Friday, April 25, 2008

চিঠি

রবীন্দ্রনাথের “ছিন্নপত্র” পড়তে বেশ লাগে। চিঠির ভেতর সুখ দুঃখ হাসি ঠাট্টা কেমন চমৎকার বিনুনি করে লেখা। মাঝে মাঝে পত্রিকায় বা টিভিতে বয়স্কজনরা আক্ষেপ করে বলে থাকেন চিঠি কি তবে আমাদের জীবন থেকে হারিয়েই গেল? তাই হবে। এখনো না হারিয়ে গিয়ে থাকলে অচিরেই যে যাবে সন্দেহ নেই। যে এখন কাগজকলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসে, সে যে শখ করেই কাজটা করছে কে না বুঝবে। সৌখিনতার বস্তু একসময় নিত্যপ্রয়োজনের বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। আবার নিত্যকার দরকারি কিছুও যে কালে কালে নিছক সৌখিনতা হয়ে উঠতে পারে এটাও দেখি ভুল না।

অবস্থার বদল না হলে কেমন হত? হয়ত ভোরবেলা ঘুম ভেঙে উঠলাম। নাশতার টেবিলে বসতেই দরজায় টুংটাং বেল। দরজা খুলতেই দেখি ডাকপিওনের মুখ। “আপুমণি আপনার চিঠি আছে।“ তারপর সে আমার হাতে তুলে দিল একটা সাদা অথবা গোলাপি অথবা হোক সাধারণ হলদে রঙেরই একটা খাম। আমার চোখ আনন্দ আর উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করতে থাকল। খামের মুখ ছিঁড়তেই প্রতীক্ষিত আকাঙ্খিত একটা ভাঁজফেলা কাগজ। আমি হাসিমুখে পড়ছি, ধীরে ধীরে, যেন না ফুরায়...। কল্পনাটা মনে হয় প্রেমের গল্পের কোন একটা অংশের মত হয়ে যাচ্ছে। তা আমার উদ্দেশ্য না। চিঠি লেনদেনের পরিণতি যে কেবল ভালবাসাবাসির দুয়ারে গিয়েই মিলবে তা তো নয়। তা নির্দোষ বন্ধুত্ব, নির্মোহ ভাললাগা তো হতেই পারে। কত কত দিন হয়ে গেল চিঠি পাওয়া হয় না, চিঠি লেখা হয় না। তার চেয়েও বেশি দিন ধরে পরীক্ষার খাতায় কিংবা ক্লাসনোটে বাংলা হরফের চিহ্ন চোখে পড়ে না।

একবার বাসায় একটা মজার চিঠি এসেছিল। ‘প্রথম আলো’ অথবা ‘ভোরের কাগজ’ এর সঙ্গে সাপ্তাহিক একটা ম্যাগাজিন ছিল ‘গ্যালারি’ নামের। ক্লাস নাইনে সেখানে একবার কুইজে আমি প্রাইজবন্ড জিতি। তো আমার নাম ছাপা হয় ঠিকানাসহ। কিছুদিন পর বাসায় একটা চিঠি হাজির। ময়মনসিংহের এক লোক আমাকে বন্ধু ভেবে ফেলেছে। এবং আপনি আপনি করে লিখতে লিখতে হঠাৎ “মনের অজান্তে কখন যেন” তুমি করে লেখা শুরু করেছে। চিঠিটা আবার গোলাপ আঁকা বেগুনি রঙের কাগজে লেখা। একটা লাইন আমার পুরোপুরি মনে আছে- “আমার চোখের কোণে বিরাজ করে এক অজানা হারানোর ব্যথা সুন্দরকে হারানোর ভয় আর ব্যথিত হবার যাতনা”। আমি তার নিপীড়িত অক্ষিযুগলের কি উপকারে আসতাম কে জানে। বিব্রতকর ব্যাপার হল চিঠিটা আবার বাসায় অন্যরাও খুলে খুলে পড়েছে। ওই ছাপানো নামঠিকানার বদৌলতে পত্রমিতালিতে উৎসুক আরো কয়েকজন মানুষের বার্তা আসে বাসায়। পরে এভাবে ঠিকানা না ছাপানোর অনুরোধ করে আমি একটা চিঠি পাঠাই ওই পত্রিকায়।

কিছু প্রাপকহীন পত্রও তো থাকে। নিজের কথাকে কারো সঙ্গে বলার মত করে লেখা। এটা ডায়রি লেখারই নামান্তর। প্রিয় অমুক বলে কাউকে ডেকে ডেকে কথা বলাটা হয়ত একটু সহজ হয়। Anne Frank এর বিখ্যাত ডায়রির মত করে। কোথায় চলে যাচ্ছে সব! আমি মানুষটা তত নতুন না বলে চিঠিপত্রের মর্ম বোঝার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ভবিষ্যতের প্রজন্ম অনেক নতুন কিছু জানবে। কিন্তু চিঠিকে জানা হবে না। যেমন আমরা অনেককিছু জানলেও কতকিছুই জানি না। অস্বীকার করার উপায় নেই যে তবুও ইমেইল আনন্দ দেয়। ইংরেজির ছাঁচে ফেলা বাংলা পড়া খুব বেশি সুখকর না হতে পারে, তাই বলে নিতান্ত দুঃখেরও না। নাহয় ইনবক্সে কিছু একটা আছে জানলে চোখ চকচক করে কেন? পড়তে পড়তে শেষদিকে নেমে এলে মনমরা লাগে কেন? তবে যে যাই বলুক কাগজের উপর কালির বিন্যাসের আবেদনটা আসলেই অন্যরকম। একেকটা হাতের লেখা একেক ধরণের হবার সুযোগ থাকে, ফন্ট নামের সাম্যবাদী উড়ে এসে সবাইকে এক কাতারে নামিয়ে ফেলতে পারে না। হাতে লেখা চিঠি ভাঁজ করে জমিয়ে রাখা যায়। হঠাৎ কেউ দেখে ফেলার দুশ্চিন্তায় বুক ধুকপুক করানো যায়। বহুদিনের ব্যবধানে নকশাকাটা কাগজের টুকরোটা একদিন পাণ্ডুর হয়ে যাবার ভয়ও থাকে। আর হাতে লেখা চিঠি একদিন পথের বাঁকে ভুল করে হারিয়েও যেতে পারে। ইমেইলের মত অমরত্ব বটিকার কোন বালাই নেই তার। কোন পাসওয়ার্ডের ধার ধারে না। হয়ত মরণশীল আর আর জরাক্রান্ত হবার ঝুঁকি আছে বলেই চিঠি এত প্রিয় হয়ে ওঠে। কে না জানে যে অক্ষয়ের চেয়ে ক্ষয়শীলকেই বেশি আদুরে মনে হয়!

কাগজের চিঠির চল যদি এখনো আগের মত থাকত? আমরা কাউকে কাউকে নিয়মিত লিখতাম নিশ্চয়ই। “কেবল আমারই সংবাদ জানতে উৎসুক হয়েছ। কিন্তু বিভুঁইয়ে বাস কর বলে কাঁচা গ্রীষ্মের দাবদাহে ঢাকাবাসী সকলের ওষ্ঠাগত প্রাণবায়ু যে বাস্তবিকই দেহের খাঁচাখানা ছেড়ে উড়াল দেবার জো করেছে তা কি সত্যই তোমার জ্ঞানসীমানায় নাই?” নাহ! ‘ছিন্নপত্র’ মাথাকে গুবলেট করে দিয়েছে। আজকাল কি আর এমন পেঁচিয়ে লেখা হয়? বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রচনার শিল্পগুণ’ যেই ‘প্রাঞ্জলতা’র সন্ধান করত, তার রূপ এখন অনেক ভিন্ন।

হঠাৎ একদিন রাজ্যের কথায় ঠাসা একটা নামহীন চিঠি এসে পড়ে না কেন আমার বাড়িতে? হাত পা ছড়িয়ে ভাবতে বসতে পারতাম।

8 comments:

Shahidul Mahfuz said...
This comment has been removed by a blog administrator.
শুকতারা said...

ধন্যবাদ। এই লেখাটা আমার নিজেরও কিছুটা পছন্দের। দূরে থাকা প্রিয়জনের চিঠি প্রিয় হয়। তবে কাছাকাছি থাকা কারো সাথেও চিঠির লেনদেন হতে পারে যেখানকার কথাগুলো কখনো সামনাসামনি বলা হয় না। সেটা অন্য একটা জগত। সেও দারুণ একটা অনুভূতি।

SIXTH SENSE said...

When did you start writing?...I mean blog...

I really enjoyed...

Blog sphere will definitely be enriched with such participation.

Keep it up dear.

sabbir

মুক্তপাখি said...

চিঠি নেই, এখন হলো লুকিয়ে লুকিয়ে SMS পরা... :)

Shahidul Mahfuz said...
This comment has been removed by a blog administrator.
মুক্তপাখি said...
This comment has been removed by the author.
Ishtiaque Zico said...

কাগুজেচিঠিতৃষ্ণাবিলাসীমন!

চিঠি নিয়ে একটা ভয়ঙ্কর (তিন মাত্রার) গল্প উৎপাদিত হচ্ছে ফ্যাক্টরিতে, মাথায়। হয়ে গেলে ভিডিও ছবি বানাবো।

শিশিরবিন্দু said...

কয়দিন আগে একটা চিঠি পেয়েছি। একদম সাদা কাগজের উপর কালির বিন্যাস। কতবার যে উলটে পালটে দেখলাম!এ এক অন্যরকমের ভাল লাগা অনুভুতি। কিছুই ছিলনা তেমন, তবু ভাল লাগছিল।