সন্ধ্যায় আমার বন্ধু লিটল ম্যাগ থেকে তার পড়া একটা গল্প সংক্ষেপে শোনালো। শুনতে ভাল লেগেছে, পড়তে হয়ত আরো ভাল লাগবে। বাসায় ফিরে মনে পড়ল সেকেন্ড ইয়ারে পড়া “টেস অব দ্য ডার্বারভিল” এর কথা। অতীত ঝেড়ে নতুন জীবন শুরু করতে যাওয়া টেস তার অতীতের অনাকাঙ্খিত একটা ঘটনা নিয়ে খুব শঙ্কিত। নতুন করে যার সঙ্গে তার ভালবাসার সম্পর্ক হয় সে এই ব্যাপারটা জানলে কিভাবে নিবে এটা ভেবে টেস সবসময় মানসিক কষ্টে ভুগত। এবং বিয়ের রাতেই স্বামী এঞ্জেলকে সে জানিয়ে দেয় কেমন করে সে কুমারীত্ব হারায় আর পরবর্তীতে সেই সন্তানকেও হারায়। এর আগে এঞ্জেলও স্ত্রীর কাছে স্বীকার করে লন্ডনে থাকাকালে এক মহিলার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা। এঞ্জেলের ব্যাপারটা টেস একবাক্যে হজম করে নেয়, হয়তবা নিজেরও কিছু বলার ছিল বলে। কিন্তু টেসের অতীত জানার পর এঞ্জেল কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। সেই মুহূর্তেই সে ত্যাগ করে টেসকে। টেসের জীবনের যন্ত্রণাদায়ক অধ্যায় আরম্ভ হয়। অনেকদিন পর এঞ্জেল তার ভুল বুঝতে পারে, টেসের কাছে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু সহায়সম্বলহীন টেস তখন আবার ফাঁদবন্দী মূষিক। ভুগতে ভুগতে শেষ পর্যন্ত টেসের মৃত্যু ঘটে একদিন। পটভূমি উনিশ শতকের ইংল্যান্ড। আর আমরা পড়েছি একবিংশ শতাব্দীতে। আমাদের প্রাথমিক মন্তব্য ছিল টেস একটা স্টুপিড, কারণ এঞ্জেল তাকে ছেড়ে যাবার পরও সে ভালবাসা নিয়ে এঞ্জেলের পথ চেয়ে বসে থেকেছে। আর এঞ্জেল একটা অসচ্চরিত্র লোক, কারণ যেই টেসকে পাবার জন্য সে পরিবারের বাধাও উপেক্ষা করেনি সেই টেস আসলে তার কাছে পুরোই শরীরসর্বস্ব। আমাদের আপত্তি ছিল মেনে যদি নিল তো দুইজনই মেনে নিল না কেন আর যদি কঠিন প্রতিক্রিয়া দেখাতে হল তো উভয়েই দেখাল না কেন।
আমরা এখনো এভাবে কথা বলি, রুমার হাজব্যান্ড উদারমনস্ক, রুমার পুরনো সম্পর্ক নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলে না। ঝুমার স্বামী খুব ভাল মানুষ, সে চায় ঝুমা ঘরে বসে না থেকে কিছু একটা করুক। কোন ছেলে যখন তার স্ত্রীকে শিল্পকাজে উৎসাহ দেয়, তার সুখদুঃখ সত্যিকারভাবে অনুভব করে, যখন সে তার স্ত্রীর প্রতি বন্ধুসুলভ হয়, আমরা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হই। বলি, অমুক আসলেই একজন চমৎকার লোক। একই কাজটা যখন মেয়েটা করে, একে কি আমরা উল্লেখযোগ্য কিছু মনে করি? কর্ত্রী কর্তার টাই ঘড়ি মোজার হদিস রাখবেন আর সারাদিন অফিস করেও কর্ত্রীকে এক হাতেই হেঁসেল ঠেলতে হবে। কেউ যদি বউয়ের সাথে কাজে হাত লাগায় আমরা মুগ্ধ হয়ে তার বাস্তববুদ্ধির তারিফ করি। ছেলেদের স্বভাব কি এতই মন্দ যে তাদের উচিত আচরণটাও কমপ্লিমেন্ট দেয়ার মত বিষয় হয়ে ওঠে? আমাদের দেখা পরিবারগুলোতে বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্ত কি আসলে দুইজনের মিলিত আলোচনার ফসল হয়? একথা সত্যি যে আমরা টেসের সময় থেকে অনেক এগিয়ে এসেছি। তবুও আপাত চোখে যত উন্নয়ন দেখা যায় সেটাকে প্রকৃত করার জন্য রক্তে গেঁড়ে বসা কমবেশি গোঁড়ামিকে অনেক জোরে ধাক্কা দেয়ার প্রয়োজনটা এখনো দূর হয়ে যায়নি।
Wednesday, February 27, 2008
Tuesday, February 19, 2008
হঠাৎ বৃষ্টি
“মেঘ গুড়গুড় মেঘলা দিনে ময়ূর ডাকে কেকা
সবাই লুকায় ঘরের কোণে ময়ূর নাচে একা”
‘আমার বই’ প্রথম ভাগের কবিতা। আজকে বিকালে হঠাৎ করে কেমন মেঘলা হয়ে গেল প্রকৃতি! আমি পরম সুখে দিবানিদ্রা দিচ্ছিলাম। চোখ খুলে গেল আপনাআপনি। দেখি আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। একটু আধটু গুড়ূম গুড়ুম ধ্বনিও। তখনই মনে পড়ল কবিতাটা। আমি ময়ূর হলে পেখম ছড়িয়ে নৃত্য জুড়ে দিতাম। তবে সেটা বড়ই সময়সাপেক্ষ। প্রথমে মানুষের বেশভূষা ছাড়তে হবে, তারপর পাখিসাম্রাজ্যে কড়া নাড়তে হবে, অতঃপর ক্যাটালগ দেখে ময়ূরজাতি বেছে নিতে হবে এবং সবশেষে পুরুষ হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এতসব করে যখন রেডি হয়ে বেরিয়ে আসব ততক্ষণে মেঘ হয়ে যাবে উধাও। তাই সেই চিন্তা বাদ দিয়ে আমি ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করার জন্য জানালায় উঁকিঝুঁকি মারলাম। মজার ব্যাপার হল আজকের মেঘের রংটা একটু বিচিত্র। ধূসর নীল না হয়ে বরং নীলচে ধূসর। দু’টো বিল্ডিংএর মাঝ দিয়ে যেই একটুখানি আকাশ দেখা যায় সেটা যেন চোখে পড়ল না। ছাইভস্মমাখা এমনই অদ্ভূত রং যে আমার মাইয়োপিক চক্ষু ধোঁকা খেয়ে গেছে। কয়েকটা ফোঁটা পড়েছে। এখনো বিকাল মিলিয়ে যায়নি। ভাবছি আবার শৈত্যপ্রবাহ নেমে আসবে কিনা। ওঝার বাণের তোড়ে অতিষ্ঠ হয়ে শরীর ছেড়ে পালানোর সময় শাঁকচুন্নি যেমন আমগাছের ডালটা ভেঙ্গে দিয়ে যায় তেমন যাবার কালে শীতবাবাও কিছু দেখিয়ে যাবে ভাবছে নাকি? এটা কেমন কথা হল! নেচে গেয়ে বসন্তবরণ হল, পৌষমাঘের পাট চুকিয়ে দিলাম, ঠাণ্ডার বাক্সপেটরা গুছিয়ে এনেছি প্রায়, এখন এসব মোটেও ভাল লাগছে না কিন্তু।
সবাই লুকায় ঘরের কোণে ময়ূর নাচে একা”
‘আমার বই’ প্রথম ভাগের কবিতা। আজকে বিকালে হঠাৎ করে কেমন মেঘলা হয়ে গেল প্রকৃতি! আমি পরম সুখে দিবানিদ্রা দিচ্ছিলাম। চোখ খুলে গেল আপনাআপনি। দেখি আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। একটু আধটু গুড়ূম গুড়ুম ধ্বনিও। তখনই মনে পড়ল কবিতাটা। আমি ময়ূর হলে পেখম ছড়িয়ে নৃত্য জুড়ে দিতাম। তবে সেটা বড়ই সময়সাপেক্ষ। প্রথমে মানুষের বেশভূষা ছাড়তে হবে, তারপর পাখিসাম্রাজ্যে কড়া নাড়তে হবে, অতঃপর ক্যাটালগ দেখে ময়ূরজাতি বেছে নিতে হবে এবং সবশেষে পুরুষ হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এতসব করে যখন রেডি হয়ে বেরিয়ে আসব ততক্ষণে মেঘ হয়ে যাবে উধাও। তাই সেই চিন্তা বাদ দিয়ে আমি ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করার জন্য জানালায় উঁকিঝুঁকি মারলাম। মজার ব্যাপার হল আজকের মেঘের রংটা একটু বিচিত্র। ধূসর নীল না হয়ে বরং নীলচে ধূসর। দু’টো বিল্ডিংএর মাঝ দিয়ে যেই একটুখানি আকাশ দেখা যায় সেটা যেন চোখে পড়ল না। ছাইভস্মমাখা এমনই অদ্ভূত রং যে আমার মাইয়োপিক চক্ষু ধোঁকা খেয়ে গেছে। কয়েকটা ফোঁটা পড়েছে। এখনো বিকাল মিলিয়ে যায়নি। ভাবছি আবার শৈত্যপ্রবাহ নেমে আসবে কিনা। ওঝার বাণের তোড়ে অতিষ্ঠ হয়ে শরীর ছেড়ে পালানোর সময় শাঁকচুন্নি যেমন আমগাছের ডালটা ভেঙ্গে দিয়ে যায় তেমন যাবার কালে শীতবাবাও কিছু দেখিয়ে যাবে ভাবছে নাকি? এটা কেমন কথা হল! নেচে গেয়ে বসন্তবরণ হল, পৌষমাঘের পাট চুকিয়ে দিলাম, ঠাণ্ডার বাক্সপেটরা গুছিয়ে এনেছি প্রায়, এখন এসব মোটেও ভাল লাগছে না কিন্তু।
Tuesday, February 12, 2008
সন্ধ্যাবেলা
রোজ খানিকটা করে দিনের দৈর্ঘ্য বেড়ে চলেছে। যেভাবে এগোচ্ছে, আমার তো মনে হচ্ছে জুনের মাঝখান আসতে আসতেই সূর্যাস্ত আটটায় গিয়ে ঠেকবে। কিন্তু কিভাবে কিভাবে যেন ম্যানেজ করে নেয় প্রকৃতি। জুনও আসে কিন্তু আবার আটটাও বাজে না। আমাদের একটা ব্যাপার কিন্তু বেশ। আমরা মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়ায় দিন আর রাতের সীমারেখাটা আজান দিয়ে ভাগ করে দেয়া যায়। মাগরিবের আগে দিন আর মাগরিবের পরে রাত। দারুণ একটা নিয়ম। আজান দিল খেলা শেষ বাসায় ফেরো। আজান দিল হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বস। আজান হচ্ছে, ঘরের বাতি জ্বালাও। একটা ফোল্ডার আজকের মত বন্ধ কর এবং আরেকটা ফোল্ডার খোল। খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ দেশে এই নিয়মটা পাওয়া যাবে না। আমি যদি এখন হঠাৎ নিউইয়র্ক বা ভিয়েনায় চলে যাই প্রথম বেশ অনেকদিন আমার বিকাল আর সাঁঝের মাঝে দাগ দিতে বেশ অসুবিধা হবে। বলা যায় দিন ভাগ করার কি বা প্রয়োজন? আসলে অভ্যাস। রাত থেকে দিনকে আলাদা করতেও আজান। আমি এটা টের পাই না, তাই অভ্যাসও হয়নি। সূর্যোদয় দেখতে সূর্যাস্তের চেয়ে অনেক সুন্দর। অন্তত বেশিরভাগ মানুষ তাই বলবে। কারণ হতে পারে এই যে আমরা আলোর প্রতি দুর্বল। আলো ফুটতে থাকা মানেই শুভসূচনা। আমাদের পাঁচটা বেলা আর সবকয়টার শুরু বা শেষ আজান দিয়ে। ধর্ম মানুষকে যেসব শেখায় তার মধ্যে শৃংখলা আর নিয়মানুবর্তিতা অন্যতম। অধার্মিকের নিয়মনিষ্ঠা নেই তা বলব না। আমি নিজে যেমনই হই না কেন, আশপাশের ধর্মাচারের প্রভাব আমার উপর আছেই। এটা না দেখলেই বরং একটু অস্বাভাবিক লাগবে।
বলছিলাম আসলে গোধূলির কথা। আমাদের আগের বাসাটা ছিল ছয়তলায়। বেশ আলো পাওয়া যেত। মাঝে মাঝে উজ্জ্বল দিনে গোধূলি মিলিয়ে যেতে একটু বেশি সময় নেয়। তখন সেই সময়টা ছিল ভয়ের। কারণ আমি কোন একভাবে জেনেছিলাম কিয়ামত হবে সূর্যাস্তের সময় এবং তখন সূর্য ডুবে গিয়ে পশ্চিম দিক থেকে আবার উঠবে। কেমন একটা আতংক হত। তার ওপর আমার বারান্দা ছিল পশ্চিমমুখী। আমি দেখতে পেতাম পশ্চিমের আকাশ আবার যেন আলো হয়ে উঠছে। এখন ভাবলে হাসি পায়। বাসায় থাকলে বিকাল থেকে সন্ধ্যা হবার সময়টা আমার মোটেও পছন্দ না। কোন কাজ করতে ভাল লাগে না আবার অলস বসে থাকতেও ভাল লাগে না। মেজাজ একটু তিরিক্ষি হয়ে পড়ে। ওই ছয়তলার বাসায় রোজার দিনে অর্ধেক ইফতারের পর আমি তাড়াহুড়া করে বারান্দায় চলে আসতাম। রাস্তা দেখার জন্য। কারণ ওই সময় সুনসান হয়ে থাকে অলিগলি, রোজা না থাকলে এমনটা পাওয়া যায় না। হঠাৎ হঠাৎ কোন একজনকে হয়ত চলতে দেখা যেত। ভর সন্ধ্যায় সোডিয়াম বাতির নিচে একাকী পথিক। আমাদের গ্রামে গোধূলির সময়কে বলা হয় “পাঁচ ওক্তের এক ওক্ত”। মজার ব্যাপার হল এই phrase শুধু এই সময়ের জন্য প্রযোজ্য, বাকি চারটা “ওক্ত”এর জন্য না। “পাঁচ ওক্তের এক ওক্ত” তে চুল বেঁধে না রাখলে আমার দাদী বিরক্ত হন। আঁচড়ে ফিটফাট করে রাখলেও চলবে না, বাঁধা হতে হবে। খোলা চুলে কত কি ঢুকে পড়তে পারে!
বলছিলাম আসলে গোধূলির কথা। আমাদের আগের বাসাটা ছিল ছয়তলায়। বেশ আলো পাওয়া যেত। মাঝে মাঝে উজ্জ্বল দিনে গোধূলি মিলিয়ে যেতে একটু বেশি সময় নেয়। তখন সেই সময়টা ছিল ভয়ের। কারণ আমি কোন একভাবে জেনেছিলাম কিয়ামত হবে সূর্যাস্তের সময় এবং তখন সূর্য ডুবে গিয়ে পশ্চিম দিক থেকে আবার উঠবে। কেমন একটা আতংক হত। তার ওপর আমার বারান্দা ছিল পশ্চিমমুখী। আমি দেখতে পেতাম পশ্চিমের আকাশ আবার যেন আলো হয়ে উঠছে। এখন ভাবলে হাসি পায়। বাসায় থাকলে বিকাল থেকে সন্ধ্যা হবার সময়টা আমার মোটেও পছন্দ না। কোন কাজ করতে ভাল লাগে না আবার অলস বসে থাকতেও ভাল লাগে না। মেজাজ একটু তিরিক্ষি হয়ে পড়ে। ওই ছয়তলার বাসায় রোজার দিনে অর্ধেক ইফতারের পর আমি তাড়াহুড়া করে বারান্দায় চলে আসতাম। রাস্তা দেখার জন্য। কারণ ওই সময় সুনসান হয়ে থাকে অলিগলি, রোজা না থাকলে এমনটা পাওয়া যায় না। হঠাৎ হঠাৎ কোন একজনকে হয়ত চলতে দেখা যেত। ভর সন্ধ্যায় সোডিয়াম বাতির নিচে একাকী পথিক। আমাদের গ্রামে গোধূলির সময়কে বলা হয় “পাঁচ ওক্তের এক ওক্ত”। মজার ব্যাপার হল এই phrase শুধু এই সময়ের জন্য প্রযোজ্য, বাকি চারটা “ওক্ত”এর জন্য না। “পাঁচ ওক্তের এক ওক্ত” তে চুল বেঁধে না রাখলে আমার দাদী বিরক্ত হন। আঁচড়ে ফিটফাট করে রাখলেও চলবে না, বাঁধা হতে হবে। খোলা চুলে কত কি ঢুকে পড়তে পারে!
Wednesday, February 6, 2008
আমার কলেজজীবন
আমি বলে থাকি আমার কাছে সবচেয়ে কম পছন্দের হল কলেজ লাইফ, অবশ্য যদি স্কুল বা ভার্সিটির সঙ্গে তুলনা করতে যাই। এটা মূলত পড়াশোনার কষ্টের জন্য। অল্প সময়ের মধ্যে কঠিন অনেক কিছু আয়ত্ত্ব করার চেষ্টা করতে হয়েছিল এবং আমি তার বেশিরভাগই মাথায় রাখতে পারতাম না। তাছাড়া কলেজে যাওয়া আসাটা মোটামুটি বছর দুয়েকের মত হওয়ায় চটপট করে শেষও হয়ে গেছে। কাছের বন্ধুদের মধ্যে আমার সঙ্গে একই সেকশানে পড়েছিল মাত্র একজন। মনে আছে প্রথম যেদিন ক্লাস ভাগাভাগি করা হল আর আমি দেখলাম আমি আর বীথি একই সেকশানে, বিশাল একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। মনে হচ্ছিল এযাত্রা যেন জীবন ফিরে পেলাম। স্কুললাগোয়া কলেজ হওয়ায় ওই স্কুলের মেয়েরাই ছিল সংখ্যায় বেশি, তাছাড়া অন্যেরা একেকজন একেকখান থেকে আসা। আরও বড় কথা হল আমি বন্ধুত্ব করতে একেবারেই পটু না। কিছু কিছু মেয়েকে দেখে তখন মনে মনে বলতাম, তোমরা এখানে স্কুলে পড়েছিলে বলে এত ভাব ধরার কি আছে, আমরা বাইরে থেকে এসেছি আরো বেশি মার্কস পেয়ে, তোমাদের মত কোটা পদ্ধতিতে না। ধীরে ধীরে আমার আর বীথির বেশ কয়েকজন দারুণ বন্ধু হয়ে যায়। সবাইই অন্যান্য স্কুলের। আমরা খুব মজা করতাম। হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যেত। ক্লাসে আমাদেরকে বসতে হত ‘রোটেশান’ করে। অর্থাৎ আজকে যেই বেঞ্চে বসব পরের দিন তার পেছনের বেঞ্চে। এভাবে করে যেদিন ফার্স্ট বেঞ্চ চলে আসত সেদিন একটু টেনশান কাজ করত। টিফিন পিরিয়ড ছিল মজার। কলেজ কম্পাউন্ডে একটা ক্যান্টিন ছিল যদিও তার খাবার আমার তেমন পছন্দের ছিল না। তবে রোববারের তেহারি টাইপ জিনিসটা খেতে ভাল লাগত। ক্যান্টিনে সবচেয়ে বেশি চলত আচার আর দুই টাকার আলুর চিপস। এখানেই প্রথম ক্লাস ফাঁকি দেয়ার অভিজ্ঞতা হয় আমার। মাঠে গিয়ে বসে থাকলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা খুব কম ছিল। বৃহস্পতিবারের Assembly টাও মন্দ না। আমাদের কলেজ মোটামুটি উৎসবমুখর থাকত প্রায় সময়েই। অডিটোরিয়াম খোলা, কমনরুমে হৈ চৈ, করিডরে হাঁটাহাটি, মাঠে বসে গল্প এসব চলত সারাক্ষণই। একবার পয়লা বৈশাখের পরপর অডিটোরিয়ামে এক বাউলের গান হল। বাউলের নাম ছিল আলম সরকার। আমরা সবাই খুব লাফালাফি করে গান শুনলাম। আরো কয়েকবার কি কি যেন হল আমরা হেভি সাজগোজ করে গিয়েছিলাম। একবার যখন ম্যাগাজিন বের করার কথা, আমি দিলাম একটা কবিতা আর একটা গল্প। সেই কবিতার আসল মাজেজা ছিল শেষ দুই লাইনে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমার সাধের কবিতাকে এডিট করে আসল জায়গাটাই ছেঁটে ফেলা হল। আর করুণরসে সিক্ত গল্পটা ছিল একজন মৃত্যুপথযাত্রী প্রবাসীকে নিয়ে যে তার বন্ধুর কাছে চিঠি লিখছে। চিঠিটাই ছিল গল্পটা। এটা তো আলোর মুখ দেখল না। সবচেয়ে আনন্দের হল rag day. একই সঙ্গে কষ্টেরও। অনেক নাচগান হল, কেক কাটা হল, খাওয়াদাওয়া হল। সবাই একটা করে শার্ট পেলাম। নিয়ম হল বন্ধুরা শার্টের গায়ে কিছু একটা লিখে দিবে। এই ব্যাপারটাই আমার সবচেয়ে পছন্দ হয়েছিল। আমরা প্রবল উৎসাহে একে অন্যের শার্টে লিখলাম এটা সেটা। সেদিন দাপাদাপি করে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল। অনেক মন খারাপ লেগেছিল শেষ সময়ে। এখানে আর ক্লাস করা হবে না, একসঙ্গে গল্প করা হবে না। আমি কলেজজীবনকে সবসময় তালিকার পেছন দিকে ফেলে রাখি। কখনো ভাল করে ভেবে দেখাও হয় না। আজকে একটা ফোন পেয়ে সাঁই করে মনটা সেই সময়ে ফিরে গেল। আমি মানতে বাধ্য হলাম, এমন অল্প সময়ের মধ্যে এমন করে বন্ধু হয়ে গিয়ে এত আনন্দ করাটা কেবল কলেজেই সম্ভব হয়েছিল। অথচ সেই বন্ধুদের সাথেই আমার সরাসরি যোগাযোগ কম। আমার কলেজের ইউনিফর্ম আলমারিতে এখনো আছে। আমাদের ব্যাজটা ছিল সুঁই সুতায় তোলা। আমার ড্রয়ারে সেটাও আছে। আর শার্টটা আছে প্যাকেটে মোড়ানো। যত্নে তোলা স্মৃতি।
Monday, February 4, 2008
অতিথিরা
ইংরেজরা নাকি আলাপ শুরু করে আবহাওয়ার প্রসঙ্গ দিয়ে। আমার অবস্থাও হচ্ছে তাই। কোন কথা না পেলে ঠাণ্ডার কথা বলে কিছু একটা শুরু করি, তারপর দেখি মেগাসিরিয়ালের কাহিনী টানতে টানতে রচনা নদী থেকে গরু, গরু থেকে লাঙল, লাঙল থেকে ধানে চলে যায়। অথচ যেখানে প্রয়োজন সেখানে এমনটা ঘটে না। যেমন ধরা যাক অতিথিদের সঙ্গে। দেখা গেল খুব বেশি ঘনিষ্ঠ না এমন মেহমান এসেছে বাসায় কিন্তু বাবা মা এই মুহূর্তে বাইরে। আমার তখন বড়ই আমতা আমতা অবস্থা। বাক্যবিনিময় করতে হবে কিন্তু কুশলাদি জিজ্ঞেসের পর তেমন কোন কথা খুঁজে পাই না আমি। কারো পাঁচটা ছেলেমেয়ে থাকলে প্রত্যেকের নাম ধরে ধরে কেমন আছে তা তো আর জিজ্ঞেস করা যায় না। সৌভাগ্যক্রমে জৈষ্ঠ্যের খররৌদ্র অথবা মাঘের শৈত্যপ্রবাহ বজায় থাকলে তাঁরা নিজেরাই প্রসঙ্গ টেনে আনেন। এটা নিয়ে মোটামুটি কিছুক্ষণ কাটিয়ে দিতে পারি। তারপর আমি এখন কোন ইয়ারে, ফাইনাল কবে এটা নিয়েও কিছুটা কথাবার্তা বলা যায়। সেক্ষেত্রে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট নিয়ে প্রায়ই কিছু অম্লবাক্য হজম করা লাগে। কোন কোন অতিথি দেশিবাসী আর কেউ কেউ বাবামায়ের অফিসসূত্রে পরিচিত। মায়াকাড়া ছোটবাচ্চা নিয়ে আসেন কেউ। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় এক দুপুরে একজন অমায়িক ধরণের আর্মির লোক এসেছিলেন আমার ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গে। বাসায় তখন মানুষ বলতে একমাত্র আমি। তাকে কোন দিন না দেখলেও তার সঙ্গে কথা বলতে বেশ ভাল লেগেছিল। এছাড়াও অনেক সময়ই হঠাৎ চলে আসা দূরসম্পর্কীয় অতিথিদের বেশ ভাল লেগে যায়। আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি শুনলে কারো চোখ কপালে উঠে যায় কারণ আমার সঙ্গে তার দেখা হবার পর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। সময় যে খুব দ্রুত চলে যায় একথা তার আবার নতুন করে মনে পড়ে যায়। তখন আমার একটু খারাপই লাগে। আসলেই তো সময় কেমন চোখের পলকে হারিয়ে যায়।
এমন কেউ কেউ আছেন যারা দুইটা কথা একটু একটু পরপর মনে করিয়ে দেন; একটা হল ছেলেমেয়ের পড়াশোনার চাপে তার নাওয়া খাওয়া বন্ধ, দম আটকে যাচ্ছে আর আরেকটা কথা হল আমার মা বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন কারণ তার মেয়ে ভার্সিটিতে পড়ে, তাই তাকে কোন যন্ত্রণা পোহাতে হয় না। সেসময় আমার আফসোসই হয় কেন যে তাদের ছেলেমেয়েরা আমার মত কাউকে কোনরকম কষ্ট না দিয়ে জন্মের পরপরই এক লাফে অনার্সে ভর্তি হয়ে গেল না। সবচেয়ে মারাত্মক হল তিন চার বছরের ত্যাঁদড় টাইপ বাচ্চাকাচ্চা। এরা এটা সেটা ফেলে ছড়িয়ে তুলকালাম করে। আমি যেহেতু ‘বড়’ তাই ধরে আছাড় দেয়া যায় না, বরং “না না কি হয়েছে, ছোটমানুষ খেলুক” এরকম একটা মুখ করে রাখতে হয়। ভাঙার জন্য তাদের হাতে সবসময় আমার দরকারি জিনিসটাই পড়ে নাকি তারা ভেঙে ফেলার পর সেই জিনিসটা আমার খুব দরকার হয়ে পড়ে তা বলতে পারব না। এই রকমের শিশুপ্রতিভা আমাদের বাসায় কালেভদ্রে আসে এটাই যা সুখের কথা। সামনে কোন পরীক্ষা না থাকলে অবশ্য সন্ধ্যার দিকে ইন্টারেস্টিং কোন মেহমান আসাটা ভাল। তাহলে এই সেই করতে করতে পড়ার সময়টা কাটিয়ে দেয়া যায়। আমাদের এই সামাজিক আচারটা মন্দ না, হাতে করে এটা সেটা নিয়ে যাওয়া। অনেকে মিষ্টি নিয়ে আসেন, খাওয়ার মানুষ পাওয়া যায় না। তবে সমঝদার কেউ বুদ্ধি খাটিয়ে আইসক্রিম নিয়ে আসলে তার বুদ্ধির মর্যাদা আমি দিয়ে থাকি। এখানে আমার একটা দুঃখ আছে, আগের মত এখন আর কেউ আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসে না। আর আরেকটা দুঃখের কথা হল যারা হাতে কিছু নিয়ে বেড়াতে আসেন আমাদের বাসায় তারা আমার এই লেখাটা পড়বেন না।
কত কিছুই বললাম। আমি নিজেও তো মাঝে মাঝে অতিথি হয়ে যাই। আমি কেমন কে জানে। কোথাও যাওয়াটা আমার কাছে ঝক্কি মনে হলেও নিজের বাসায় কেউ আসলে ভালই লাগে। অনেকদিন হল দুই একদিন থেকে যাবার মত করে কেউ আসে না। রাতে খাবার টেবিলে পারিবারিক বা গ্রামের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা শোনাটা বেশ মজার। আমি বুড়ো হতে হতে হয়ত কেউ আর কারো বাড়ি বেড়াতেও যাবে না। যোগাযোগ যত সহজ হয় চলাফেরা বোধহয় ততই কঠিন হয়ে পড়ে।
এমন কেউ কেউ আছেন যারা দুইটা কথা একটু একটু পরপর মনে করিয়ে দেন; একটা হল ছেলেমেয়ের পড়াশোনার চাপে তার নাওয়া খাওয়া বন্ধ, দম আটকে যাচ্ছে আর আরেকটা কথা হল আমার মা বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন কারণ তার মেয়ে ভার্সিটিতে পড়ে, তাই তাকে কোন যন্ত্রণা পোহাতে হয় না। সেসময় আমার আফসোসই হয় কেন যে তাদের ছেলেমেয়েরা আমার মত কাউকে কোনরকম কষ্ট না দিয়ে জন্মের পরপরই এক লাফে অনার্সে ভর্তি হয়ে গেল না। সবচেয়ে মারাত্মক হল তিন চার বছরের ত্যাঁদড় টাইপ বাচ্চাকাচ্চা। এরা এটা সেটা ফেলে ছড়িয়ে তুলকালাম করে। আমি যেহেতু ‘বড়’ তাই ধরে আছাড় দেয়া যায় না, বরং “না না কি হয়েছে, ছোটমানুষ খেলুক” এরকম একটা মুখ করে রাখতে হয়। ভাঙার জন্য তাদের হাতে সবসময় আমার দরকারি জিনিসটাই পড়ে নাকি তারা ভেঙে ফেলার পর সেই জিনিসটা আমার খুব দরকার হয়ে পড়ে তা বলতে পারব না। এই রকমের শিশুপ্রতিভা আমাদের বাসায় কালেভদ্রে আসে এটাই যা সুখের কথা। সামনে কোন পরীক্ষা না থাকলে অবশ্য সন্ধ্যার দিকে ইন্টারেস্টিং কোন মেহমান আসাটা ভাল। তাহলে এই সেই করতে করতে পড়ার সময়টা কাটিয়ে দেয়া যায়। আমাদের এই সামাজিক আচারটা মন্দ না, হাতে করে এটা সেটা নিয়ে যাওয়া। অনেকে মিষ্টি নিয়ে আসেন, খাওয়ার মানুষ পাওয়া যায় না। তবে সমঝদার কেউ বুদ্ধি খাটিয়ে আইসক্রিম নিয়ে আসলে তার বুদ্ধির মর্যাদা আমি দিয়ে থাকি। এখানে আমার একটা দুঃখ আছে, আগের মত এখন আর কেউ আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসে না। আর আরেকটা দুঃখের কথা হল যারা হাতে কিছু নিয়ে বেড়াতে আসেন আমাদের বাসায় তারা আমার এই লেখাটা পড়বেন না।
কত কিছুই বললাম। আমি নিজেও তো মাঝে মাঝে অতিথি হয়ে যাই। আমি কেমন কে জানে। কোথাও যাওয়াটা আমার কাছে ঝক্কি মনে হলেও নিজের বাসায় কেউ আসলে ভালই লাগে। অনেকদিন হল দুই একদিন থেকে যাবার মত করে কেউ আসে না। রাতে খাবার টেবিলে পারিবারিক বা গ্রামের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা শোনাটা বেশ মজার। আমি বুড়ো হতে হতে হয়ত কেউ আর কারো বাড়ি বেড়াতেও যাবে না। যোগাযোগ যত সহজ হয় চলাফেরা বোধহয় ততই কঠিন হয়ে পড়ে।
Subscribe to:
Posts (Atom)