি? আমাদের ব্যথা দিয়েছে বলে রেগে গেলে ওর উপর? কি হয়? কত ছোট্ট একটা প্রাণী। বেচারার খাবার বলতে আমাদের মত মানুষদের দুই এক ফোঁটা রক্তই তো। তুমি পারো চাইলেই, কিন্তু আমার ইচ্ছে হচ্ছে না তুমি ওকে মারো। এক আঘাতে তিন তিনটা প্রাণ কেড়ে নেয়া কি সাজে? অবাক হচ্ছো? বুঝলে না? এই দেখ ওর মাঝে ওর নিজের প্রাণ ছাড়াও আছে আমার রক্ত, তোমার রক্ত; যেন আমার একটু প্রাণ আর তোমার একটু প্রাণ। এই কাঠখোট্টা পৃথিবী, সমাজ সংসার গুরুজন বা বন্ধু, কেউই তোমাকে আর আমাকে এক হয়ে পাশাপাশি বাঁচতে দিচ্ছে না, দিবে না। তোমার বুঝি কখনও কষ্ট হয় না? দেখ না কেমন করে এই নগণ্য পতঙ্গটা আমাদের মিলিয়ে এক করে দিল ওর নিজের মধ্যে। এভাবেই নাহয় কিছুটা সময় আমরা খুব কাছাকাছি রইলাম! আমাকে, তোমাকে আর আমাদের একীভূত হবার অদম্য ইচ্ছেটাকে ও কেমন করে ওর বুকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এটুকু দোষ করলে কি কাউকে পাপী বলা যায়?

... ... ...

কবিতার মধ্যে একটা স্বল্পবুদ্ধির মাথার বোধগম্য গল্প না থাকলে পড়তে ভাল লাগে না। আর ইংরেজি কবিতা? সে তো আরও দূর্গম পথ। উপরের অংশটুকু John Donne এর লেখা The Flea কবিতাটার একটা মোটামুটি ভাবার্থ। মনে ধরেছিল খুব। কিছু মানুষ কেমন করে যেন কারো না কারো ভাবনার কথা, স্বপ্নের কথা বলে দেয়। হয়ত খুব অন্যরকমভাবে, যেমনটা আমরা নিজেরা কখনও ভাবিনি। তবুও সত্যি হয়ে মিলে যায়।

Tuesday, September 15, 2009

"ভালবাসা"

ছোট্টবেলার প্রেম আমার কালো মেম, কোথায় গেলে হারিয়ে...

ম্যারি অ্যানের সাথে যে আর কখনো অঞ্জনের দেখা হয়নি এমন না। এখনও দু’জন কাছাকাছি এলাকাতেই থাকে। অঞ্জনের পাড়ার উপর দিয়েই তাকে যেতে হয় প্রায়ই। দেখতে এখন সে ভীষণ অন্যরকম। ঝোলা গাল আর পাকা চুলের মাঝবয়েসী ম্যারি অ্যানের ক্ষয়ে যাওয়া নখও তার চোখ এড়ায় না। চোখাচোখি হয়ে যায় হয়ত অঞ্জন যখন মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসছে, বা ম্যারি অ্যান যখন বাবার জন্য ওষুধ কিনছে। দুরন্ত শৈশবে কিংবা অস্থির কৈশোরে ভাল লেগে যাওয়া মানুষগুলোকেকি আমরা আসলেই বিশেষভাবে মনে রাখি? মনে হয় না। বারান্দাতে তোয়ালে শুকাতে দিতে এলে হুট করে যখন রাস্তায় চোখ পড়ে যায়, কালো ফ্রেমের চশমা পরা অজানা আকর্ষণধারী নিষ্পাপ ছেলেটা যে এখন কালচে ঠোঁটের লম্বাটে একজন চোয়াড়ে যুবক, তাকে দেখে তো একমুহূর্তের জন্যও একবিন্দু অনুভূতির জন্ম হয় না। ঠিকই কাপড় গুছিয়ে বিকালের কাজের কথা ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকে পড়ি। কলেজে পড়ার সময় যেই ক্লাসমেট হেঁটে যাবার সময় হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠত, আজকে তার নাম কানে এলে ওই পাগলামির কথা ভেবে কি কারো হাসি পায় না? এমনকি পাঁচ ছয়টা বছরের দ্বিধাহীন পরম ভালবাসাবাসির ফল যখন দু’জনের বুকভাঙা বিচ্ছেদে গিয়ে ঠেকে, সময় না গড়াতেই সেই দু’জন কেমন চমৎকার মানিয়ে নেয়। তাই বলে কি সত্যিই এসবের কোন মূল্য ছিল না বা নেই? কোথাও না কোথাও সবগুলো ভাললাগারই নিশ্চয়ই ভূমিকা আছে। অথচ কি প্রচণ্ড অভিযোজনশীল আমরা। কিছুই মনে রাখতে চাই না। যেই নৌকাতে পা রেখে স্থিরতা আনতে পারি বলে মনে হয়, যেই সম্পর্কটা সমাজের চোখে জ্বলজ্বল করে জ্বলে, সেটাকেই ‘প্রকৃত ভালবাসা’ আখ্যা দিই। বাকিগুলো সব নিছক আকর্ষণ, বা গালভরা নাম ‘ইনফ্যাচুয়েশন’। মেয়েরা একটু আগে সংসারী হয়ে সকল মনোযোগ নতুন জীবনে প্রয়োগ করে, আর ছেলেরা একটু দেরিতে যাত্রা শুরু করায় কিছুদিনের জন্য খুব স্মৃতির জাবর কেটে নিজেকে ব্যথিত প্রমাণ করার সুযোগ পেয়ে যায়। তারপর সব ঠিকঠাক। ভালবাসা এতখানি মরণশীল! না কি না? মানুষ তো আবার ভানের রাজা। কোনটা আসলে ভান কে জানে। এত বছর গড়ালো, তবু সবকিছু একই আছে, কিছুই ভুলিনি-এটা? নাকি ওসব ক্ষণিকের মোহ ছিল, এখন আমি কিছুই ভাবি না-এটা?

নর-নারীর মধ্যকার ভালবাসাটা স্থায়ী একমুখী নাকি অস্থায়ী বহুমুখী? সময় যেদিকে ভাসিয়ে নেয়, বাঁচবার জন্য, ভাল থাকবার জন্য কি অদ্ভুত করেই না ভালবাসার নানারকম সংজ্ঞা তৈরি হয়। আজ এই তো কাল সেই। পরিস্থিতির আনুকূল্য না পেলে মনের খাঁচায় কোন নির্দিষ্ট একটা পাখিকে জীবনভর পুষি না। কারণ সবচেয়ে বড় সত্য হল, সুখেশান্তিতে বেঁচেবর্তে থাকার চেষ্টা করতে হবে, সবাইকে সেটা দেখাতেও হবে।

Monday, September 7, 2009

"নিয়তি"

ঠিক বিশ বছর আগের এই দিনটাতে ফিরে যাবার চেষ্টা করলাম। একেবারেই পরিষ্কার না, ভাল লাগছে এই ভেবে যে এখনও ততখানি বুড়ো হয়ে যাইনি যে বিশ বছর আগের দিকে তাকিয়ে নিজেকে মোটামুটি বড় দেখব। না না মনে পড়ছে তো কিছু কিছু, খুশি হলাম, এখনও ততটা বয়স হয়ে যায়নি যে স্মৃতিশক্তি ঝাপসা হবে। সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী বালিকা ক্লাসে কথা বলার অপরাধে পিটুনি খেয়েছিলাম। ওই বছরেরই কোন এক দিনে, হতে পারে এই তারিখই। তারপর পর পর তিন দিন আমাকে স্কুলে দিয়ে আসা হলে একটু পর আমি গেট দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে একা একা বাসায় ফিরেছি, কেমন যেন বমি বমি পেত। একথা স্পষ্ট মনে করতে পারি। বাসা থেকে স্কুল ছিল হাঁটা পথে মিনিট আট দশেক। এখন ভাবলে ভয় হয়। যদি কেউ আমাকে পথের মাঝ থেকে তুলে কোথাও বিক্রি করে দিত? কোন ‘ছেলেধরা’। আজকে কোথায় থাকতাম?

দশ বছর আগের এই সময়টা ছিল এককথায় অসাধারণ। ক্লাস টেন, আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়। সারাদিন ক্লাসে বসে হাসাহাসি। এস এস সির পড়াগুলোও ভালই ছিল। একদিন বিকালে আমি আর আম্মু মার্কেটে যাবার জন্য রিকশা নিয়েছি। আরামবাগের কাছে উল্টোদিক থেকে জোরেসোরে আসা একটা বাস আরেকটু হলে আমাদের রিকশাকে ধাক্কা দিয়ে দিচ্ছিল। আমরা হতভম্ব। একদম শেষ মুহূর্তে বাসটা কেমন করে যেন থেমে যায়। সত্যি যদি ধাক্কাটা লাগত? বাঁচতাম হয়ত কিন্তু কেমন হয়ে? কে জানে।

একবছর আগের এই দিনটা বছরের অন্য অনেক দিনের মত উপভোগ্য ছিল না। আমার সারা গায়ে-মুখে তখন জলবসন্তের জলকেলি। স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি ছিল গুটিকার ঘনত্ব। কোত্থেকে যেন শুনে নিয়েছিলাম যার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা যত বেশি তার বসন্তগোটার সংখ্যা তত বেশি হয়। এই শুনে সুখী হবার সু্যোগ ছিল না জ্বর আর ব্যথায়। একটা সময়ে যখন চোখ লাল হয়ে জ্বালা শুরু হয়ে যায় আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম আমার চোখের মণিতে আক্রমণ হয়েছে এবং আমি জানতাম চোখের মণিতে বসন্ত মানেই আমি অন্ধ হয়ে যাব। মনে পড়ে কেমন প্রচণ্ড একটা আতংক কুঁকড়ে দিয়েছিল আমাকে। কেমন থাকতাম আজকে আমি, যদি সত্যিই চোখ হারাতাম?

একমাস আগের এই দিনটাই নাহয় ধরলাম। এখনও জানি না, কিন্তু হতেও তো পারে ঠিক এই সময়টাতে আমি অল্পের জন্য কিছু একটা থেকে অনের বড় বাঁচা বেঁচে গেছি, বা একটুর জন্য কিছু একটা থেকে নিজেকে শেষ রক্ষা করতে পারিনি। কিসের পরিণতি কি, তা বুঝতে কিছুটা সময় তো লেগেই যায়।

এমন কি হয় না, কয়েক দিন আগে করে ফেলা নেহায়েত খামখেয়ালী একটা কাজ কাউকে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ খুঁজে পাইয়ে দিল। কিংবা এক মিনিটের ভুলে জীবনভর পস্তাতে হল। আমরা যখন জন্মাই আমাদের সাথে ছুটে চলার জন্য জেগে উঠে অনেকগুলি সমান্তরাল সম্ভাবনা। একমুহূর্তের একটা সিদ্ধান্ত বা একপলকের একটা দৈব ঘটনায় নির্ধারিত হয়ে যায় জীবনের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি। সমান্তরাল পথগুলোর একটাতে আমরা হাঁটা ধরি। সেখানেও তৈরি হয় আবার আরো কিছু নতুন সমান্তরাল সারি। তার থেকে আবারও টিকে থাকে কোন একটা। আর আমাদের ‘হলেও হতে পারত’ জীবন বা জীবনগুলোর সম্ভাবনা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। ‘নিয়তি’ চিরকালই একটা রহস্য রয়ে গেল।

Tuesday, September 1, 2009

পত্র দিও...

ভাবলাম আমিও একটা চিঠি লিখি। চিঠি না ঠিক, ছোট্ট কোন চিরকুট। কলমে লিখব নাকি পেন্সিলে? সাদা নাকি রুল টানা কাগজে? খাম থাকবে কি থাকবে না? মনে মনে লিখে আকাশের ঠিকানায় ছেড়ে দিলেই হয়। লেখাও হল আবার কেউ পড়তেও পেল না। কিন্তু কাকে লিখি?

মা-কে লিখব একটা? “প্রিয় আম্মু, জীবনভর তো তোমাকে কম জ্বালাতন করলাম না, তবু কখনো মুখ ফিরাওনা। তার জন্য আমি কোন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে যাব না কখনো। অসম্ভব কাজ কি আর করা যায়? তুমি একদিন অনেক বুড়ো হয়ে যাবে, একদিন থাকবে না এটা ভাবলে আমার চেতনা থেমে যেতে চায়। প্লিজ এটা কি বন্ধ করা যায় না?”

সদা নির্লিপ্ত পিতাকে লেখা যায়, “আব্বু, আমার জন্য তোমার যত মায়া সেটা হয়ত সব বাবাদের মধ্যেই আছে। তবে আমি জানিনা সবাই তোমার মত করে গুণে গুণে মেয়ের পছন্দ অপছন্দ হিসাব করে কিনা। ছোটবেলায় আমি ভাবতাম আমার বাবা যদি তুমি না হয়ে অন্য কেউ হত আমি তার সাথে মোটেও কথা বলতাম না, বরং পথে কোথাও তোমার সাথে দেখা হলে আমি তোমাকেই বাবা ডাকতাম। আমার এই ধারণা না এখনও একই আছে। আমার অতি তুচ্ছ বিষয়গুলিতেও তুমি যেভাবে মনোযোগ দাও যে অবাক লাগে। আমার নিজেরই মনে থাকে না আমি কবে কি বলেছিলাম বা চেয়েছিলাম। তুমি দেখি ঠিকই মনে রাখ। সবাইকে একটা করে এমন বাবা দিয়ে দেয়া হোক।”

বুঝুক আর না বুঝুক, সাড়ে পাঁচ বছরের চাচাতো বোনটা আরেকটু ভাল করে পড়তে পারলে নাহয় কিছু লেখা যেত। “তোমার মজার মজার কথা শুনতে কিন্তু আমার বেশ লাগে। বড় হয়ে কিন্তু তোমাকে বড় হতে হবে। আমার বয়সে পৌঁছে আমার মত হাপিত্যেশ করলে তোমার একদম চলবে না। প্রত্যেকটা দিন উপভোগ করে নাও। বড় হলে ছোট থাকার আনন্দ হাজার চেয়েও পাবে না।”

যাদের সাথে দেখা হবার সুযোগ নেই এমন কাউকে লেখা উচিত। “কেমন আছ তাহমিনা? সেই কবে তোমরা এই এলাকা থেকে চলে গেছ। আমি মনে হয় ক্লাস ফোরে পড়তাম। আমাদের খেলার জায়গাটা কিন্তু এখনও একই আছে। একসময় জয়ারাও চলে গিয়েছিল। আমার অনেক নতুন বন্ধু হয়েছলিও পরে। তোমাদের কথা মনে পড়ত না। কোথায় থাক তোমরা কে জানে। আমি কিন্তু এখনও আছি, তবে পাশের বিল্ডিংয়ে। আমার কেন যেন মনে হয় তুমি এখন দেশের বাইরে। সত্যি কি তাই?”

টেন্ডুলকারের কি বিশাল ভক্তই না ছিলাম এককালে। তাকে ইংলিশে লিখে দিব? “বহুদিন তোমার কোন খোঁজ রাখি না টেন্ডুলকার। মাঠে নাম কিনা তাও জানিনা, নাকি মাঠে নামার বয়স চলে গেছে? কি খবর ক্রিকেট দুনিয়ার? একবার স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ভারত ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম মনে আছে? সেই ছিল আমার প্রথম ও শেষ স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাওয়া। আমার চশমাটার কাঁচ ভেঙে পড়েছিল, কি কান্নাই না পেয়ে গেল এত দূরের মাঠ কি করে দেখব ভেবে। কিভাবে কিভাবে করে যেন পরে সামলে নিয়েছিলাম কাঁচটাকে।”

সেই প্রাইমারির গণ্ডি পেরুনোরও আগে রুটিন করে পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত যেই গুন্ডামুখো তাকে বলা যায় কিছু কথা। “তোমার চাহনি খুবই ভয়ংকর ছিল। পরে যখন তোমাকে মাঝে মাঝে দেখেছি, উস্কুখুস্কু ছিলে, আর ভয় লাগত না তখন। তবে জীবনের যেই সময়টাতে দেখতে সবচেয়ে খারাপ ছিলাম, তখনো তুমি আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে মজা পেতে, তোমার ধৈর্য্য আমার চেহারার উপর আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছিল, ধন্যবাদ নিতে পার।”

ইদানিং খুব মনে পড়ছে পিচ্চিকালের হাড় জিরজিরে পলাশ ভাইয়ার কথা। “মনে নেই তোমাকে তুমি করে বলতাম নাকি আপনি করে। প্রায় বিশ বছর হয়ে গেছে। শুনতাম বড় হয়ে যাবার পর তুমি অনেক অসুস্থ থাকতে, ওপেন হার্ট সার্জারির পর তোমাকে আমরা দেখতে গিয়েছিলাম। খুব উত্তেজিত ছিলাম এতগুলো দিন পর তুমি কেমন হয়েছ, আমাকে দেখেই চিনবে কিনা এসব ভেবে। জানো হসপিটালে গিয়ে শুনি তুমি সেদিনই রিলিজে নিয়ে চলে গেছ। সেখান থেকে বড় আপুদের বাসায় গেলাম। ওরা বলল একটু আগেই তোমাকে নিয়ে গিয়েছেন তোমার ভাই। হতাশ লাগছিল খুব। আর কখনো দেখা হয়নি।”

স্যারকে লিখব? ক্লাস নাইন আর টেন অংক করতাম উনার কাছে। “প্রিয় স্যার, সালাম নিবেন। আপনি কেমন আছেন? আমার কথা মনে আছে? সময়ানুবর্তী ছিলেন না একদমই। কিন্তু কত যত্ন করেই না অংক করাতেন। বুঝতে দেরি হলে মাঝে মাঝে মাথার তালুতে হাত দিয়ে দেখতেন ঠাণ্ডা আছে নাকি গরম। কোনরকম বকার কথা মনে পড়ে না। আপনার সাইকেলটা এখন কোথায়?”

আমার একজন গানের টিচারও ছিলেন। মাস শেষে টাকা নেয়ার সময় খুব ইতস্তত করতেন উনি। সম্ভবত এজন্য যে আমি উনার শিক্ষকের মেয়ে। একইরকম করে তো উনাকেও লিখতে পারি, “প্রিয় স্যার, সালাম নিবেন। আপনি কেমন আছেন? আমার কথা মনে আছে? আমি আর গানের চর্চা করিনি। ভাল লাগত না। আপনি কি এখনও গান শেখান? মনে আছে আপনি প্রায়ই বলতেন, স্যার না থাকলে আজকে মানুষ হইতাম না। পিতাগর্বে তখন মনে মনে উচ্ছ্বসিত হতাম খুব।”

অতিপ্রিয় রবীন্দ্রনাথকে লেখার সাহস হবে কিনা বুঝতে পারছি না। “শ্রদ্ধেয় রবিদাদু, তোমার ‘গল্পগুচ্ছ’ আমার অতি অতি পছন্দ। কাবুলিওয়ালার গল্পটা পড়ে আমার কান্না পেয়ে যায়। তোমার গান গুলিও কেমন করে এত অসাধারণ? আর ‘দুই বিঘা জমি’ তো আমার ভাঁজ করে পকেটে পুরে রাখতে ইচ্ছা করে। ওহো আমার জামায় তো পকেট থাকে না। আচ্ছা কি করলে তোমার মত করে লিখতে পারব? আসলে কোনদিন এমনটা আর কেউ পারবে না তাই না? প্রত্যেকটা মানুষই তো আলাদা। তাই কেউ কারো মত হয় না।”

বাসায় প্রথম ইন্টারনেট আসার পর ইটালিয়ান একজন নেটফ্রেন্ড হয়েছিল আমার কিছুদিন। লালচুলো লোকটার নাম লুকা। ইটালির ছবি দেখে খুব আফসোস হত কেন ওইরকম একটা দেশে জন্মালাম না। “হ্যালো লুকা, তোমার শেষ মেইলটার জবাব দিইনি শুধুমাত্র এই কারণে যে ইচ্ছা হচ্ছিল না। সেই যে সুনামি হল, এরপর একদিন হঠাৎ করে মেইল করে লিখেছিলে-আমি তোমাদের ওইদিকে সুনামির কথা জানতে পেরেছি, বন্ধু তুমি ভাল আছ তো? সরি লুকা আমি ভালই ছিলাম কিন্তু কেন যেন উত্তর দিতে ইচ্ছা করেনি। তোমার শেখানো ইটালিয়ান কথাবার্তা সব ভুলে গেছি। মিলানে কি এখন সামার? আশা করি তুমি এবং তোমার মা-ও কুশলে আছ।”

সেই সে হারানো নারিকেল গাছের কাছে লিখলে কি খুব হাসির ব্যাপার হবে? “তোমাকে যেদিন কেটে ফেলা হল, আমি বাথরুমে গিয়ে কি কান্নাই না কাঁদলাম। কলেজে পড়তাম তো, একটা কবিতা ছিল মনে আছে? ‘The Tree At My Window’. তুমি ছিলে আমার জন্য তাই। সেদিনের আগে বুঝতেও পারিনি তোমার জন্য আমার এত টান তৈরি হয়ে গেছে। এখন কিন্তু ভেবে লজ্জা পাই এত বড় বয়সে গাছ নিয়ে আদিখ্যেতা করেছিলাম ভেবে।”

কাউকে পাচ্ছি না কেন? অবাক করে দেয়ার মত খারাপ একজন কোন মানুষ খুঁজেই কি তাহলে চিঠিটা লিখতে হবে? “কেবল খেলার আনন্দের জন্য অন্যের অস্তিত্বকে হত্যাও বুঝি করা যায়? কুশ্রী কোন অপকর্মকে ভুলে থাকার ভান করলেও কি সেই অপকর্ম পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে পাপীর পিছু তাড়া করে না? বিবেকের বিষদাঁত অনেক বেশি ধারালো। ম্যাকবেথের কথা মনে আছে? হাত থেকে রক্তের অদৃশ্য দাগ মোছার জন্য সে পাগলপারা হয়ে গিয়েছিল।”

বরং একটা ভাল মানুষকেই নাহয় লিখলাম। “সততা আর মমতা থাকলে কাউকে অসুখী করা বা নিজের অসুখী হবার ভয় থাকে না তাই না? শুধুমাত্র ভালবাসা দিতে আর নিতে জানলেই জীবনটা অর্থবহ করে তোলা যায়। সৃষ্টিকর্তার কাছে নিশ্চয়ই সবার জন্য কিছু না কিছু আছেই। তাই নয় কি?”

হতে পারে পৃথিবীর আলো দেখেনি এমন কাউকেও কয়েক ছত্র পাঠিয়ে দিলাম। “প্রিয় অনাগত শিশু, জন্মের আগের মুহূর্তগুলো কেমন? আমি মনে করতে পারি না। নিরাপদ আবাস থেকে কাঁটাময় জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছ। উদ্বেগ হয়? হতেই পারে। তবে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে অসীম সম্ভাবনা। অনেক দিকে অনেক পথই খোলা। সুতরাং বেছে নাও। সিনেমায় দেখা আমার খুব পছন্দের একটা কথা বলি তোমাকে, it's the choices that make us who we are. And we can always choose to do what's right. "

জানি কাউকেই লেখা হবে না কিছু। অথচ আকাশের ঠিকানায় পত্র দেয়া কতই না সহজ।