Sunday, May 18, 2008

চাকা

ছোটখালার বাসায় থাকতে গিয়েছিলাম দুই রাতের জন্য। ষোলতলার উপর ছোট্ট বাসা। বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখতে একটু অন্যরকম লাগে। মনে হয় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আমার চোখের সমান্তরাল কোন জায়গা থেকে তৈরি হচ্ছে, আকাশ থেকে নামছে না। বৃষ্টিটা রোগা ধরণের ছিল। বেশি ঝড় হলে নাকি গাদা গাদা বালি ঢোকে আর পানিও চলে আসে। তা হবে। আকাশের কাছে বসবাসের সুবিধা অসুবিধা দুইই আছে। যখন বারান্দায় একা একা বসে ঘরের সদস্যদের হাঁটাচলা দেখতাম বারবার পুরানো কথা মনে আসত। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি খালার তখন বিয়ে হয়। আমার বাচ্চ বয়সের একটা বড় সময় তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। সৌখিন ছিলেন বেশ। খুব মন দিয়ে চুলের যত্ন নিতেন, নানা ধরণের জিনিসপত্র যোগাড় করে। মাঝে মাঝেই পত্রিকা দেখে নতুন নতুন খাবার রান্না করতেন। ধৈর্য্য ধরে চমৎকার সব সেলাই তুলতেন জামাকাপড়ে। গল্পের বই পড়তেন বেশ। তার কম্পিউটার ক্লাসের একটা খাতা ছিল, যেখানকার লেখাগুলোর মানে আমার শিশুমস্তিষ্কে কিছুই ঢুকত না। নিজের জন্য অনেকখানি সময় বরাদ্দ ছিল দিনের। এখন তার নিজের ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়ে। তাদের পেছনে অতিষ্ঠ হয়ে নাকি তার মাথার চুল পেকে যাচ্ছে। ছোটখালার ব্যস্ততা এখন একেবারেই অন্যরকম। ঘরদোর গোছাতে হয়। রান্না করতে হয়। দুই ছেলেমেয়ের জন্য সময় দিতে হয়। অবাক লাগে, কিছু বছর আগে এই ছোট দুইটা মানুষের অস্তিত্ব ছিল কোথায়? তাই বলে অস্বাভাবিকও তো লাগে না কিছুমাত্র। এখন ছোটখালার নিজেকে নিয়ে থাকার সময়টা কমে এসেছে অনেকটুকু। সারাক্ষণই করার জন্য কোন না কোন কাজকর্মআছে। আর যখন তেমন কোন কিছু থাকে না তখনও মেয়েটা নাহয় ছেলেটা কিছু নিয়ে হাজির হয় বা খালা নিজেই কিছু একটা খুঁজে নেন। এককালে তিনি নানুরবাড়িতে ছোটদের মুরুব্বি থাকলেও এখন ওখানে কেবল মেহমান হয়েই থাকা হয় অল্প কিছুদিনের জন্য। সুন্দর পিঠ ছাপানো চুল এখন মনোযোগ না পেয়ে ক্লিষ্ট বললেই চলে। হাতে তৈরী পোশাকের চেয়ে তার পছন্দ চট করে মার্কেটে গিয়ে রেডিমেড কিছু একটা কিনে নেয়া, তাতে সময় কম লাগে। এরপরও আবার দারুণ উৎসাহ নিয়ে আমের আচার বানাতে বসেন। অবসর পেলে খালুকে নিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে আসতে চান। অর্থাৎ তার দিনকাল সন্তান সংসার কেন্দ্রিকই হয়ে পড়েছে। নিজের মায়ের কথা মনে হল। আম্মুও বেশ কিছু বছর আগে ফাঁক পেলেই বিছানাচাদরে, নিজের শাড়িতে ফুল করতেন, আমার জামা সেলাই করতেন, স্পেশাল খাবার বানাতেন। এখন অত আগ্রহ নাকি লাগে না। অফিস থেকে ফিরে আগের মত উদ্যম থাকেনা। বিশ্রাম নিতে হয়। তারপরও ঘরের কাজ তো আছেই। কখন যেন বেলা কেটে যায় এই চাকার আবর্তে। কয়েকটা বছর পর ছোটখালার দশাও নিশ্চয়ই এমনই হবে। চালসে ভর করবে, এখন যা যা করতে ক্লান্তি লাগে না সেসবও তখন ঝামেলা মনে হবে। তার ছেলেটাও মেয়েটাও তখন বড় হবে। আমার মত নিজের ঘরে নিজের “ব্যস্ততা” নিয়ে থাকবে। মায়ের অনেক কথাই ব্যাকডেটেড মনে হবে হয়ত। এমনই কি হয়? সবারই একটা পরিবার হয়? ওই নিয়েই সব পরিকল্পনা গড়ে ওঠে? এই যে আমি ভাবি আমি এমন করব তেমন করব তার কিছু কি করা হবে না? চাকরি করে টাকা জমিয়ে কিনব বলে যেসব জিনিসের লিস্ট বানাই, সব তুচ্ছ হয়ে পড়বে ছেলেমেয়ের বায়না মেটা হাসিমুখের কাছে? এই যে ঘরটাতে সারাদিন পড়ে থাকি, এখানে কয়েকটা দিন কাটলেই “বাসায়” যাবার জন্য অধীর হব? মেয়েগুলো সব মা হয়ে ওঠে? ছেলেগুলো একদিন বড় হয়ে বাবা হয়ে বসে? আর এই আবর্তন নিয়ে কেউ অসুখীও থাকে না? এটা ধ্রুব সত্য। তারপরও উদাস মনে নাড়া দেয়...।

2 comments:

মুক্তপাখি said...

একেই বলে .. Priorities in life...
জীবনের একেক সময় এটা একেক রকম...

তরে "চাকা" শব্দটা যথার্থ হয়েছে...আসলেই ত আমাদের জীবনকালটা চাকার মতনই...

shawon said...

nice lekha... kintu somadhan nei.. passive acceptance of everything....