ছেলেটার পাশের বাড়িতে থাকত মেয়েটা। অনেকদিনের প্রতিবেশী। ছোট থেকে তারা বড় হয়েছে এখানেই। ছেলেটার চোখে তখন নানা রঙের স্বপ্ন, জীবন জীবিকা প্রেম ভবিষ্যত এবং হয়ত আরো অনেক কিছু নিয়ে। বহুদিনের পরিচিত কমবয়সী মেয়েটার বাড়াবাড়ি আগ্রহ, অহেতুক কাছ ঘেঁষা তাই তেমন করে লক্ষ্যই করেনি সে। বা করলেও গুরুত্ব দেয়নি। একদিন হঠাত করে একটা চিরকুট হাতের মধ্যে গোঁজা পেয়ে তাই খানিকটা অবাক এবং খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়ল ছেলেটা। সরু করে অল্প যে কয়টা লাইন লেখা ছিল সেগুলোতে একটু অনুরোধ ছিল মেয়েটার বড় হবার জন্য অপেক্ষা করার, অনেকটা অনুনয় ছিল তার সমস্ত জমানো ভালবাসা অকুণ্ঠচিত্তে গ্রহণ করার। ছেলেটা আঁকাবাঁকা লেখাগুলোতে কয়েকবার নজর বুলালো। খানিক ভাবল। তারপর হেঁটে গেল পাশের বাড়ির দরজায় মেয়েটাকে কিছু বলার জন্য। সেই পুরানো জবাব, মেয়ে আমি তো অপেক্ষা করে থাকতে পারব না তোমার জন্য, আমার সামনে অবারিত সম্ভাবনা, তুমি ছোট হতে পার কিন্তু আমি তো বড় হয়েছি, জীবনকে আমি বুঝতে পারি। ভেবো না, আর একটুও দুঃখ কোরো না, তুমি অনেক ভাল থাকবে, দারুণ একটা জীবন হবে তোমার, দেখো তোমার এই ক্ষণিকের মোহ কেটে যাবে কিছুদিনেই কারণ একদিন মানুষ আগের ভাললাগাগুলো ভুলে যায়। এরপর সেই পুরানো প্রতিক্রিয়া, মেয়েটার অঝোর ধারায় কান্নাকাটি, প্রত্যাখ্যাত মনের ভার; কিছু না করতে পেরে ছেলেটারও একটু অপরাধবোধ।
কিছুদিন গড়ালে পরিচিত শহর ছাড়ে ছেলেটা। কাজের সন্ধানে জীবিকার তাগিদে স্বপ্নকে বাস্তব করার তাড়নায় অচেনাদের ভীড়ে দূরের নগরে জীবন শুরু করে। এভাবে অনেক দিন কেটে যায়। কিন্তু এখানেও সেই পুরানো গল্প। থেকে থেকে তার মনে পড়ে ফেলে আসা বাড়ি, মা বাবা, বন্ধুরা, আর সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে চিরকুট আর মেয়েটাকে। তার অনুভব হতে থাকে পেছনে ছেড়ে আসা শহর আর মানুষের কাছে তার প্রাণ বাঁধা পড়ে আছে। হঠাৎ করেই সে বুঝে ফেলে তাকে আসলে সেই মেয়েটার কাছে ফিরে যেতে হবে। বাড়ির পথ ধরে ছেলেটা। খুঁজে পাওয়ার আনন্দ আবার সেই সাথে হারিয়ে ফেলার আশংকা বুকে নিয়ে এবার দৌঁড়ে যায় পাশের বাড়ির দরজায়, যদি সব আগের মত ঠিক না থাকে? শেষ পর্যন্ত তাই হল। এবার মেয়েটার কাছ থেকে তাকে জানতে হল, একদিন সবাই সব কিছু ভুলে যেতে পারে, তাই ছেলেটারওসব ভাবনা একদিন বদলে যাবে, মেয়েটাকে না পাওয়া নিয়ে আর কোন দুঃখবোধ থাকবে না।
কিছুদিন ধরে একটা অদ্ভুত ইচ্ছা হচ্ছে। যদি একটা কিছু ঘটত খুব নাটকীয়! যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি সাদা না কালো মত দিতে পারি না, আমাকে ধূসর রঙ বেছে নিয়ে বসে থাকতে হয়, এবং অন্য কাউকে আমার হয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হয়, তাই বের করে নিতে পারছি না ঠিক কি ঘটার জন্য এত লোভ হচ্ছে। তারপরও ভাবছি আমি নিজে বা কেউ কিছু একটা করে বসত, যেটাতে আমার অনেক গুছানো হিসাব নিকাশ বদলে যাবে। আর সেই বদলটা অবশ্যই হবে একেবারেই ধনাত্মক। মাঝে মাঝে যখন মনে হয় হাতের খুব কাছের কোন কিছুকে আমি এড়িয়ে যাচ্ছি কেবল চোখ খুলে তাকাচ্ছি না বলে, তখন আর কেউ কিছু করে দিক এমন ইচ্ছাটা করে। যেভাবে করে সবকিছু হচ্ছে তাকে দুম করে পালটে একটা অন্য কিছু করে দিতে পারলে কেমন হত? এমন কিছু যেটা কখনো ধারণা করি নি। জানি না জীবনে ঘোলা দৃষ্টির ভুলে বা বোকা চিন্তার শিকার হয়ে কখনো মূল্যবান কিছু হারিয়ে গেছে কিনা। যদি হারিয়েই থাকে তবে পরে কখনো সেটা টের না পেলেই ভাল।
গল্পটা কনওয়ে টুইটির ‘ডোন্ট ক্রাই জোনি’ গানের। ভাল লাগা গানটা অনেকেরই শোনা। লিংক দিতে গিয়ে আমি ভুল করে ফেলি বলে আর দেয়া হল না।
Monday, December 28, 2009
Sunday, December 20, 2009
দৃষ্টিসঙ্গী
ক্লাস সেভেনে থাকতে ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলার সময় আমি প্রথম টের পাই যে আমি টিভির ডান কোণায় থাকা স্কোর ঠিকমত পড়তে পারছি না, খাটুনি হচ্ছে। কিছুদিন পর ডাক্তার দেখাতে হল। এবং প্রথমবারের মত আমার নাকের গোড়ায় চশমা এঁটে গেল। আমি বুঝতে পারলাম এতদিন যেটুকুকে সবকিছু ঠিকঠাক দেখতে পারা মনে করতাম আসলে তার থেকে বেশি দেখে স্বাভাবিক চোখের মানুষেরা। সেই থেকে চশমা আমার সঙ্গী। প্রথমে ছিল কার্বন ফ্রেমের হালকা খয়েরি একটা চশমা। পরে সেটা হল আরেকটু গাঢ় খয়েরি। বছর ঘুরতেই সোনালি, কারণ তখন চশমার জন্য সোনালিই স্মার্ট ফ্রেম ছিল। সেই সাথে নিয়মিত চেকআপ আর সাথে গুটি গুটি করে কাঁচের শক্তিবৃদ্ধি হওয়া তো ছিলই। ততদিনে আমি অনেক চালাক। শিখে গেছি দূরের জিনিস কম দেখলে মাইনাস হয় আর কাছের জিনিস কম দেখলে হয় প্লাস। প্লাস চশমা থাকে আব্বুদের যারা খালি চোখে থাকলে খবরের কাগজ ভালভাবে পড়তে পারার জন্য মুখের কাছাকাছি না এনে বরং চোখ কুঁচকে দূরে মেলে ধরেন। একবার ডাক্তারের কথা শুনে অবাক হয়েছিলাম। আমি তখন ক্লাস এইটে। ডাক্তার আব্বুকে বললেন, ‘মেয়ের চোখের পাওয়ার তো দিনে দিনে বাড়বে, আপনার একটা কথা জানা থাকা ভাল। সেটা হচ্ছে মেয়ের যখন বিয়ে দিবেন দেখবেন ছেলে যেন মাইনাস পাওয়ারের না হয়। প্লাস হলেও সমস্যা হবে না। কারণ দুইজনই যদি মাইনাস হয় তাহলে বাচ্চারা হবে ডাবল মাইনাস।’ আমি তো শুনে বিশাল বিব্রত। আরে ডাক্তার আমার সামনে এসব কি সব বিয়ের কথা বলে? আমি ছোট না? সেই থেকে কথাটা মনের মধ্যে গেঁথে গেল। তখন আবার প্যাকেজ নাটকের স্বর্ণযুগ। বড় হলে যে একটু আধটু প্রেমপ্রীতি হয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক তা খুব বুঝতাম। ভার্সিটিতে পড়ার সময় যদি কোন মাইনাসওয়ালা ছেলেকে মনে ধরে যায় তাহলে যে মুশকিল হবে সেটা ভেবে একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। ক্লাস টেনে উঠে পদার্থবিদ্যার বইয়ের কল্যাণে জানতে পারলাম আমার প্রবলেমটার নাম হচ্ছে মাইওপিয়া এবং কেউ যদি জিজ্ঞেস করত চশমার পাওয়ার কত তাহলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতাম মাইনাস এত ‘ডাইওপ্টার’।
যাই হোক, সোনালি চশমা চালু থাকা অবস্থাতেই ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে মেন্ডেল এসে আমার রোমান্টিক মনে আরেকটা খোঁচা দিল। তার দ্বিতীয় সূত্র থেকে বের করে ফেললাম আমার চার ছেলেমেয়ের মধ্যে একজনের চোখের সমস্যা থাকবে না। তবু খুশি হবার উপায় ছিল না। কারণ তখনও চশমা পরা ছেলেদেরকেই একটু মুডি লাগলেও আর বেশি পছন্দ হলেও চার চারটা ছেলেমেয়ে বড় করার ঝামেলার কাছে তা ম্লান না হয়ে পারত না। ভার্সিটিতে উঠে চশমাটা বিচ্ছিরি হয়ে গেল, কালো রঙের আজব একটা ফ্রেম। আবার তাড়াতাড়ি সেটা বদলে একটা মোটা কালো হাফরিম। কাঁচ মোটা হওয়ায় রিমলেস পরার শখ কখনোই মিটল না, এখনকার কালো হাফরিমটাই তাই ভরসা। পাশাপাশি আমি বেশ উদারও হয়ে গেছি দিনে দিনে। ডাক্তারের পরামর্শটা অন্যদের শোনালেও চশমা পরলে কাউকে ভাল লাগাটা বাতিল করার কথা মাথায় আসে না আর।
এই চশমার অনুগ্রহে ধীরে ধীরে হুমায়ূন আহমেদের শুভ্রর জ্বালা কিছুটা বুঝতে শেখা হয়েছে। কখনও ইচ্ছা হত একদিন সকালে উঠে যেন দেখি সব ঠিক। কতবার ভেবেছি আমাকে যদি কেউ মরণোত্তর চক্ষুদান করে যেত। মনে মনে চেয়েছি কেউ যদি অনেক টাকা দিয়ে আমাকে ল্যাসিক করিয়ে দিত যেখানে কোন রিস্কই থাকবে না। কেউ যে এমনি এমনিই সব কিছু দেখতে পায় এটা এখন আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। যখন দেখতাম কেউ শখ করে চশমা পরে তখন খুব রাগ হত। ক্লাসের কেউ নতুন চশমা নিলে একধরণের ভাল লাগত, আমি একাই কেন কষ্ট করব, অন্যরাও করুক। কিন্তু অন্যদেরগুলো হত মাথাব্যথার চশমা যেগুলো মাস কয়েকের মধ্যে উধাও হয়, আমার মত গেড়ে বসে না।
আমার চশমাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য কয়েক বছর ধরে ঘরে আছে কন্ট্যাক্ট লেন্স। প্রথম যেদিন চোখে দিই আমি তো অবাক। কত বছর পর আমি চশমা ছাড়াই সত্যি সত্যি সব দেখতে পাচ্ছি! ইচ্ছামত কাজল লাগাতে পারছি। সানগ্লাসও পরতে পারছি। শুধু মন ভরে ঘুমাতে পারছিনা এটা নিয়ে। আর লেন্স পোষাটা চার ছেলেমেয়ে না হোক, জমজ ছেলেমেয়ে লালনপালন করার মত ঝামেলার হয়ে যায় মাঝে মাঝে। তাই চশমাই বেশি প্রিয়।
চোখে এতখানি ঘাটতি থাকার দুঃখটা আমার মত ভুক্তভোগীরা ছাড়া আর কেউ একটুও বুঝতে পারবে না। তারপরও আগের মত খারাপ লাগে না এখন। জানি না সেটা অভ্যাসের জন্য নাকি এমনিতেই। চোখের কমতি পুরোটাই পুষিয়ে নেয়া যাচ্ছে। আজকে যদি পা না থাকত কিংবা হাত, এত সহজে পারতাম একটা সঙ্গী পেতে যে এত বেশি সাহায্য করতে পারে? আর আয়নাতে দেখতেও মন্দ লাগে না। আমার পাওয়া সেরা কমপ্লিমেন্ট আমার নার্সারি পড়ুয়া চাচাতো বোনের যে বক্তব্য দেয়ার আগে কিছুক্ষণ ভেবে নেয়; “রিমি আপু, তোমাকে তো চশমা পরলে বেশ সুন্দর লাগে। আমি তো আগে লক্ষ্য করি নাই।”
উড়ে এসে জুড়ে বসা যন্ত্রণাটাকে ছাড়া এখন কেমন কেমন খালি খালি লাগে।
যাই হোক, সোনালি চশমা চালু থাকা অবস্থাতেই ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে মেন্ডেল এসে আমার রোমান্টিক মনে আরেকটা খোঁচা দিল। তার দ্বিতীয় সূত্র থেকে বের করে ফেললাম আমার চার ছেলেমেয়ের মধ্যে একজনের চোখের সমস্যা থাকবে না। তবু খুশি হবার উপায় ছিল না। কারণ তখনও চশমা পরা ছেলেদেরকেই একটু মুডি লাগলেও আর বেশি পছন্দ হলেও চার চারটা ছেলেমেয়ে বড় করার ঝামেলার কাছে তা ম্লান না হয়ে পারত না। ভার্সিটিতে উঠে চশমাটা বিচ্ছিরি হয়ে গেল, কালো রঙের আজব একটা ফ্রেম। আবার তাড়াতাড়ি সেটা বদলে একটা মোটা কালো হাফরিম। কাঁচ মোটা হওয়ায় রিমলেস পরার শখ কখনোই মিটল না, এখনকার কালো হাফরিমটাই তাই ভরসা। পাশাপাশি আমি বেশ উদারও হয়ে গেছি দিনে দিনে। ডাক্তারের পরামর্শটা অন্যদের শোনালেও চশমা পরলে কাউকে ভাল লাগাটা বাতিল করার কথা মাথায় আসে না আর।
এই চশমার অনুগ্রহে ধীরে ধীরে হুমায়ূন আহমেদের শুভ্রর জ্বালা কিছুটা বুঝতে শেখা হয়েছে। কখনও ইচ্ছা হত একদিন সকালে উঠে যেন দেখি সব ঠিক। কতবার ভেবেছি আমাকে যদি কেউ মরণোত্তর চক্ষুদান করে যেত। মনে মনে চেয়েছি কেউ যদি অনেক টাকা দিয়ে আমাকে ল্যাসিক করিয়ে দিত যেখানে কোন রিস্কই থাকবে না। কেউ যে এমনি এমনিই সব কিছু দেখতে পায় এটা এখন আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। যখন দেখতাম কেউ শখ করে চশমা পরে তখন খুব রাগ হত। ক্লাসের কেউ নতুন চশমা নিলে একধরণের ভাল লাগত, আমি একাই কেন কষ্ট করব, অন্যরাও করুক। কিন্তু অন্যদেরগুলো হত মাথাব্যথার চশমা যেগুলো মাস কয়েকের মধ্যে উধাও হয়, আমার মত গেড়ে বসে না।
আমার চশমাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য কয়েক বছর ধরে ঘরে আছে কন্ট্যাক্ট লেন্স। প্রথম যেদিন চোখে দিই আমি তো অবাক। কত বছর পর আমি চশমা ছাড়াই সত্যি সত্যি সব দেখতে পাচ্ছি! ইচ্ছামত কাজল লাগাতে পারছি। সানগ্লাসও পরতে পারছি। শুধু মন ভরে ঘুমাতে পারছিনা এটা নিয়ে। আর লেন্স পোষাটা চার ছেলেমেয়ে না হোক, জমজ ছেলেমেয়ে লালনপালন করার মত ঝামেলার হয়ে যায় মাঝে মাঝে। তাই চশমাই বেশি প্রিয়।
চোখে এতখানি ঘাটতি থাকার দুঃখটা আমার মত ভুক্তভোগীরা ছাড়া আর কেউ একটুও বুঝতে পারবে না। তারপরও আগের মত খারাপ লাগে না এখন। জানি না সেটা অভ্যাসের জন্য নাকি এমনিতেই। চোখের কমতি পুরোটাই পুষিয়ে নেয়া যাচ্ছে। আজকে যদি পা না থাকত কিংবা হাত, এত সহজে পারতাম একটা সঙ্গী পেতে যে এত বেশি সাহায্য করতে পারে? আর আয়নাতে দেখতেও মন্দ লাগে না। আমার পাওয়া সেরা কমপ্লিমেন্ট আমার নার্সারি পড়ুয়া চাচাতো বোনের যে বক্তব্য দেয়ার আগে কিছুক্ষণ ভেবে নেয়; “রিমি আপু, তোমাকে তো চশমা পরলে বেশ সুন্দর লাগে। আমি তো আগে লক্ষ্য করি নাই।”
উড়ে এসে জুড়ে বসা যন্ত্রণাটাকে ছাড়া এখন কেমন কেমন খালি খালি লাগে।
Subscribe to:
Posts (Atom)