কতদিন হল এখানে কিছুই লেখা হয় না। এটা আমার নিজের পত্রিকা; সবগুলো কলাম আমার নিজেরই কলাম; মূলত আমি নিজেই পাঠক। তবে অসীম ধৈর্য্যশীল কিছুসংখ্যক ব্যক্তি নিজ গুণে আমার এসব আঁকিবুঁকি পড়ে ফেলতে সক্ষম হন এবং যাবতীয় দোষত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। কি লেখা যায় বুঝে পাচ্ছি না বলে বিষয় হিসাবে “এতদিন কেন কিছুই লিখিনি তার কয়েকটা কারণ”কে ঠেলেঠুলে দাঁড় করিয়েছি। একটা হচ্ছে চিন্তাভাবনা থমকে গিয়েছিল। কিছুদিন আগে Daily Star থেকে একটা নতুন টার্ম শিখেছি, তা হল ‘writer’s block’। দেখা যায় কোন কারণ ছাড়াই লেখক কিছুই লিখতে পারছে না। ফলে আমি ধরে নিয়েছি যে আমার ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটেছে। সেক্ষেত্রে একটা সুবিধা হচ্ছে নিজেকে হোমরা চোমরা লেখক হিসাবে ভেবে নেয়া যায় যার কিনা মাথায় এত প্লট এত দর্শন যে একটার সাথে আরেকটার প্যাঁচ লেগে বিশাল জট তৈরি হয়ে যেতে পারে এবং সেই জট ভাবনার প্রবাহনালীতে ছিপি হয়ে আটকেও যেতে পারে। দ্বিতীয় সুবিধা হল অনেকদিন ধরে নতুন কিছু দেখা যাচ্ছে না কেন, এই মর্মে একটা প্রশ্ন তৈরি করা যায়, নিজেকে শোনানো যায় যে আমি ক্রমাগত যুগান্তকারী লেখনী সরবরাহকারী একজন ব্যাক্তি যার কয়েকদিনের অনুপস্থিতিতে চারিদিকে উদ্বেগের নহর বয়ে যায়। অন্য কারণটা হল “আসলে আমার সময় ছিল না”। কেন ছিল না সেই প্রশ্ন অবান্তর। কারণ সময়ের অভাবে বলতে গেলে কোন কাজই আমি করতে পারি না। আলমারির এলোমেলো কাপড়চোপড় গোছানো হয়ে উঠে না। শেলফের বইগুলো ঝেড়ে রাখা হয়না। ড্রয়ারে তল্লাশি চালিয়ে অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র বাতিল করা হয়না। পেপারে কয়েকটা জিনিস পড়ার জন্য আলাদা করে রাখলে আর কখনোই পড়ার সুযোগ পাই না ইত্যাদি। (আমাকে মনে হয় নোংরা টাইপের মানুষ মনে হচ্ছে, আমি মোটেও এতখানি নোংরা না।) আর আসলে ঠিক কি নিয়ে আমি এত ব্যস্ত তারও কোন সদুত্তর পাওয়া সম্ভব না।
ভাবছি কি লিখব। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে মাস তিনেক আগের ট্রেনভ্রমণটার কথা।
আমি যাচ্ছিলাম চট্টগ্রামে একটা বৌভাতে। সাড়ে দশটা কি এগারোটার ট্রেন ছিল। দীর্ঘ আট বছর পর রেলযাত্রা। উত্তেজনা চালু। তবে মৃদু দুঃখের বিষয় ছিল পেছনমুখী সিট। এতদিন পর কমলাপুর স্টেশান থেকে কোথাও যাচ্ছি অথচ ফিরে থাকতে হবে কিনা উল্টাদিকে। কেমন যেন গতি সময় প্রকৃতি সবাইকে তাচ্ছিল্য করে বিপরীতমুখে চলা। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ আগে পাশের সারিতে সুদর্শন তরুণের আবির্ভাব, আমার পিতার পাশে তার আসনগ্রহণ এবং তাদের নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতা। জানালায় মুখ ফিরিয়ে নিজেকে বললাম, কন্যা, প্যাকেজ নাটকের প্লটে জায়গা পাওয়ার পক্ষে তোমার বয়সটা একটু বেশি হয়ে গেছে, কলেজপড়ুয়া ছোটবোনদের রাজত্ব সেটা। একটা সময় ট্রেন ছাড়ল। ক্রসিংয়ে সবাইকে দাঁড় করিয়ে যখন আমরা পার হই নিজেকে রাণী রাণী লাগে। দেখ তোমরা আমাকে কত সম্মান দিচ্ছ। শহর ছাড়িয়ে শহরতলী, শহরতলী ছাড়িয়ে গ্রামের মাঝ দিয়ে চলা শুরু করতে করতে মাঝরাতের সীমানা পেরিয়ে গেল। জানি না সবার কেমন লাগে, আমার কাছে গভীর রাতে এভাবে আঁধার চিরে ঝিকঝিক করে ছুটে যেতে নাম না জানা একরকম অনুভূতি হচ্ছিল। চোখের আওতায় থাকা অল্পসংখ্যক মানুষের প্রত্যেকে ঘুমিয়ে কাদা। ভেবে নিতে ভাল লাগছিল এই বগিতে, এমনকি এই পুরো ট্রেনে আমিই একমাত্র সজাগ যাত্রী। বাইরে মাইলের পর মাইল জনমানুষহীন প্রান্তর। হঠাৎ হঠাৎ দূরে টিমটিমে আলো দেখা যায়, যেই আলো কেবল এগোতেই থাকে, এগোতেই থাকে, নাগাল পাওয়া যায় না। আমি সেটাকে ভৌতিক আলেয়া ধরে নিলাম। ছাইরঙা রাতে জনমানবহীন পাথার চিরে ধেয়ে যাচ্ছে ট্রেন। যখন আমি জানালায় মুখ রাখি, চোখ যখন দূরে যায়, একটা ভয়ের শিহরণ খেলে যায় গায়ে। তার মাঝে মেঘের ঘনঘটায় কিছুক্ষণ পরপর সাপের জিভের মত বিদ্যুতের ঝলকানি। প্রতিবারই মনে হয় আজকে আমি একা এমন একটা কিছু প্রতক্ষ্য করব যা অলৌকিক, যা ব্যাখ্যাতীত। চরাচর আমাকে অশরীরী কোন দৃশ্য দেখানোর আয়োজন করছে। খুব ইচ্ছা হচ্ছিল কামরার লাইট কেউ অফ করে দিক, যেন “ওরা” আমাকে দেখতে না পায়। ভয় হচ্ছিল হঠাৎ হয়ত কোন পাশবিক শক্তি আমাকে এক টানে জানালা দিয়ে বের করে নিবে কিংবা নিশির ডাকে আমি নিজেই ঝাঁপ দিব, ঘুমন্ত সহযাত্রীরা জানতেও পারবে না কেউ। এত কিছুর পরও চোখ সরাতে সাহস পাচ্ছিলাম না। কারণ চোখ সরালেও আমি ভয়ংকর কোন শাস্তি পাব। এখন এই ইটসুরকির ছাদের নীচে বিষয়টা যতখানি হাস্যকর বলে মনে হচ্ছে ওই মুহূর্তে ততখানিই বাস্তব বলে বোধ হচ্ছিল। এই দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বলতে পারি না। যখন চোখ মেললাম তখন আকাশ ফরসা হচ্ছে। একদিন পর যখন দিনের আলোয় একই পথে ফেরত আসছিলাম, দেখলাম সেইসব অপার্থিব অজাগতিক জায়গাগুলি আসলে নিরীহ প্রান্তর, ক্ষেতখামার আর মাঠ। উপযুক্ত পরিবেশ আর আকাশকুসুম ভাবার জন্য মুখিয়ে থাকা একটা মন পেলে অ কে অজগর বানিয়ে নেয়া খুব সহজ। তবে ভয়টা উপভোগ্য ছিল একথা অনস্বীকার্য।
যাই হোক। অনেক কথাই বলা হল। মানে লেখা হল। ধন্যবাদ অক্ষররাশিকে। তারা আছে বলেই এলোমেলো কথামালাকে ধীরেসুস্থে পরিশীলিত রূপ দেয়ার চেষ্টা করা যায়। যাঁরা সফল হন, তাঁদেরকে সাধুবাদ; আর যারা আমার মত ঘূর্ণিতে ঘুরতে ঘুরতে খেই হারিয়ে ফেলে তাদেরকেও শুভেচ্ছা।
(একটা কথা বলা বাকি রয়ে গেল। পাশের সারির তরুণ চট্টগ্রাম যাচ্ছিল তার বাবা মা'কে খুঁজতে। বাবা মা নাকি নিজেরদের মধ্যে ঝগড়া করে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। কোথায় যাবে জানিয়ে যায়নি। ছেলেটা এখন সম্ভ্যাব্য স্থানগুলোতে সন্ধান করে দেখবে। ছোট ভাইবোনদেরকে বাসায় রেখে বের হয়ে এসেছে। তার বাবা মা নাকি আগেও এমন করেছে। কোথায় কোথায় খুঁজবে সে কে জানে। কখন পাবে তাই বা কে জানে। ঘুমন্ত ছেলেটাকে দেখে মায়া লাগছিল। নেহায়েত ছোটমানুষ। আশা করি তাকে বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়নি।)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
5 comments:
onekdin por abar keyboard a lekhikar angul rkahrar jonno dhonnobad. train journey er bornona upovoggo chilo. jodio shurur vumika valo lage nai.
blue spark কেও অনেক ধন্যবাদ অনেক দিন পর মন্তব্য করার জন্য। :-)
lekhokh ra fakibaz hoi..eta common...and aj k dekhtey pelam era abar ujuhat o dekhacchey.....prothom er ei habi jabi buj dieye luv nei... lekhata ager moto regular lok...
jogot shongshar e onek bestotar virey je lekhoni tuku ber hoi ta onnoder onektai relax kore.....
@suktara, bhalo hoeye jaan...nailey "mairer upor shudh nai.."....
রাইটার্স ব্লক নিয়ে এত ভাল লেখা!!!!
onek din lekha nai.....:(.....tomar blog er regular pathok kintu onek.......
Post a Comment