Tuesday, March 4, 2008

ব্যাংক কলোনি

কিছুদিন আগে একটা নাটক দেখলাম যার সেটিং ছিল মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনি। আমার অতি পিচ্চিকালের এলাকা। My pre-childhood. তখনকার চেয়ে এখন দেখতে ভাল। বেশকিছু renovation করা হয়েছে। আর টিভিতে আরো ভাল লাগছিল। দীপু নাম্বার টু বইয়ের দীপু একেক বছর কাটায় একেক স্কুলে। সরকারী চাকরি করার কারণে তার বাবার পোস্টিং হয় ঘুরেঘুরে দেশের নানান জায়গায়, বাবার সঙ্গে দীপুও আজ এখানে কাল ওখানে। দীপু একা না, এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। দুই তিন বছর পরপর নতুন বাড়ি, নতুন স্কুল, নতুন বন্ধু, নতুন পরিবেশ। আর আমার ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। জন্ম থেকে আজ অবধি আমার বাস এখানে। এটা আমাদের অষ্টম বাসা কিন্তু এই আটটা বাসাই আধ বর্গকিলোমিটারেরও কম পরিধির মধ্যে। আমার প্রথম কয়েক বছর কেটেছে মতিঝিলের ব্যাংক কলোনিতে। কুচি কুচি অনেক কিছু কথা মনে আছে। সবচেয়ে ভাল মনে আছে প্রায় বিকালে আব্বুর সাথে আমি নটরডেম কলেজের ভেতরে বেড়াতে যেতাম। অনেকরকম গাছ কলেজ ক্যাম্পাসে। সেখানে এক কোণায় একটা ছোটখাটো কমিউনিটি সেন্টার ছিল। সাদা কাপড় বিছানো টেবিলের উপর প্লেট আর গ্লাস উপুড় করে রাখা হত। এই কলোনির কয়েকটা বছরে আমরা মোট মিলিয়ে তিনটা বাসায় ছিলাম, অর্থাৎ এক কামরার সাবলেট হয়ে। তিনটা বাসাতেই সঙ্গী পরিবারের ভাইবোনের সংখ্যা ছিল বেশ ভালরকম। তিনটা রুমের মধ্যে একটা আমাদেরকে ছেড়ে দিয়ে এত মানুষ কোথায় থাকত কে জানে। এখানে রোজার দিনে ইফতারের আগে কাঠের গুঁড়োতে ঢাকা বরফ কিনতে পাওয়া যেত। সারা কলোনি জুড়ে অনেক বড় বড় ছেলেমেয়ে ছিল (ক্লাস টু থ্রি) আর এখানে এক ধরণের হলুদ রঙের আইসক্রিম বিক্রি হত। আমার ঠাণ্ডা লাগলে ভোরবেলায় আমি আর আব্বু বিল্ডিংয়ের সামনে থেকে তুলসী পাতা ছিঁড়ে নিতাম, তুলসী পাতার রসকে আদার রস আর মধুর সঙ্গে মিলিয়ে খেতে খুবই মজার। তেলা নামে একজন পাগলাটে ধরণের লোক ছিল এখানে, ছোটদের জন্য ভয়ের উৎস। কলোনি ছাড়ার কয়েক মাস পরই আমি স্কুলে ভর্তি হই আর আমার স্মৃতি আস্তে আস্তে জোরালো হতে থাকে।

স্কুলের কারণে ব্যাংক কলোনিতে কয়েক বছর রোজ আসাযাওয়া হত। এই স্কুলে আমার সময়টা মজায় কেটেছে। এখন ভাবলে অদ্ভুত লাগে একসময় আমার স্কুলবেতন ছিল ছয় টাকা। এখানে বেশিরভাল ক্লাসেই মারাত্মক রকমের হাসাহাসি হত। ছুটির পর সবচেয়ে মজার খেলার নাম ‘পাক্কাপাক্কি’ যদিও খেলাটার নিয়মকানুন একেবারেই মনে নেই এখন। টিফিন টাইমে গেটের বাইরে এসে আচার হাওয়াই মিঠাই বা পাইপ আইসক্রিম খাওয়ার অফুরন্ত সুযোগ। ক্লাস ওয়ানে ওঠার পরীক্ষার রেজাল্টের পর আমাকে পুরস্কার দেয়া হয় একটা বিচিত্র ট্রাভেল ব্যাগ। আমার ধারণা ছিল ছবিওয়ালা বই দেয়া হয়, সুতরাং বড়ই আশাহত হই আমি। তার উপর পরে আবার দেখা গেল ব্যাগের গায়ে সাঁটা কাগজে আমার নামে ভুল। তবে মোটের উপর এখানে স্কুললাইফটা অসাধারণ কেটেছে। রাস্তায় মাঝে মাঝে ব্যাংক স্কুলের ক্লাসমেটদের কাউকে কাউকে দেখি। আমার মনে হয় ওরা আমাকে চিনতে পারে না। অথবা আমার মতই না চেনার ভান করে।

কলোনিতে থাকা শেষ বাসাটারও নিজেদের রুমের সাজসজ্জা আমার মনে পড়ে না। স্মৃতির গাঁথুনি শক্ত হবার জন্য বয়সটা কম। সত্যি কথা বলতে কি যেসব ব্যাপার আমার মনে আছে বলে আমি মনে করি (হলুদ আইসক্রিমের কথা ছাড়া) তার বেশিরভাগই পরবর্তীতে তৈরি হয়েছে বলে আমার ধারণা। কারণ এখান থেকে চলে গেলেও আরো অনেকদিন পর্যন্ত এখানে বিকালবেলা ঘোরাঘুরি করা হত। কারণ তার পরিচিত মানুষজন আর আমার দৌঁড়াদৌড়ি করার ভাল জায়গা থাকার কারণে আমাকে সঙ্গে নিয়ে আব্বুর বিকাল এখানেই কাটত। স্মৃতি নিজের হাতে তৈরি হবার আরেকটা কারণ হল আমি বেশ বড় হওয়া পর্যন্ত আব্বুর কাছে পিচ্চিকালের কয়েকটা গল্প বারবার শুনতে চাইতাম। সেই গল্পগুলিতে কিছু সাধারণ সত্যি ঘটনার বর্ণনা নাটকীয়ভাবে মোড় নিত। তাই এখন মনে হয় যে যেসবকে সত্যি ভাবি তার অনেককিছুই গল্প শুনে আমার মনের মধ্যে বসে যাওয়া ছবি।

কলোনিটা এখনও হাতের কাছেই আছে। দেখতে ভাল হয়েছে। বারান্দাগুলোতে গ্রিল বসেছে। সন্ধ্যায় আশপাশের অনেক স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ হাঁটতে আসে। তবে বাল্ব জ্বালিয়ে ছেলেদের ব্যাডমিন্টন খেলাটা চালু আছে কিনা জানি না। টিনএজার ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবসময়ই একটা ড্যামকেয়ার ভাব থাকে। যখন এখানে থাকতাম ছোট ছিলাম বলে তারা কেউ পাত্তাই দিত না। আর এখন যখন আবার কিছুটা যাওয়া আসা করার স্কোপ পেয়েছি বড় হয়ে গেছি দেখে কেউ পাত্তাই দেয় না।