শুনতে কি চাও তুমি সেই অদ্ভূত বেসুরো সুর? ফিরে পেতে চাও কি সেই আনচান করা দুপুর?
দেখতে কি চাও তুমি সেই খেলনাওয়ালাটাকে? তার খেলনার দোতারা সে বাজাচ্ছে কবে থেকে।
স্কুলের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কেনা, সেই অদ্ভূত ফাটা বাঁশ আর মাটির সুর টানা টানা।
দু’দিনের সম্পদ দু’টাকার বাজনার বিস্ময়।
তারপর কখন হঠাৎ সুখের মানে পালটে যায়।
তারপর টিফিনের পয়সা দিয়ে সিগারেট, কলেজগেটে সিনেমা, বান্ধবীর সাথে কাটলেট।
আসে দশটা পাঁচটা সেই এক রুটের বাসটা তারপর।
সবার মতই পরতে হয় যে কাগজের টোপর।
এখন মাসের শেষে মাঝে মধ্যে কান্না পায়, মিনিবাসে দাঁড়িয়ে অফিস যাবার সময়।
এখন বুঝেছি সে অদ্ভূত সুরের কি মানে,
ফিরে তো যাওয়া যায় না যে আর সেখানে।
যেতে হবে যে তোমাকে আমাকে চলে। লুকোনো টেক্কা সংসারের এক্কা দোক্কা ফেলে।
প্রথমে যাবে ঘরদোর দোকানপাট তারপর হৃদয়
কিছুই হল না, বাজানো গেল না সময়।
ইদানিং সে সুরটা শুনতে যে খুব ইচ্ছে হয়,
কিন্তু সে খেলনাওয়ালা আর আসে না পাড়ায়।
হয়ত কোন অন্য অলিগলি ঘুরে, অন্য কোন কাউকে সে টানছে সে অদ্ভূত সুরে।
-অঞ্জনের একটা গান।
শীতের বিকালে একা ঘরে বসে থাকা একটুও সুখের না। মাঝগগন থেকে সূর্য আস্তে আস্তে পাটের পথে নামতে থাকবে আর তোমার মাথার মধ্যে মনের মধ্যে যেন একসাথে অনেকগুলো দরজা জানালার কপাট খুলবে আর বন্ধ হবে, বন্ধ হবে আর খুলবে। তারপর ইতোমধ্যে বেঁচে ফেলা তোমার সবগুলো দিন সেই কপাটগুলোর ওপাশে রাশি রাশি মুখ হয়ে উঁকি দিবে। আবার পালাবে। পুরানো সব সুর তোমার কানে বাজতে থাকবে। মন আনচান করা দুপুরগুলোকে একটা একটা করে ঢেলে দিতে ইচ্ছা করবে ক্যালেন্ডারের অনাগত পাতায়। তুমি যদি একটু বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াও তো চাক্ষুষ দেখবে পথে পড়া হলদে রোদটা কেমন ফিকে হয়ে ঘিয়া রং বাধিয়ে বসছে আস্তে আস্তে। অস্থির ভাবটা লুকিয়ে আদুরে লক্ষ্মীপানা মুখ করে তুমি বলতে চাইবে, দুপুর শেষ তো মা সবাই নেমে গেছে, এবার খেলতে যাই না! ঠিক তখুনি আবার বুঝে ফেলবে কিসের খেলা কিসের কি। আবার হয়ত শালে জড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে ক্যাম্পাসের ফুটপাথে বসতে চাইবে, ধোঁয়া উঠা চায়ে চুমুক দেয়ার জন্য। আশপাশ তাকালেই দেখবে উঁহু সে হবার নয়। আরো যখন বেলা পড়বে, আলো কমতে থাকবে আরো, তখন একটা অদ্ভূত মিষ্টি গন্ধ পাবে। তুমি ঠিক নাম বলতে পারবে না কিসের গন্ধ এটা, ধোঁয়া ধোঁয়া একটা ঘ্রাণ। তোমার ভাল লাগবে। যখন টের পাবে ভাল লাগলেও ভাললাগাগুলোকে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারছ না, তখন আবার খারাপও লাগবে। তারপর পাখপাখালির কিচমিচ শুরু হবে অনেক, কারণ ঘরে ফিরছে তারা। তোমার ভাবতে ভাল লাগবে এই শীতের পড়ন্ত বেলায় কুয়াশা মাথায় করে ফিরতে পেলে বেশ হত। কিন্তু কোথা থেকে কোথায় ফিরবে ঠাহর করতে পারবে না। সন্ধ্যা নেমে যাবে। তুমি ঘরে আসতে চাইবে, আবার বেরিয়ে যেতে চাইবে, কিছু একটা করতে চাইবে আবার কিচ্ছুটা করতে ইচ্ছা হবে না। অনেক কিছুকে তুমি ধরতে ছুঁতে পেতে বুঝতে বা দেখতে চাইবে, যার রহস্য কেবল তুমিই জানো। কিন্তু সেই সবগুলো কিছুই মুঠিতে ধরা পানির মত আঙ্গুলের ফাঁক গলে হারিয়ে যাবে। তোমার একটু দুঃখ দুঃখ লাগবে। শীতের অলস বিকাল বড়ই লক্ষ্মীছাড়া, কিন্তু তুমি অস্বীকারও করবে না যে চাপা একটা কষ্ট দেয় বলেই তুমি তাকে ভালবাস।
Tuesday, November 24, 2009
Saturday, November 21, 2009
ইচ্ছেগুলো বদলায় না
চাঁদটা বদলে যায় না। গায়ে চিড়িক বিড়িক কালচে দাগ নিয়ে সবাইকে নিশির ডাকের মত করে টেনেই যায়। কখনো বিরাট গোল থালা হয়ে পড়ে। আবার কখনো আধখানি মুখ ঢাকে ছাইরঙা ওড়নায়।
আকাশও ঘুরে ফিরে নীলেরই নানান রূপ ধরে রাখে। সাদা মেঘগুলো দেখলে মনে হয় তুলাগাছের লক্ষ লক্ষ শুকনো ফল ফেটে ছড়িয়ে গেছে আদিগন্ত। আর কালো মেঘগুলো যেন পিচকিরি দিয়ে ছিটানো রংতুলি ধোয়া জল।
হলদে সূর্যটার তো কোনকালেই কিছু হয় না। গনগনে চুল্লির মত আঁচ ছাড়তেই থাকে ছাড়তেই থাকে। মাঝে মাঝে দুঃখ পেলে চোখ বুঁজে ফেলে, তাও একটুক্ষণের জন্য।
বৃষ্টি পাল্টায় না। ঝিরঝির নাহয় ঝমঝম নাহয় টুপটাপ। মন চাইলে যাবার কালে রংধনুটাকে এনে সেঁটে দেয়। সেই চেনা সাতটা রংই সারি দিয়ে বসে।
মানুষই নাকি কেবল বদলায়। ক্ষণেই ক্ষণেই নাকি বদলায়। এতই যদি বদলায় তাহলে দিনে দিনে ইচ্ছেগুলো কেন বদলে যায় না? বেঁচেই থাকে কেবল।
অনেক বছর আগের যেমনটা হত, বিকেল হলেই ছুটে যেতে ইচ্ছে হয় খেলার মাঠে। পাগলা ঝড়ে শিল কুড়াতে ইচ্ছে হয় তেমনই।
লাল রঙের জামা আর লাল মালা পরে পরী হয়ে ঘুরতে ইচ্ছে হয় ছোটবেলার মত। প্রিয় কোন কিছু কাউকে একটুও ধরতে দিতে ভাল লাগে না। ইচ্ছে করে সবাই অনেক কিছু উপহার দিক যেভাবে দিত।
তখনকার মত এখনও ইচ্ছে হয় একটা টাকার গাছ থাকুক। যখন যে চায় যেন অনেক অনেক দিতে পারি। আমার বা কারোরই কোন অভাব থাকবে না এমন ইচ্ছে হয়।
একটু অসুখ করলেই গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে ইচ্ছে হয়, ইচ্ছে হয় মা রাতভর বসে পাখা করুক আর কান্না শুনুক। দাঁত চেপে শুয়ে থাকতে ভালই লাগে না।
আগুপিছু না ভেবে দুম করে অনেক কিছু বলে ফেলতে পারার ইচ্ছে হয়। লোকলজ্জা বা দ্বিধাকে ছুঁড়ে ফেলতে এখনও ইচ্ছে হয়। চাইতেই কেউ চোখের পলকে ফুল পাখি তারা এনে দিক সত্যিই এমনও ইচ্ছে হয়।
অনুচিত জেনেও বার বার কিছু ভুল কিছু অন্যায় করতে প্রচণ্ড ইচ্ছে হয়। কষ্ট দেয়ার বা কষ্ট পাওয়ার লোভটাও মরে যায় না। ইচ্ছে হয় ইচ্ছে হয়।
ইচ্ছেগুলো একটুও উলটে পালটে যায় না। চাঁদ আকাশ সূর্য কিংবা বৃষ্টির মত ধ্রুব হয়ে জড়িয়েই থাকে।
আকাশও ঘুরে ফিরে নীলেরই নানান রূপ ধরে রাখে। সাদা মেঘগুলো দেখলে মনে হয় তুলাগাছের লক্ষ লক্ষ শুকনো ফল ফেটে ছড়িয়ে গেছে আদিগন্ত। আর কালো মেঘগুলো যেন পিচকিরি দিয়ে ছিটানো রংতুলি ধোয়া জল।
হলদে সূর্যটার তো কোনকালেই কিছু হয় না। গনগনে চুল্লির মত আঁচ ছাড়তেই থাকে ছাড়তেই থাকে। মাঝে মাঝে দুঃখ পেলে চোখ বুঁজে ফেলে, তাও একটুক্ষণের জন্য।
বৃষ্টি পাল্টায় না। ঝিরঝির নাহয় ঝমঝম নাহয় টুপটাপ। মন চাইলে যাবার কালে রংধনুটাকে এনে সেঁটে দেয়। সেই চেনা সাতটা রংই সারি দিয়ে বসে।
মানুষই নাকি কেবল বদলায়। ক্ষণেই ক্ষণেই নাকি বদলায়। এতই যদি বদলায় তাহলে দিনে দিনে ইচ্ছেগুলো কেন বদলে যায় না? বেঁচেই থাকে কেবল।
অনেক বছর আগের যেমনটা হত, বিকেল হলেই ছুটে যেতে ইচ্ছে হয় খেলার মাঠে। পাগলা ঝড়ে শিল কুড়াতে ইচ্ছে হয় তেমনই।
লাল রঙের জামা আর লাল মালা পরে পরী হয়ে ঘুরতে ইচ্ছে হয় ছোটবেলার মত। প্রিয় কোন কিছু কাউকে একটুও ধরতে দিতে ভাল লাগে না। ইচ্ছে করে সবাই অনেক কিছু উপহার দিক যেভাবে দিত।
তখনকার মত এখনও ইচ্ছে হয় একটা টাকার গাছ থাকুক। যখন যে চায় যেন অনেক অনেক দিতে পারি। আমার বা কারোরই কোন অভাব থাকবে না এমন ইচ্ছে হয়।
একটু অসুখ করলেই গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে ইচ্ছে হয়, ইচ্ছে হয় মা রাতভর বসে পাখা করুক আর কান্না শুনুক। দাঁত চেপে শুয়ে থাকতে ভালই লাগে না।
আগুপিছু না ভেবে দুম করে অনেক কিছু বলে ফেলতে পারার ইচ্ছে হয়। লোকলজ্জা বা দ্বিধাকে ছুঁড়ে ফেলতে এখনও ইচ্ছে হয়। চাইতেই কেউ চোখের পলকে ফুল পাখি তারা এনে দিক সত্যিই এমনও ইচ্ছে হয়।
অনুচিত জেনেও বার বার কিছু ভুল কিছু অন্যায় করতে প্রচণ্ড ইচ্ছে হয়। কষ্ট দেয়ার বা কষ্ট পাওয়ার লোভটাও মরে যায় না। ইচ্ছে হয় ইচ্ছে হয়।
ইচ্ছেগুলো একটুও উলটে পালটে যায় না। চাঁদ আকাশ সূর্য কিংবা বৃষ্টির মত ধ্রুব হয়ে জড়িয়েই থাকে।
Thursday, November 12, 2009
বে-কা-র!
আগে নাটকে দেখতাম চাকরি না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত বেকার যুবক তার সার্টিফিকেটকে নৌকা বানিয়ে রাস্তার জমে থাকা জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে নাকি জুতার সুকতলি ক্ষয় হয়ে যায় যুবকের। হাতে যাবতীয় দলিলপত্রাদি নিয়ে তারা অফিস থেকে অফিসে ধরনা দেয় আর কাঁচঘেরা দরজাগুলোর গায়ে লেখা থাকে "no vacancy". যুবক মাথা নিচু করে ফিরে যায়।
বেকার যুবকের গালে থাকে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হাই তুলতে তুলতে সে বেলা বারোটায় ঘুম থেকে উঠে। সারাজীবন ন্যায়ের পথে চলা মধ্যবিত্ত বাবা হাঁক দেন, "লাটসাহেবের আজ এত ভোরে ঘুম ভাঙলো যে?" সে সারাদিন পথে পথে ঘুরে, আড্ডাবাজি করে, রাত করে বাড়ি ফিরে ঠাণ্ডা ভাত খেয়ে সিগারেট টানতে টানতে বুকের কষ্ট বুকে চেপে আরেকটা দিনের অপেক্ষা করে।
বেকার যুবক প্রেমিকা হারানোর ঝুঁকিতে থাকে কারণ প্রেমিকার বাবা মেয়েকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগেন। বেকারকে কেউ সম্মান করে কথা বলে না। পাড়ার চাচারা অপদার্থ ভাবেন, চাকরি করা বন্ধুবান্ধবরা ধারের ভয়ে এড়িয়ে চলে, বড় ভাই বড় ভাবী থাকলে তারা নানারকম কথা শোনায়।
ইত্যাদি হল স্কুল আমলে বইপুস্তক আর নাটকের কল্যাণে গড়ে উঠা বেকার যুবকের ভাবমূর্তি। বেকারত্বের গ্লানি বলে একটা কথাও আছে। বেকার তকমাটা ছেলেদের গায়ে সেঁটে দেয়া হয়েছে। একটা মেয়ে একই সমান পড়াশোনা করে কাজ না পেলে তাকে সচরাচর কেউ বেকার বলে না মনে হয়। একটা সুবিধা আছে দেখি মেয়ে হওয়ার। কিন্তু আদপে সুবিধা কই? কম হোক বেশি হোক নিজের টাকা পয়সা কার না দরকার? কিন্তু বেকার শব্দটা আমার পছন্দ না। বেকার ছেলে নাকি পরিবারের বোঝা। এমন একটা ভাব, যেন সে যেচে পড়ে বেকার হয়েছে। শব্দটা শুনতেই তো ভাল না। নিজে নিজেকে বলা যায়। অন্যরা কেন বলবে? 'বেকারত্বের অভিশাপ' বললেই মনে হয় যেন অপরাধী।
আমার এত সহানুভূতির কারণ হল আমি কোন স্কুল কলেজ অফিস আদালতে কিছু করি না। ঘরে বসে মাছি মারি। পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুই মাসের বেশি। বয়স তো কম হল না। দেখতে শুনতে সেটা ভালই বোঝা যায়। তাই কেউ এখন আর কি পড়ি বা কোথায় পড়ি জিজ্ঞেস করে না, জিজ্ঞেস করে কি করি। আমাকে তখন শেষ হয়ে যাওয়া পরীক্ষাটার রেশ টানতে হয়। কি করি তার উত্তর হয় কবে কি করেছিলাম সেটা। তখন আবার কেউ কেউ বলে কি করার প্ল্যান। আহা যেন আমি প্ল্যান নিয়ে বসে আছি, টেন্ডার নোটিশ দেয়া আছে, প্রপোজাল এল বলে। কিংবা প্রশ্ন থাকে কি করার ইচ্ছা। বলতে মন চায় আমার ইচ্ছা সারাদিন আরাম করব। ঘুমাব বই পড়ব ফেসবুক আর সামুতে ঘুরব এবং এসবের জন্য মাস শেষে 'lucrative amount' ব্যাগে ভরব। কিন্তু সেই কথা বলি না। মামা চাচারা এসব বুঝবে না। বুঝলেও বলা যায় না। তাদেরকে তাই বলতে হয় কোন কোন ধরণের কর্পোরেট অফিস অথবা প্রাইভেট ব্যাংক অথবা ইউনিভার্সিটিতে 'try' করি বা করব। তাদের উপদেশ হল, বিসিএস দাও সম্মানের চাকরি কর। পুলিশে ঢুকো। মহিলা পুলিশদের অনেক দাম। আমি মাথা নাড়তে নাড়তে ভাব করি যেন খুব দামী একটা কথা শুনলাম। বিসিএস তো হাতের মোয়া। জিকে নাই কিছু নাই উনিশ বিশ জ্ঞান নাই আমি পারব বিসিএস! আবার বলে পুলিশ। যাই হোক সেটা কথা না। কথা হচ্ছে আমার কাজ করতে ইচ্ছা করে না। আবার কর্মহীন থাকতেও ভাল লাগে না। আস্ত একটা মানুষ আমি, বেলা বারোটায় আমাকে বাসায় পাওয়া যায়। কেউ ফোন করে কোথায় আছি জানতে চাইলে বাসায় বলতে শান্তি লাগে না। সাধ জাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলি আমি তো অফিসে, একটু বিজি আছি। বন্ধুরা অনেকেই ভালমন্দ চাকরি পেয়ে গেছে। কারো নতুন চাকরি পাওয়ার খবর শুনলে খুশি হবার আগে বুকে দুঃখের শেল বিঁধে। মনে মনে বলি, ওরে তুইও আমারে ছাইড়া গেলি রে?
আব্বাজানের একটা আশ্বাস আছে। যদি হায়াত খুব বেশি না নিয়ে এসে থাকি তাহলে বাকি জীবন হালকার উপর ঝাপসা খেয়ে পরে কাটানোর মত টাকা পয়সা দিতে পারবেন তিনি। কিন্তু কাজের বেলায় কিছু না। পঞ্চাশটা টাকার জন্য কৈফিয়ত দিতে লাগে একশটা। রিকশাভাড়া দেয়ার জন্য আজকাল ব্যাগ হাতড়ানোর পরও কিছু মিলতে চায় না। টুটাফাটা যেই টিউশানিটা ছিল, বাচ্চাকাচ্চার পরীক্ষা শেষ হবে কয়দিন পরে, আমার সাপ্লাই হবে পুরাপুরি বন্ধ। আর আমি যে চাকরি খুঁজব, পারিটা কি? ভাল করে চিন্তা করলে দেখি দিনে দিনে বয়স বাড়লেও কাজের কাজ কিছুই আসলে পারি না। অফিসে মানুষ ফাইলের মধ্যে কি কি সব লিখে, আবার দাগ দেয়, কম্পিউটারে ফটফট কি কি যেন টাইপ করে, এগুলি আমি কোনদিন পারব মনে হয় না। আবার সার্কুলার এর মধ্যে কত কি চায়। আমার শুধু কয়েকটা সার্টিফিকেট আছে, কিছু শিখি নাই।
আমি বর্তমানে একজন বেকার যুবমহিলা।
বেকার যুবকের গালে থাকে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হাই তুলতে তুলতে সে বেলা বারোটায় ঘুম থেকে উঠে। সারাজীবন ন্যায়ের পথে চলা মধ্যবিত্ত বাবা হাঁক দেন, "লাটসাহেবের আজ এত ভোরে ঘুম ভাঙলো যে?" সে সারাদিন পথে পথে ঘুরে, আড্ডাবাজি করে, রাত করে বাড়ি ফিরে ঠাণ্ডা ভাত খেয়ে সিগারেট টানতে টানতে বুকের কষ্ট বুকে চেপে আরেকটা দিনের অপেক্ষা করে।
বেকার যুবক প্রেমিকা হারানোর ঝুঁকিতে থাকে কারণ প্রেমিকার বাবা মেয়েকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগেন। বেকারকে কেউ সম্মান করে কথা বলে না। পাড়ার চাচারা অপদার্থ ভাবেন, চাকরি করা বন্ধুবান্ধবরা ধারের ভয়ে এড়িয়ে চলে, বড় ভাই বড় ভাবী থাকলে তারা নানারকম কথা শোনায়।
ইত্যাদি হল স্কুল আমলে বইপুস্তক আর নাটকের কল্যাণে গড়ে উঠা বেকার যুবকের ভাবমূর্তি। বেকারত্বের গ্লানি বলে একটা কথাও আছে। বেকার তকমাটা ছেলেদের গায়ে সেঁটে দেয়া হয়েছে। একটা মেয়ে একই সমান পড়াশোনা করে কাজ না পেলে তাকে সচরাচর কেউ বেকার বলে না মনে হয়। একটা সুবিধা আছে দেখি মেয়ে হওয়ার। কিন্তু আদপে সুবিধা কই? কম হোক বেশি হোক নিজের টাকা পয়সা কার না দরকার? কিন্তু বেকার শব্দটা আমার পছন্দ না। বেকার ছেলে নাকি পরিবারের বোঝা। এমন একটা ভাব, যেন সে যেচে পড়ে বেকার হয়েছে। শব্দটা শুনতেই তো ভাল না। নিজে নিজেকে বলা যায়। অন্যরা কেন বলবে? 'বেকারত্বের অভিশাপ' বললেই মনে হয় যেন অপরাধী।
আমার এত সহানুভূতির কারণ হল আমি কোন স্কুল কলেজ অফিস আদালতে কিছু করি না। ঘরে বসে মাছি মারি। পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুই মাসের বেশি। বয়স তো কম হল না। দেখতে শুনতে সেটা ভালই বোঝা যায়। তাই কেউ এখন আর কি পড়ি বা কোথায় পড়ি জিজ্ঞেস করে না, জিজ্ঞেস করে কি করি। আমাকে তখন শেষ হয়ে যাওয়া পরীক্ষাটার রেশ টানতে হয়। কি করি তার উত্তর হয় কবে কি করেছিলাম সেটা। তখন আবার কেউ কেউ বলে কি করার প্ল্যান। আহা যেন আমি প্ল্যান নিয়ে বসে আছি, টেন্ডার নোটিশ দেয়া আছে, প্রপোজাল এল বলে। কিংবা প্রশ্ন থাকে কি করার ইচ্ছা। বলতে মন চায় আমার ইচ্ছা সারাদিন আরাম করব। ঘুমাব বই পড়ব ফেসবুক আর সামুতে ঘুরব এবং এসবের জন্য মাস শেষে 'lucrative amount' ব্যাগে ভরব। কিন্তু সেই কথা বলি না। মামা চাচারা এসব বুঝবে না। বুঝলেও বলা যায় না। তাদেরকে তাই বলতে হয় কোন কোন ধরণের কর্পোরেট অফিস অথবা প্রাইভেট ব্যাংক অথবা ইউনিভার্সিটিতে 'try' করি বা করব। তাদের উপদেশ হল, বিসিএস দাও সম্মানের চাকরি কর। পুলিশে ঢুকো। মহিলা পুলিশদের অনেক দাম। আমি মাথা নাড়তে নাড়তে ভাব করি যেন খুব দামী একটা কথা শুনলাম। বিসিএস তো হাতের মোয়া। জিকে নাই কিছু নাই উনিশ বিশ জ্ঞান নাই আমি পারব বিসিএস! আবার বলে পুলিশ। যাই হোক সেটা কথা না। কথা হচ্ছে আমার কাজ করতে ইচ্ছা করে না। আবার কর্মহীন থাকতেও ভাল লাগে না। আস্ত একটা মানুষ আমি, বেলা বারোটায় আমাকে বাসায় পাওয়া যায়। কেউ ফোন করে কোথায় আছি জানতে চাইলে বাসায় বলতে শান্তি লাগে না। সাধ জাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলি আমি তো অফিসে, একটু বিজি আছি। বন্ধুরা অনেকেই ভালমন্দ চাকরি পেয়ে গেছে। কারো নতুন চাকরি পাওয়ার খবর শুনলে খুশি হবার আগে বুকে দুঃখের শেল বিঁধে। মনে মনে বলি, ওরে তুইও আমারে ছাইড়া গেলি রে?
আব্বাজানের একটা আশ্বাস আছে। যদি হায়াত খুব বেশি না নিয়ে এসে থাকি তাহলে বাকি জীবন হালকার উপর ঝাপসা খেয়ে পরে কাটানোর মত টাকা পয়সা দিতে পারবেন তিনি। কিন্তু কাজের বেলায় কিছু না। পঞ্চাশটা টাকার জন্য কৈফিয়ত দিতে লাগে একশটা। রিকশাভাড়া দেয়ার জন্য আজকাল ব্যাগ হাতড়ানোর পরও কিছু মিলতে চায় না। টুটাফাটা যেই টিউশানিটা ছিল, বাচ্চাকাচ্চার পরীক্ষা শেষ হবে কয়দিন পরে, আমার সাপ্লাই হবে পুরাপুরি বন্ধ। আর আমি যে চাকরি খুঁজব, পারিটা কি? ভাল করে চিন্তা করলে দেখি দিনে দিনে বয়স বাড়লেও কাজের কাজ কিছুই আসলে পারি না। অফিসে মানুষ ফাইলের মধ্যে কি কি সব লিখে, আবার দাগ দেয়, কম্পিউটারে ফটফট কি কি যেন টাইপ করে, এগুলি আমি কোনদিন পারব মনে হয় না। আবার সার্কুলার এর মধ্যে কত কি চায়। আমার শুধু কয়েকটা সার্টিফিকেট আছে, কিছু শিখি নাই।
আমি বর্তমানে একজন বেকার যুবমহিলা।
Subscribe to:
Posts (Atom)