Monday, April 27, 2009
ইভানা
মৃত্যুর সময় ইভানার বয়স ছিল ছয়। স্কুলে ভর্তি হয়েছিল হয়ত ওই বছর ঠিক মনে পড়ছে না। ওদের বাসা ছিল চিটাগাং এর কদমতলীতে। বেশ সুন্দর একটা ছোট বাসা, আশপাশের জায়গাটা বেশ সুন্দর। ওর অসুখ ধরা পড়ার পর জীবনে প্রথমবারের মত ঢাকায় আসে ইভানা। খালা খালু তাদের দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাদের বাসায়ই ওঠেন। উদ্দেশ্য ইভানাকে ডাক্তার দেখানো। ঢাকায় এসে নিশ্চিত হওয়া গেল ওর ব্লাড ক্যান্সার। তখনো সম্ভবত খুব খারাপ অবস্থায় পৌঁছেনি অসুখটা। পিজিতে ভর্তি করা হল ওকে। খালা আর ইভানার অস্থায়ী বাসস্থান হল হাসপাতাল। খালু কখনো আমাদের বাসা কখনো হাসপাতালে থাকতেন। ইভানার ভাই রিংকু ছিল আমার মাত্র মাস দুয়েকের বড়। ফলে ওর সাথে আমার সখ্য ছিল খুব। আমরা দুইজনই সেবার নতুন ক্লাস ফোরে উঠেছি। জানুয়ারি মাস। রিংকু আমাদের বাসায় বেশ কিছুদিন থাকবে, আমার আনন্দের সীমা ছিল না। আমাদের দিনকাল খুব আনন্দে কাটতে লাগল। নাটকের কল্যাণে ব্লাড ক্যান্সার নামটা তখন জানা ছিল কিন্তু ইভানার এই অসুখ হয়েছে আমাদের ছোটদেরকে কেউ এটা বলেনি। আর রোগটা এত বেশি বিস্তৃত হয়ে পড়েছে একথা তখনো কেউ জানত না। ফলে এমন একটা অসুখ নিয়ে বাচ্চা একটা মেয়ে দিনের পর দিন সাদা বিছানায় পড়ে আছে বিষয়টা আমাদের দুইজনকে মোটেও ভাবিত করেনি। মনে আছে আমার আর রিংকুর প্রতিটা দিন ছিল খুশির। এতদিন একসাথে থাকা হয়নি আগে কখনো। নানুর বাড়িতে মাত্র দুই দিনের জন্য দেখা হত, খেলেধুলে মন ভরতো না। এখন ভাবলে অবাক লাগে সেই সময়টায় আমাদের প্রিয় খেলনা ছিল এক গাদা সুঁইবিহীন নানা আকৃতির সিরিঞ্জ। ইভানার ছোটখাট শরীরে ওই বিশাল বিশাল সিরিঞ্জ দিয়ে ওষুধ ঢোকানো হত। কিন্তু এসব বাসায় কেন বয়ে আনা হত বা আমাদের হাতেই বা অবলীলায় কেন দেয়া হত জানিনা। কয়েকবার ওকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। দেখতে খারাপ হয়ে গিয়েছিল ইভানা। কিন্তু স্বভাবসুলভ মজার মজার কথা বলত তখনো। বেশ কিছুদিন ওষুধপত্র চলার পর বাসার উদ্দেশ্যে ওরা ঢাকা ছাড়ে। জানা গিয়েছিল রোগটা সারবে না। তার অল্প কিছুদিন পরেই ওর মৃত্যুর খবর আসে। সেই ষোল বছরেরও বেশি সময় আগের অনেক কিছুই স্পষ্ট মনে আছে। পিজি হাসপাতাল, ওদের আসার ঠিক আগে আগে আমার জন্মদিনের কেকের রঙ, খেলার কাজে লাগানো আমাদের ব্যাগ ভরা নানা রঙের কাগজের রকেট। আমি আর রিংকু একটা গান শুনে খুব হাসতাম সুরসহ সেই গানটার লাইনগুলো মনে আছে, কোন এক শুক্রবারে আমরা কিভাবে বসে দুইজন স্যুপ খেতে খেতে টিভিতে অলিভার টুইস্ট দেখেছিলাম একথা মনে আছে, এমনকি তার মাঝেই একদিন আমি দুইটা স্ট্যাম্প কিনেছিলাম গ্রানাডার তাদের ডিজাইনও আমার খুব ভাল মনে আছে। এমন অনেক ছোটখাটো কথাবার্তা পরিষ্কার ছবির মত মনে আছে। এসব কিছুর পাশে সবচেয়ে অস্পষ্ট ছবি ইভানা নিজে। শুধু একবার কোন এক অনুষ্ঠানে খালা বলেছিলেন, আজকে ইভানা থাকলে তোদের মতই শাড়ি পরে ঘুরত। ওই মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে ওকে কল্পনায় বসালাম, পাছে খালার কাছে ধরা পড়ি আমি ওকে মনে রাখিনি। শ্যামলা, মাথার সাথে লেগে থাকা ছোট চুল, ঠোঁট বেঁকে পড়া হাসি, আবছা চেহারাটায় কি কি ছিল তা মনে আছে অনেকটা তথ্যের মত করে, কিন্তু পুরো মানুষটাকে দাঁড় করাতে পারি না কিছুতেই। মনেও পড়ে না এমন কেউ আদৌ ছিল। মৃত মানুষরা কত সহজেই না স্মৃতি থেকে হালকা হতে থাকে, আর এক সময় হয়ে পড়ে শূণ্য। খুব কাছের মানুষরাও বিশেষ দিবস ছাড়া তেমন একটা মনে রাখে না। অলস দুপুর বা বিষণ্ণ বিকালে কখনো দীর্ঘশ্বাস হয়ে হারানো আপনজন ভেসে আসে। একটু পরেই বাস্তবতার টোকায় ফিরে আসতে হয়। হয়ত বেঁচে থাকার জন্য, জীবনের স্থবিরতা এড়ানোর জন্য এটাই জরুরী।
Subscribe to:
Posts (Atom)