রবীন্দ্রনাথের “ছিন্নপত্র” পড়তে বেশ লাগে। চিঠির ভেতর সুখ দুঃখ হাসি ঠাট্টা কেমন চমৎকার বিনুনি করে লেখা। মাঝে মাঝে পত্রিকায় বা টিভিতে বয়স্কজনরা আক্ষেপ করে বলে থাকেন চিঠি কি তবে আমাদের জীবন থেকে হারিয়েই গেল? তাই হবে। এখনো না হারিয়ে গিয়ে থাকলে অচিরেই যে যাবে সন্দেহ নেই। যে এখন কাগজকলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসে, সে যে শখ করেই কাজটা করছে কে না বুঝবে। সৌখিনতার বস্তু একসময় নিত্যপ্রয়োজনের বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। আবার নিত্যকার দরকারি কিছুও যে কালে কালে নিছক সৌখিনতা হয়ে উঠতে পারে এটাও দেখি ভুল না।
অবস্থার বদল না হলে কেমন হত? হয়ত ভোরবেলা ঘুম ভেঙে উঠলাম। নাশতার টেবিলে বসতেই দরজায় টুংটাং বেল। দরজা খুলতেই দেখি ডাকপিওনের মুখ। “আপুমণি আপনার চিঠি আছে।“ তারপর সে আমার হাতে তুলে দিল একটা সাদা অথবা গোলাপি অথবা হোক সাধারণ হলদে রঙেরই একটা খাম। আমার চোখ আনন্দ আর উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করতে থাকল। খামের মুখ ছিঁড়তেই প্রতীক্ষিত আকাঙ্খিত একটা ভাঁজফেলা কাগজ। আমি হাসিমুখে পড়ছি, ধীরে ধীরে, যেন না ফুরায়...। কল্পনাটা মনে হয় প্রেমের গল্পের কোন একটা অংশের মত হয়ে যাচ্ছে। তা আমার উদ্দেশ্য না। চিঠি লেনদেনের পরিণতি যে কেবল ভালবাসাবাসির দুয়ারে গিয়েই মিলবে তা তো নয়। তা নির্দোষ বন্ধুত্ব, নির্মোহ ভাললাগা তো হতেই পারে। কত কত দিন হয়ে গেল চিঠি পাওয়া হয় না, চিঠি লেখা হয় না। তার চেয়েও বেশি দিন ধরে পরীক্ষার খাতায় কিংবা ক্লাসনোটে বাংলা হরফের চিহ্ন চোখে পড়ে না।
একবার বাসায় একটা মজার চিঠি এসেছিল। ‘প্রথম আলো’ অথবা ‘ভোরের কাগজ’ এর সঙ্গে সাপ্তাহিক একটা ম্যাগাজিন ছিল ‘গ্যালারি’ নামের। ক্লাস নাইনে সেখানে একবার কুইজে আমি প্রাইজবন্ড জিতি। তো আমার নাম ছাপা হয় ঠিকানাসহ। কিছুদিন পর বাসায় একটা চিঠি হাজির। ময়মনসিংহের এক লোক আমাকে বন্ধু ভেবে ফেলেছে। এবং আপনি আপনি করে লিখতে লিখতে হঠাৎ “মনের অজান্তে কখন যেন” তুমি করে লেখা শুরু করেছে। চিঠিটা আবার গোলাপ আঁকা বেগুনি রঙের কাগজে লেখা। একটা লাইন আমার পুরোপুরি মনে আছে- “আমার চোখের কোণে বিরাজ করে এক অজানা হারানোর ব্যথা সুন্দরকে হারানোর ভয় আর ব্যথিত হবার যাতনা”। আমি তার নিপীড়িত অক্ষিযুগলের কি উপকারে আসতাম কে জানে। বিব্রতকর ব্যাপার হল চিঠিটা আবার বাসায় অন্যরাও খুলে খুলে পড়েছে। ওই ছাপানো নামঠিকানার বদৌলতে পত্রমিতালিতে উৎসুক আরো কয়েকজন মানুষের বার্তা আসে বাসায়। পরে এভাবে ঠিকানা না ছাপানোর অনুরোধ করে আমি একটা চিঠি পাঠাই ওই পত্রিকায়।
কিছু প্রাপকহীন পত্রও তো থাকে। নিজের কথাকে কারো সঙ্গে বলার মত করে লেখা। এটা ডায়রি লেখারই নামান্তর। প্রিয় অমুক বলে কাউকে ডেকে ডেকে কথা বলাটা হয়ত একটু সহজ হয়। Anne Frank এর বিখ্যাত ডায়রির মত করে। কোথায় চলে যাচ্ছে সব! আমি মানুষটা তত নতুন না বলে চিঠিপত্রের মর্ম বোঝার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ভবিষ্যতের প্রজন্ম অনেক নতুন কিছু জানবে। কিন্তু চিঠিকে জানা হবে না। যেমন আমরা অনেককিছু জানলেও কতকিছুই জানি না। অস্বীকার করার উপায় নেই যে তবুও ইমেইল আনন্দ দেয়। ইংরেজির ছাঁচে ফেলা বাংলা পড়া খুব বেশি সুখকর না হতে পারে, তাই বলে নিতান্ত দুঃখেরও না। নাহয় ইনবক্সে কিছু একটা আছে জানলে চোখ চকচক করে কেন? পড়তে পড়তে শেষদিকে নেমে এলে মনমরা লাগে কেন? তবে যে যাই বলুক কাগজের উপর কালির বিন্যাসের আবেদনটা আসলেই অন্যরকম। একেকটা হাতের লেখা একেক ধরণের হবার সুযোগ থাকে, ফন্ট নামের সাম্যবাদী উড়ে এসে সবাইকে এক কাতারে নামিয়ে ফেলতে পারে না। হাতে লেখা চিঠি ভাঁজ করে জমিয়ে রাখা যায়। হঠাৎ কেউ দেখে ফেলার দুশ্চিন্তায় বুক ধুকপুক করানো যায়। বহুদিনের ব্যবধানে নকশাকাটা কাগজের টুকরোটা একদিন পাণ্ডুর হয়ে যাবার ভয়ও থাকে। আর হাতে লেখা চিঠি একদিন পথের বাঁকে ভুল করে হারিয়েও যেতে পারে। ইমেইলের মত অমরত্ব বটিকার কোন বালাই নেই তার। কোন পাসওয়ার্ডের ধার ধারে না। হয়ত মরণশীল আর আর জরাক্রান্ত হবার ঝুঁকি আছে বলেই চিঠি এত প্রিয় হয়ে ওঠে। কে না জানে যে অক্ষয়ের চেয়ে ক্ষয়শীলকেই বেশি আদুরে মনে হয়!
কাগজের চিঠির চল যদি এখনো আগের মত থাকত? আমরা কাউকে কাউকে নিয়মিত লিখতাম নিশ্চয়ই। “কেবল আমারই সংবাদ জানতে উৎসুক হয়েছ। কিন্তু বিভুঁইয়ে বাস কর বলে কাঁচা গ্রীষ্মের দাবদাহে ঢাকাবাসী সকলের ওষ্ঠাগত প্রাণবায়ু যে বাস্তবিকই দেহের খাঁচাখানা ছেড়ে উড়াল দেবার জো করেছে তা কি সত্যই তোমার জ্ঞানসীমানায় নাই?” নাহ! ‘ছিন্নপত্র’ মাথাকে গুবলেট করে দিয়েছে। আজকাল কি আর এমন পেঁচিয়ে লেখা হয়? বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রচনার শিল্পগুণ’ যেই ‘প্রাঞ্জলতা’র সন্ধান করত, তার রূপ এখন অনেক ভিন্ন।
হঠাৎ একদিন রাজ্যের কথায় ঠাসা একটা নামহীন চিঠি এসে পড়ে না কেন আমার বাড়িতে? হাত পা ছড়িয়ে ভাবতে বসতে পারতাম।
Friday, April 25, 2008
Monday, April 21, 2008
ভাইভা...
অনার্সজীবনের শেষ ভাইভাটা বাকি ছিল। আজকে সেটাও দিয়ে আসলাম। ভাইভা, বড়ই আতংকের একটা বিষয়। গত কয়েক বছরের মার্কামারা ভেন্যু বাদ দিয়ে এবার অন্য একটা রুমে বসতে হয়েছে। একবার মনে হয় এটা শেষ ভাইভা তাই খুব কঠিন হবে। তারপরে মনে হয় ভেন্যু বদলে গেছে, কঠিন হবে। টিচাররা মাঝে খাবারের ব্রেক নিলেন, তাদের নতুন উদ্যম এসেছে, কঠিন হবে। আজকে খুব গরম তাই প্রশ্ন খুবই কঠিন হবে। ইত্যাদি নানা শঙ্কা। রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে একেকজন ভেতর থেকে বের হয়ে আসে, সঙ্গে সঙ্গে বাকিরা বাঘের মত, অথবা বলা যায় মাইক্রোফোনওয়ালা সাংবাদিকের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তার অভিজ্ঞতার ফিরিস্তি নেয়ার জন্য। সেই প্রশ্নের ধরণ শুনে দিশেহারা লাগতে থাকে। তারপর যখন আমার সিরিয়াল বেশ কাছিয়ে এল, শুরু হল গলার নিচ থেকে তলপেট পর্যন্ত তোলপাড়। শেষ পর্যন্ত একসময় আমার ডাক আসল। আর আমি দেখলাম কি আমি বেশিরভাগ প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারলাম। স্যার বেশ গম্ভীর মুখ করে কঠিন কঠিন প্রশ্ন করেন বলে তাকেই আমাদের বেশি ভয়। আর কি যে সব প্রশ্ন! আর ম্যা’ম দু’জনের চোখেমুখে সবসময়েই “হুঁমম একদম ঠিক বলছ” ধরণের দ্যুতি খেলতে থাকে। আমরা যাই বলি না কেন তাদের দিকে দেখলে ভরসা হয়। স্যারের প্রলয়ঙ্কারী জিজ্ঞাসার কোপানলে পড়তে হয়নি বলে আমি বেশ নিরাপদে সেশন শেষ করতে পেরেছি।
লিখিত পরীক্ষা শুরু করার আগে একটা কমন ডায়লগ হল “আমি কিচ্ছু পারিনা।“ কিংবা বড় জোর অমুক আর তমুক ছাড়া কিচ্ছু পারিনা। তবে এই কথাটা আক্ষরিক অর্থে বলা হয়না। এর মানে হল “আমার অবস্থা সুবিধার না”। মজার ব্যাপার হল কেউ কেউ ভাব ধরার জন্য এটা মিথ্যা করে বলে। কেউ কেউ সত্যি করে বলে। আর যারা জানে না যে তাদের প্রিপারেশানটাই যথেষ্ট তারাও বলে। আমি হয়ত মোটামুটি শিখে টিখে গেলাম। কিন্তু যারা ভাল মার্কস পায় আর আসলেই ঠিকঠাকমত পড়াশোনা করে তারাই যখন কিছু বিজাতীয় টার্ম ব্যবহার করে বলে যে কি লিখবে তা নিয়ে তারা খুব টেনশনে আছে আমার তখন মনে হতে থাকে তাহলে আমি যেটাকে পারা মনে করছি তা আসলে “পারা” না? এই ভেবে ঢোঁক গিলতে থাকি। তবে পরীক্ষার মাসখানেক আগেও যারা honestly মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে হায়রে আমি এক লাইনের বেশি লিখতে পারব না, তারা full answer করে আসে, কেউ কেউ খাতা ভরে ফেলে এক্সট্রা কাগজ নেয়, ঝড়ের গতিতে লিখে আঙ্গুল ব্যথা করে ফেলে মোট কথা তারা কমপক্ষে মাঝারি ধরনের রেজাল্ট উৎপাদন করে ফেলে; আর সত্যি কথা হচ্ছে ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই জাতের মানুষের সংখ্যাই বেশি।
অনার্সে উঠার পর একটা বিষয় থেকে মুক্তি পেয়েছি। তা হল, রোল নাম্বার কত এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া। আজকে কি দিয়ে ভাত খেয়েছ, কে বেশি আদর করে আব্বু না আম্মু এই লেভেল পার করে একটু বড় হলেই বাচ্চারা যেসব প্রশ্ন শোনে তা হল রোল নাম্বার সংক্রান্ত। এক থেকে তিনের মধ্যে থাকলে তো খুবই ভাল। আর একুশ বাইশ হলে সুখের ব্যাপার না। তবে পেছনের সারির রোল নাম্বার যদি ভর্তির কারণে ঘটে থাকে তাহলে উত্তরের সঙ্গে সেই তথ্য জুড়ে দেয়াটাই ভাল। আগে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে বা রেজাল্টের রেশ থাকতে থাকতে গ্রামে যেতাম। বড়রা বিশেষ করে মামারা জানতে চাইতেন রেজাল্ট কি। বড়ই বিব্রতকর অবস্থা ছিল তখন। কারণ আমি সবসময় মাঝ বরাবর জায়গায় ঝুলে থেকেছি, সুতরাং মুখ কালো করে বলা যেত না যে এক নাম্বারের জন্য আমি ফার্স্ট হতে পারিনি। কলেজ ছাড়ার পর থেকে আর কেউ কোন কথা জিজ্ঞেস করে না। পরীক্ষার থাকে না ঠিকঠিকানা, রেজাল্ট দেয়ার থাকে না সময় অসময়। তবে এবার বিরাটভাবে ফেঁসে যেতে পারি। কারণ ফাইনালের খবর সবাই জেনে গেছে। সবাই বলতে সত্যিই সবাই। আত্মীয়জগত, প্রতিবেশীজগত, বাবা মায়ের পরিচিতজনের জগত থেকে শুরু করে সাইবারজগতের বন্ধুবান্ধবরাও। রেজাল্ট বের হলে গা ঢাকা দিতে হবে।
পরীক্ষাটা তাহলে শেষই হয়ে গেল!
লিখিত পরীক্ষা শুরু করার আগে একটা কমন ডায়লগ হল “আমি কিচ্ছু পারিনা।“ কিংবা বড় জোর অমুক আর তমুক ছাড়া কিচ্ছু পারিনা। তবে এই কথাটা আক্ষরিক অর্থে বলা হয়না। এর মানে হল “আমার অবস্থা সুবিধার না”। মজার ব্যাপার হল কেউ কেউ ভাব ধরার জন্য এটা মিথ্যা করে বলে। কেউ কেউ সত্যি করে বলে। আর যারা জানে না যে তাদের প্রিপারেশানটাই যথেষ্ট তারাও বলে। আমি হয়ত মোটামুটি শিখে টিখে গেলাম। কিন্তু যারা ভাল মার্কস পায় আর আসলেই ঠিকঠাকমত পড়াশোনা করে তারাই যখন কিছু বিজাতীয় টার্ম ব্যবহার করে বলে যে কি লিখবে তা নিয়ে তারা খুব টেনশনে আছে আমার তখন মনে হতে থাকে তাহলে আমি যেটাকে পারা মনে করছি তা আসলে “পারা” না? এই ভেবে ঢোঁক গিলতে থাকি। তবে পরীক্ষার মাসখানেক আগেও যারা honestly মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে হায়রে আমি এক লাইনের বেশি লিখতে পারব না, তারা full answer করে আসে, কেউ কেউ খাতা ভরে ফেলে এক্সট্রা কাগজ নেয়, ঝড়ের গতিতে লিখে আঙ্গুল ব্যথা করে ফেলে মোট কথা তারা কমপক্ষে মাঝারি ধরনের রেজাল্ট উৎপাদন করে ফেলে; আর সত্যি কথা হচ্ছে ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই জাতের মানুষের সংখ্যাই বেশি।
অনার্সে উঠার পর একটা বিষয় থেকে মুক্তি পেয়েছি। তা হল, রোল নাম্বার কত এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া। আজকে কি দিয়ে ভাত খেয়েছ, কে বেশি আদর করে আব্বু না আম্মু এই লেভেল পার করে একটু বড় হলেই বাচ্চারা যেসব প্রশ্ন শোনে তা হল রোল নাম্বার সংক্রান্ত। এক থেকে তিনের মধ্যে থাকলে তো খুবই ভাল। আর একুশ বাইশ হলে সুখের ব্যাপার না। তবে পেছনের সারির রোল নাম্বার যদি ভর্তির কারণে ঘটে থাকে তাহলে উত্তরের সঙ্গে সেই তথ্য জুড়ে দেয়াটাই ভাল। আগে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে বা রেজাল্টের রেশ থাকতে থাকতে গ্রামে যেতাম। বড়রা বিশেষ করে মামারা জানতে চাইতেন রেজাল্ট কি। বড়ই বিব্রতকর অবস্থা ছিল তখন। কারণ আমি সবসময় মাঝ বরাবর জায়গায় ঝুলে থেকেছি, সুতরাং মুখ কালো করে বলা যেত না যে এক নাম্বারের জন্য আমি ফার্স্ট হতে পারিনি। কলেজ ছাড়ার পর থেকে আর কেউ কোন কথা জিজ্ঞেস করে না। পরীক্ষার থাকে না ঠিকঠিকানা, রেজাল্ট দেয়ার থাকে না সময় অসময়। তবে এবার বিরাটভাবে ফেঁসে যেতে পারি। কারণ ফাইনালের খবর সবাই জেনে গেছে। সবাই বলতে সত্যিই সবাই। আত্মীয়জগত, প্রতিবেশীজগত, বাবা মায়ের পরিচিতজনের জগত থেকে শুরু করে সাইবারজগতের বন্ধুবান্ধবরাও। রেজাল্ট বের হলে গা ঢাকা দিতে হবে।
পরীক্ষাটা তাহলে শেষই হয়ে গেল!
Monday, April 14, 2008
চৈতালি হাওয়া বৈশাখি ঝড়
আজকের সূর্যাস্তটা ছিল এই বছরের শেষ সূর্যাস্ত। বাংলা বর্ষের যেই বিষয়টা আমার সবচেয়ে ভাল লাগে তা হল এখানে একটা নতুন দিন আরম্ভ হয় সূর্যোদয়ের সাথে। রাত বারোটায় অথবা সন্ধ্যায় চাঁদ উঠার সময় দিন শুরু করার চেয়ে ঊষার আলোয় শুরু করাটা অনেক বেশি যৌক্তিক বলে মনে হয়। এমনিতে কতজন বাংলা দিন তারিখের হিসাব রাখে জানি না। আমার নিজের তো রাখা হয় না। শুধু পয়লা ফাল্গুন আর পয়লা বৈশাখের কথাই মনে থাকে। সেটাও উৎসব হয় দেখে। এবার আমি পুরোপুরি গুহাবাসী। মানুষের হৈ হুল্লোড় টিভিতে দেখতে খুবই ভাল লাগে। অংশ নিতেও ইচ্ছা হয়। কিন্তু বাইরে বের হলে মারাত্মক গরম আর প্রচন্ড ভীড়ের চাপে দিশেহারা লাগে। যে কয়েকবারই বেড়াতে বেরিয়েছিলাম, সকাল বেলা খুব খুশি থাকতাম কিন্তু বিকাল হতেই অতিষ্ঠ হয়ে ঠিক করতাম যে ভবিষ্যতে আর না। আবার পরের বছরও একই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। এই বছর তাই ঘরেই গ্যাঁট হয়ে থাকব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। বরং পরের দুই একদিন চেষ্টা করা যেতে পারে। আমার খুব ইচ্ছা করছে বছরের প্রথম দিনটা ঝড় হোক। তুমুল ঝড় বজ্রপাত সাথে মাঝারি বা ভারী বৃষ্টি। শুধু কালকে দিনটার জন্য। রাতের দিকে বেশ হাওয়া দিয়ে হালকা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় সাধটা আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। কিন্তু তাহলে চারুকলার লক্ষ্মীপ্যাঁচা, রমনার মঞ্চ এসবের কি হবে? যাদের দিনব্যাপী ঘোরাঘুরির প্ল্যান তাদেরই বা কি হবে? যার যাই হোক ঝড় হলে আমি নিজে দারুণ খুশি হব।
বৈশাখ মানে বৃষ্টির দিন চলেই এল। আমরা যারা ইট কাঠের ছাউনিতে মাথা বাঁচানোর সুযোগ নিয়ে জন্মেছি তাদের কারো কারো রোমান্টিক ভাবনার দরজায় কড়া নাড়া শুরু হয়ে গেছে। বৈশাখের বৃষ্টি আর শ্রাবণের বৃষ্টিতে বেশ তফাত। বর্ষাকালের বৃষ্টি অনেকটা নমনীয়। হট্টগোল ততটা করে না। গ্রীষ্মেরটাই বরং ভাল। আচমকা তুমুল বাতাস শুরু হবে মাঝরাস্তায়। পথচারীরা খানিকটা বেকায়দায় পড়ে যাবে। সাথে বেশ একটা আনন্দ আনন্দ অনুভূতিও হবে। ঘরে থাকলেও মন্দ না। হঠাৎ করেই কাছাকাছি বাসাগুলিতে দুমদাম দরজা জানালার কপাটের শব্দ শোনা যাবে। সেই সাথে শুরু হবে অভিভাবকদের চেঁচামেচি, এখনো জানালা খোলা? এখনি বন্ধ কর, ধূলা আসে বালি আসে এই সেই। আরে জানালা বন্ধ করলে ঝড়ঝঞ্ঝা খাব কেমন করে? ঠিক আছে প্রাণ ভরে খাও, তবে দয়া করে রুমটাও ঝাড়ু দিয়ে নিও। ঝাড়ু দেয়ার কথা শুনলে গলার জোর কমে আসে। সেক্ষেত্রে দুই একখানা জানালা খুলে রেখে এমনভাবে হাত পা ছড়িয়ে দাঁড়াতে হয় যেন আমাকে ডিঙিয়ে কোন আলাই বালাই ঘরকে ছুঁতে না পারে। অদ্ভুত কথা, আমার জন্য ঘর নাকি ঘরের জন্য আমি?
বৈশাখ মানে বৃষ্টির দিন চলেই এল। আমরা যারা ইট কাঠের ছাউনিতে মাথা বাঁচানোর সুযোগ নিয়ে জন্মেছি তাদের কারো কারো রোমান্টিক ভাবনার দরজায় কড়া নাড়া শুরু হয়ে গেছে। বৈশাখের বৃষ্টি আর শ্রাবণের বৃষ্টিতে বেশ তফাত। বর্ষাকালের বৃষ্টি অনেকটা নমনীয়। হট্টগোল ততটা করে না। গ্রীষ্মেরটাই বরং ভাল। আচমকা তুমুল বাতাস শুরু হবে মাঝরাস্তায়। পথচারীরা খানিকটা বেকায়দায় পড়ে যাবে। সাথে বেশ একটা আনন্দ আনন্দ অনুভূতিও হবে। ঘরে থাকলেও মন্দ না। হঠাৎ করেই কাছাকাছি বাসাগুলিতে দুমদাম দরজা জানালার কপাটের শব্দ শোনা যাবে। সেই সাথে শুরু হবে অভিভাবকদের চেঁচামেচি, এখনো জানালা খোলা? এখনি বন্ধ কর, ধূলা আসে বালি আসে এই সেই। আরে জানালা বন্ধ করলে ঝড়ঝঞ্ঝা খাব কেমন করে? ঠিক আছে প্রাণ ভরে খাও, তবে দয়া করে রুমটাও ঝাড়ু দিয়ে নিও। ঝাড়ু দেয়ার কথা শুনলে গলার জোর কমে আসে। সেক্ষেত্রে দুই একখানা জানালা খুলে রেখে এমনভাবে হাত পা ছড়িয়ে দাঁড়াতে হয় যেন আমাকে ডিঙিয়ে কোন আলাই বালাই ঘরকে ছুঁতে না পারে। অদ্ভুত কথা, আমার জন্য ঘর নাকি ঘরের জন্য আমি?
Sunday, April 13, 2008
গল্প লেখা
যারা লেখক তারা কেমন করে মনের কথাটা লিখে ফেলেন তা খুব অবাক লাগে। পড়তে পড়তে দেখা যায় আরে আমি তো ভেবেছিলাম এই কথাটা শুধু আমিই ভাবি। অর্থাৎ কোন একটা ব্যাপার তাঁরা কিভাবে যেন পাঠকের মন মত করেই প্রকাশ করে ফেলেন। হতে পারে আমি একটা জিনিস যেভাবে ভাবি সেই জিনিসটাকে অনেকেই সেভাবেই ভাবে। কিন্তু প্রকাশটা সবাই করতে পারে না, পারেন আমার হাতে যেই বই তার লেখক। Aristotle এর ধারণা fiction লেখার আগে পুরো প্লট সাজিয়ে নিয়ে বসতে হয়। আসলেই কি তাই? আমি ঠিক জানি না। কেউ কেউ তো হঠাৎ করেই খুব চমৎকার একটা উপন্যাস বা গল্প বা কবিতাকে রূপ দিয়ে ফেলতে পারেন। তেমন চিন্তাভাবনা ছাড়াই। সারাজীবনে আমি কতবার চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছুতেই পারি না। কেউ কেউ বলে সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। আবার কেউ কেউ বলে চেষ্টা করলে সবই হয়। কিছুদিন আগে খুব উৎসাহ নিয়ে একটা গল্প লিখতে শুরু করেছিলাম...বছর চল্লিশেক বয়সের এক নারী স্বামীর সঙ্গে দেশের বাইরে থাকে। দু’জন সন্তান আছে তার। তার জীবনের একমাত্র প্রেমটা ব্যর্থ হয়। একদিন সে খালি বাসায় বসে দেশে ফেলে আসা পুরনো দিনের নানা কথা ভাবছে। বিশেষ করে এই পর্যন্ত যতজন পুরুষকে সে কাছ থেকে দেখেছে তাদের কথা। কারো জন্যই সে কোন টান অনুভব করে না এখন। জীবনে কি কি না পাওয়া আছে তাও ভাবছে। হঠাৎ করেই প্রাইমারিতে পড়ার সময়কার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কথা মনে পড়ে যায়। শান্তশিষ্ট ধরণের একটা ছেলে যে খুব কম বয়সে মারা যায়। ছেলেটা মেয়েটার জন্য অনেক সময় নিয়ে একটা উপহার তৈরি করছিল। বলেছিল তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে সে একটা বিশাল সারপ্রাইজ দিবে। মেয়েটারও অধীর অপেক্ষা। এর মাঝেই ছেলেটা অসুখে পড়ে, কিছুদিন পর মারা যায়। বড় হতে হতে মৃত বন্ধুর কথা দিনে দিনে সে ভুলেই যায় অনেকটা। আজকে হঠাৎ করেই তার মনে হয় এত দামী ঘরবাড়ি গোছানো সংসার সব কিছু বৃথা। কখনোই জানা হবে না সেই সারপ্রাইজটা কি ছিল। সে প্রচন্ড অস্থির অনুভব করতে থাকে সেই উপহারটা হাতে পাওয়ার জন্য...এইরকম ছিল আমার গল্পটা যেটাকে কিছুতেই চেহারা দিতে পারিনি। দুই পৃষ্ঠা এগিয়েই শেষ।
এলেবেলে টাইপের কয়েকটা কবিতার কথা বাদ দিলে সারাজীবনে পেপারের দোর পর্যন্ত একটা গল্পই নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। দুঃখ ছিল যে সেখানে নিজের নামের আগে “সংগ্রহ” শব্দটা জুড়ে দিতে হয়েছে কারণ সেটা গ্রামে গিয়ে শোনা কাহিনীর লৈখিক রূপ, মৌলিক কিছু না। সেই বাচ্চাকালে কবি লেখক জাতীয় কিছু হবার বাসনা ছিল। এখন হারিয়ে গেছে।
এলেবেলে টাইপের কয়েকটা কবিতার কথা বাদ দিলে সারাজীবনে পেপারের দোর পর্যন্ত একটা গল্পই নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। দুঃখ ছিল যে সেখানে নিজের নামের আগে “সংগ্রহ” শব্দটা জুড়ে দিতে হয়েছে কারণ সেটা গ্রামে গিয়ে শোনা কাহিনীর লৈখিক রূপ, মৌলিক কিছু না। সেই বাচ্চাকালে কবি লেখক জাতীয় কিছু হবার বাসনা ছিল। এখন হারিয়ে গেছে।
Wednesday, April 2, 2008
পরীক্ষার পর
অনার্সের শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে যখন কলাভবন থেকে বের হলাম, অনুভূতিটা ঠিক কেমন ছিল এখন বুঝতে পারছি না। ওই মুহূর্তেও বুঝতে পারছিলাম না। একটুকু বলা যায় যে মুক্তির আনন্দ যতখানি ছিল এবং আছে তার চেয়ে বেশি হল অপ্রকাশিত দীর্ঘশ্বাস। সবাইকে এভাবে করে একসঙ্গে দেখা আর কখনোই হবে না। সান্ত্বনা খোঁজার জন্য ভেবে নিই, পরীক্ষা শেষ হল কোথায় ভাইভা তো রয়ে গেছে। অথবা রেজাল্টের তো এখনও ঢের সময় বাকি। কিংবা রেজাল্টের পর মাস্টার্সের ক্লাস তো করতে হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যিকার অর্থে আমি বা আমরা এখন নো ম্যান’স ল্যান্ডে। মাস্টার্স বা এম বি এ যে যাই পড়ুক সেটা ভিন্ন একটা ব্যাপার। তাকে Mainstream পড়াশোনার মধ্যে ফেলা যায় না। কিছুদিন পর থেকে মনে হতে থাকবে আমি আসলে কি করি। কেউ জিজ্ঞেস করলে গাল ভরে বলার মত কিছুই পাব না। জীবনের অন্য সব ফাইনালের পর যেই দিগ্বিজয়ী ভাব হত সেটাকে হাতড়েও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, যাবে না। এই বোধটা যতটা বিদায়ের সাথে জড়িত তার চেয়ে কোন অংশে কম জড়িত না নতুন ধাপে পা রাখার তাড়নার সাথে। অনেক হল এবার কোন একটা কাজ খোঁজার চেষ্টা কর। সেশনজট বা চাকরির দুরূহ বাজার বলে কোথাও যদি কিছু না থাকত তাহলে এতদিনে তো আমার ফুলটাইম কাজ করার কথা। চেহারা আর বয়সের সার্টিফিকেটও একই কথা বলে। আর মুখের কথায় যেভাবে রাজা উজির মেরে সাফ করি তাতে বাস্তববুদ্ধি পুরোপুরি ফাঁকা বলেও মনে হবার কথা না। শুধু একটা ব্যাপারই ধ্রুব সত্য তা হল কেউ এক হাতে সহজ কাজ আর আরেক হাতে টাকার ব্যাগ নিয়ে আমার জন্য অধীর হয়ে বসে নেই। নিজের জায়গা খুঁজে নেয়া আর করে নেয়ার দায়িত্ব প্রত্যেকের নিজেরই। এভাবে চিন্তা করলে একটা শিহরণ লাগে। “এখনো তো বড় হইনি” বলার সব অজুহাত সত্যিই কি একসময় শেষ হয়?
এসব অলংকার পরানো কথা শুনলে আমার মত অবস্থার মানুষেরা ছাড়া অন্য যে কারো মনে হতে পারে তিনটা দিন পার হতে না হতেই আদিখ্যেতা, সত্যিকার মাঠে নামো তারপর দেখি কি কর। মা বাবার হোটেলে খেয়ে, গুছিয়ে দেয়া ঘরে ঘুমিয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজটা চাইলেই সবাই করতে পারে। অনেকটা নন্দদুলালের মত বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবা, কিছু একটা করতেই হবে। কতটুকু Practical যোগ্যতা যে আমার আছে জানি না। আমার করা কোন কিছু কারো পছন্দ হবে কিনা কে বলবে। আবার এও বিশ্বাস করি যে আমি মোটেও ফেলনা না। সবাই একসময় আমার মত ছিল । তারা যখন অনেককিছু পারে আমিও অবশ্যই পারি এবং পারব। চেষ্টা করলে কি না হয়। সাথে সাথে মনে হয়, ও চেষ্টা করতে হবে? চেষ্টা কেমন করে করে? আমাকেই করতে হবে? আব্বুকে বললে করে দিবে না? মনটা ভাসছে একটা limbo তে।
অনেকগুলো বই জমে আছে পড়ার বাকি। তা নাহয় এক এক করে পড়লাম। নতুন মুভিও নাহয় দেখলাম। কাজে লাগবে এমন কোন পড়াশোনা বা অন্য কিছুও নাহয় করলাম। তবু কেমন যেন লাগে। দুলকি চালে চলা বোধ হয় থামাতেই হবে।
এসব অলংকার পরানো কথা শুনলে আমার মত অবস্থার মানুষেরা ছাড়া অন্য যে কারো মনে হতে পারে তিনটা দিন পার হতে না হতেই আদিখ্যেতা, সত্যিকার মাঠে নামো তারপর দেখি কি কর। মা বাবার হোটেলে খেয়ে, গুছিয়ে দেয়া ঘরে ঘুমিয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজটা চাইলেই সবাই করতে পারে। অনেকটা নন্দদুলালের মত বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবা, কিছু একটা করতেই হবে। কতটুকু Practical যোগ্যতা যে আমার আছে জানি না। আমার করা কোন কিছু কারো পছন্দ হবে কিনা কে বলবে। আবার এও বিশ্বাস করি যে আমি মোটেও ফেলনা না। সবাই একসময় আমার মত ছিল । তারা যখন অনেককিছু পারে আমিও অবশ্যই পারি এবং পারব। চেষ্টা করলে কি না হয়। সাথে সাথে মনে হয়, ও চেষ্টা করতে হবে? চেষ্টা কেমন করে করে? আমাকেই করতে হবে? আব্বুকে বললে করে দিবে না? মনটা ভাসছে একটা limbo তে।
অনেকগুলো বই জমে আছে পড়ার বাকি। তা নাহয় এক এক করে পড়লাম। নতুন মুভিও নাহয় দেখলাম। কাজে লাগবে এমন কোন পড়াশোনা বা অন্য কিছুও নাহয় করলাম। তবু কেমন যেন লাগে। দুলকি চালে চলা বোধ হয় থামাতেই হবে।
Subscribe to:
Posts (Atom)