Monday, December 31, 2007

গ্রামভ্রমণ ২

অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় canopy শব্দটা শিখেছিলাম। এর অর্থ হল চাঁদোয়া। আর পুরো ব্যাপারটার মানে বোঝার জন্য মোক্ষম উদাহরণ হল ঢাকা চট্টগ্রাম রোডের অনেকদূর পর্যন্ত চলে যাওয়া গাছের ছাউনি। রাস্তার দুই পাশ থেকে উঁচু গাছের ডালপালা রাস্তাকে ঢেকে রাখে। এই ঈদে গ্রামের বাড়ি যাবার সময় ভালমত চোখে পড়েনি। কারণ আমার সিটটা সুবিধাজনক জায়গায় ছিল না। সম্ভবত শীতের জন্য গাছের পাতারও কমতি ছিল। এবার বেশ লম্বা সফর দিয়ে এলাম বাড়ি থেকে। ঢাকা শহর থেকে বেরিয়ে যেতে পারলে পথটা সুন্দর হয়ে যায়। আবার একটু পরপর মাইলফলক থাকে রাস্তায়, লেখা থাকে চট্টগ্রাম এত কিলোমিটার, একটু পর সংখ্যাটা এক দুই করে কমে আসে। আমি হিসাব করতে থাকি আর কতদূর বাকি। বছরে মাত্র একবারই যাওয়া হয় আমার। সেই যাওয়া নিয়েও ঘ্যানঘ্যানানির শেষ নেই। দুই একদিন পরই আমার কষ্ট লাগতে থাকে। হঠাৎ করেই প্রেসক্লাব, শাহবাগ অথবা বেইলি রোডের জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করতে শুরু করে যেন আমার প্রাণভোমরা কদম ফোয়ারার শলা বা এই জাতীয় আর কোথাও বিপদজনক ভঙ্গীতে লটকে আছে। হৃদয়ের এই ক্ষরণ আবার বাবা মা বা ছোটচাচা ছাড়া কাউকে দেখানোও যায়না। ধাড়ি মেয়ের ন্যাকামি মনে করবে অন্যেরা। তবে কিন্তু সবসময়ই একই ঘটনা হয়; যাওয়ার আগে যেতে ইচ্ছা করেনা আর ঢাকায় ফেরার আগে ইচ্ছা করে আরেকদিন থেকেই যাই না কেন।

প্রথম কয়েকদিন ছিলাম দাদাবাড়ি। একতলা ইটের বাড়ি। কিছু বছর আগেও ছিল একটা টিনের চালের বেড়ার ঘর। সেটাও আবার বহুকালের ঝড়ঝাপ্টার কারণে পুবদিকে মুখ করে মাটির সঙ্গে সত্তর ডিগ্রি কোণে হেলানো। এখন ছোটখাটো বিল্ডিং।ন আমাদের রুমটাই সবচেয়ে ভাল। এবার দেখলাম প্রায় সবার উঠানে ধান মাড়াই করার একটা বিচিত্র মেশিন। ছোটরাও কাজ করতে পারে। এবছর ধান উঠানোর পরপরই ঈদ হল। তবে এবার নাকি ফলন খুব খারাপ হয়েছে। গ্রামের পথে হাঁটতে কিন্তু খুব ভাল লাগে। দুই পাশে ক্ষেত, আর রাস্তার দুই ধারে একের পর এক শিম গাছ। একটু পরপর গাছির খোঁচায় গায়ে সিঁড়ি হয়ে যাওয়া খেজুর গাছ, মোচা ঝুলতে থাকা কলাগাছ, চালকুমড়ার বা লাউয়ের মাচা আর চিনতে না পারা বাকি সব গাছপালা তো আছেই। খানিকক্ষণ পরপর ঘুঘু আর শালিক নেচে যায়। গ্রামে যাওয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হল পথে পথে ঘুরে বেড়ানো। ক্ষেতের শীষ থেকে ছিঁড়ে নেয়া আধপাকা ধান থেকে বের করা চাল আবার বিশেষ মজা। যদিও আমি জানি এটা বিলাসি মনগড়া স্বাদ, সত্যিকার কিছু না। তবে রাত নামার পর সময় কাটানোটা বড়ই কঠিন। রাত যেন কাটেই না, কাটেই না। সাড়ে দশটা বাজতেই শুয়ে পড়তে হয়। কিছু করার থাকে না। চাচাতো ভাইবোনেরা বেশি ছোট আর বড়রা বেশি বড়। কয়েকদিন পর নানাবাড়ি চলে গেলাম। এখানেও রান্নাঘর আর স্টোররুমের (মানে যেখানে লাকড়ি ধানের গোলা এসব জিনিস ছিল) অংশটা মিলিয়ে গিয়ে ওখানে একটা ইটের বাড়ি হচ্ছে, আপাতত অর্ধসমাপ্ত। ছাদের উপর বসে পেট ভরে রোদ খেয়েছি। নানাবাড়ির মূল ঘরটা হল মাটির। আমার সবসময়ই মনে হয় প্রবল বৃষ্টি হলে এই সাধের মাটির ঘর বিশাল একতাল কাদাতে পর্যবসিত হবে এবং ধরণীর বুকে লেপ্টে মিশে যাবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত দেখি নিরাপদ আছে। আমাদের অঞ্চলে মাটির বাড়ি তেমন দেখা যায়না। এই বিষয়ে একটা জ্ঞান অর্জন করেছি আমি। তা হ্ল যেসব এলাকা মোটামুটি সাগরের কাছাকাছি সেসব জায়গার মাটি লবণাক্ত হওয়ার কারণে ঝরঝরে হয়, তাই মাটি দিয়ে ঘর বানানো হয় না। যাই হোক নানাবাড়িতে ভালই কাটলো। ফুপুর বাড়ি গেলাম, খালার বাড়ি গেলাম। “চান্দের গাড়ি”তে চড়লাম। সবই ভাল লেগেছে। আমি আবার প্রতিবারই পাঁচমিশালি কুচোমাছ, খইয়ের মোয়া, গজা এসব জিনিসের জন্য আহ্লাদ করি। ওখানে এগুলো অন্যরকম স্বাদের। এবার ছিল বেশ ঠান্ডা। মজার ব্যাপার হল ভোরে আর রাতে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করা। অনেক শীত পড়লেও এটা ঢাকায় পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

আমাদের ওদিকে কোথাও যাওয়া আসা একটা কঠিন কাজ। হেঁটে হেঁটে বড় রাস্তায় উঠতে হয়। তারপর অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় সি এন জি অথবা বিলুপ্তপ্রায় হলুদ বেবিট্যাক্সির জন্য। প্রাপ্তবয়স্ক যাত্রী হলে একেকটা বাহনে কমপক্ষে পাঁচজন বসবে এটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক। তিনজন পেছনের সিটে আর বাকি দুই জন হল ড্রাইভারের দুইপাশে। তাছাড়া বাচ্চাকাচ্চা আর ব্যাগট্যাগ তো আছেই। আরেকটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, বাড়ি থেকে অনেক দূরে বাজার, কিন্তু মোটামুটি সবাই সবার পরিচিত। সবাই বিকালের দিকে বাজারে যায়। সপ্তাহে দুই দিন হল হাট আর বাকি দিন বাজার। হাট এবং বাজার। আমরা তো ঢাকা থেকে সরাসরি যাই দাদাবাড়ি। বেশ প্রত্যন্ত অঞ্চল। নতুন কেউ আসলেই লোকজনের কাজ হল হাঁ করে তাকিয়ে থাকা। এটা আমার একেবারেই পছন্দ না। তবে স্কুলে পড়ার সময় বাজারে নেমে আমার প্রথম কাজ ছিল পথচারী এবং তাকিয়ে থাকা লোকজনকে বুঝিয়ে দেয়া যে আমরা যে শুধু বাইরে থেকেই এসেছি তা না, আমরা হলাম ‘ঢাকা’র মানুষ। বিশেষ করে আমি ওই শহরের মেয়ে যেটা তাদের বেশিরভাগই কেবল টিভিতে দেখেছে বা বইপত্রে পড়েছে। তাই আমার দায়িত্ব ছিল জোরে জোরে আব্বুআম্মুর সাথে ‘শুদ্ধ’ ভাষায় কথা বলা। মাঝে মাঝে একটু চিন্তায় পড়ে যেতাম আচ্ছা ওরা ঠিকঠাক বুঝতে পারল তো যে আমি ঢাকা থেকে এসেছি, আবার অন্য কোন শহর মনে করল না তো। আমাকে আহামরি গোছের ভাবল তো। আমার একেবারে পিচ্চিকালে মেঘনা ব্রিজ ছিল না, ছিল ফেরি। টিভি ছিল আরো কম ঘরে। আর মোবাইল ফোনের বিস্তার তো ছিলই না। তাই তখন ঢাকা যে কিছুটা মূল্যবান ছিল একথা বলতে গলায় জোর দেয়া যায় বৈকি।

একটা কথা না বললেই না; গ্রামাঞ্চলের ছেলেমেয়েরা অল্পবয়স থেকেই অনেক কাজকর্ম করতে শেখে। এটা একটা খুব ভাল বৈশিষ্ট্য। কিন্তু গ্রামের মানুষ সহজ সরল, তাদের মনটা কোমল কিংবা বেঁচে বর্তে দিন কাটিয়ে দিতে পারলেই তাদের মুখে স্বর্গীয় হাসি খেলা করে এসব পুস্তকি কথাবার্তা আমার কখনোই সত্যি মনে হয় না। ওখানে সংস্কার কুসংস্কার আর রীতিনীতির বেড়াজাল বরং একটু বেশিই স্থূল। রসিকতাগুলো অন্যরকম যেটা আমি কমই মাথায় ঢোকাতে পারি। এটিকেট অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নারী পুরুষের ব্যবধান খালি চোখে ভালমত ধরা পড়ে। আর আশি ভাগ কথাবার্তার বিষয়বস্তু হল পারিবারিক ঘটনাবলী। আমি যে মানাতে পারি না এর কারণ শুধুমাত্র অনভ্যস্ততাও অবশ্য হতে পারে। যখন আলাপচারিতার মধ্যে বসে থাকি, কথা শুনতে শুনতে একসময় মনে হয় আমি আসলেই এখানকার মানুষ না। হতে পারে গ্রামের বাড়ি দেখতে অনেক সুন্দর হয়, মেঠো পথে দম নিয়ে হাঁটতে পারা যায়, প্রকৃতির স্পর্শ পাওয়া যায়, কিন্তু আমার জন্য আমার যন্ত্র শহরই ভাল। জন্মভুমির একটা মায়া আছেই। নইলে ডাস্টবিন, ট্রাফিক জ্যাম আর কালো ধোঁয়ার কাছে ফিরে আসতে এত ভাল লাগত?

Sunday, December 9, 2007

গ্রামভ্রমণ

প্রায় সপ্তাহ দুয়েক পর কুরবানির ঈদ। ঈদ আমার কাছে আহামরি কোন আনন্দের বিষয় না। তার উপর এবার আমাকে থাকতে হবে আমাদের গ্রামের বাড়িতে। দাদাবাড়িতে ঈদ আর ঈদের দুই দিন পর নানাবাড়িতে সফর। এই বাসৎরিক বেড়ানোটা একসময় ছিল খুবই আনন্দের। ঢাকায় ফিরে আসার আগে আমি কান্নাকাটি জুড়ে দিতাম। তখন উঠান দাপিয়ে খেলার সঙ্গী ছিল, খবরদারি করার জন্য কলেজে পড়া বড় আপুরা ছিল, সারাদিন মাঠেঘাটে চরে বেড়ানোর আগ্রহও ছিল। এখন সেই তুলনায় আমি নিঃসঙ্গ। বড়রা নিজের পরিবার গড়ে নিয়েছে, সমবয়সীদের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্য নেই, আর ছোটরা একটু বেশিই ছোট। তবে সময়টা খারাপ কাটে না। গৎবাঁধা রোজনামচার একঘেয়েমি দূর হয়। এখন শীতকাল, তাই গ্রামে বেড়ানোটা বরং ভাল হবে। তবে একটা জিনিস খুব মিস করব; কচুরীপানার ফুল। আগে গ্রামে যাবার পথে রাস্তায় ধারে ধারে পুকুর ভরা কচুরীপানার ফুল দেখা যেত। আর আমি বেবিট্যাক্সি থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতাম। এই কয়েক বছরে ঈদটা সরে আসার কারণে ফুল ফোটার সময়টা ধরতে পারিনা। আর হয়ত পানা পুকুরের সংখ্যাও আগের মত নেই। দুঃখের ব্যাপার! আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলোর তালিকা করতে চাইলে এক অথবা দুই নাম্বারে থাকবে জংলা পুকুর ভর্তি জ্বলজ্বলে কচুরীপানার ফুল। গাঢ় সবুজের পটভূমিতে হালকা বেগুনি রঙের স্থির আগুন। শুধু যে দেখতে সুন্দর তা না, দৃষ্টি ছাড়িয়ে যেন মনস্তত্ত্বে পৌঁছে যায়। জলজ উদ্ভিদ বলে চোখকাড়া উজ্জ্বল রঙ। এই ফুলটা আবার ছিঁড়ে আনলে বিবর্ণ দেখায়, তাছাড়া নেতিয়েও পড়ে একটু পর। এজন্য কখনো ঢাকার ফুলের দোকানে একে দেখা যায় না। আমার সবচেয়ে প্রিয় ফুল কোনটা একথা কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে না কেন? কচুরীপানা নিয়ে আদিখ্যেতা করার একটা সুযোগ পেতাম। বেলী তো কেবল বিপুল ভোটের ব্যাবধানে দ্বিতীয় নাম।

আমার দাদাবাড়ির গ্রামে ইলেকট্রিসিটির নামসর্বস্ব খুঁটি এখনো বসেনি। নিকট ভবিষ্যতেও পৌঁছার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং সন্ধ্যার পর হ্যারিকেনের রাজত্ব। আমি অনেকদিন পর জানতে পেরেছি যে গ্রামে একেকটা পরিবারের অংশকে বলতে হয় ঘর, আর অনেকগুলো ঘর নিয়ে একেকটা বাড়ি। তাই বাড়ি সাধারণত অনেক বড় হয়। এখানে ঘর বলতে রুম বুঝি, ওখানে বাসার পুরো জায়গাটা নিয়েই নাকি ঘর। একটু অদ্ভুত। আমাদের ‘বাড়ি’টা বেশ ছোট, অল্প কয়েকটা ‘ঘর’। তাই বেড়াতে গেলে আশেপাশের সবার সঙ্গে দেখা হয়, আদর যত্ন পাই। খুব ভাল লাগে তখন। চুপচাপ ধরণের। উপভোগ্য আরেকটা জিনিস হল ধোঁয়ার গন্ধ, পাতা পোড়ানোর গন্ধের সাথে অচেনা অন্য কিছু একটার মিশেল। খুব সুন্দর নেশা নেশা গন্ধটা। আমি নাক উঁচু করে খানিকটা খেয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। সেখানে চা হয় অন্যরকম। কোনটাতে গরুর দুধের তীব্র ঘ্রাণ, কোনটা আবার খুব কড়া মিষ্টি। সেই তুলনায় নানাবাড়ি বেশ বড়, মানুষও বেশি। ইলেকট্রিসিটি শেষ বিকাল থেকে রাতের খাবার সময় পর্যন্ত ছুটিতে থাকে। আমার স্বস্তিবোধটা কেন যেন এখানে কিছুটা কম। ছোটদের দলে ভিড়তে বাধে আর বড়দের আলাপের বিষয়বস্তু আমার ভাল লাগেনা। এই বয়সেও বার তের বছরের জ্যাঠা ছেলে ফটিকের মত নো ম্যান’স ল্যান্ডে পড়ে থাকি। সে যাই হোক, কুরবানির ঈদে গ্রামের বাড়ি যাওয়া বাধ্যতামূলক। যেতে হয় সাধারণত ঈদের আগের দিন। আর কি ভয়ংকর জ্যাম রাস্তায়! সাত সকালে বাসের জন্য স্টপেজে গিয়ে অপেক্ষা করতেই থাকি করতেই থাকি। সেই বাস যদিও একসময় আসে, গন্তব্যে পৌঁছতে কখনো কখনো সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। গ্রামে গেলেই টিভি নিউজপেপার আর ইন্টারনেটের জগত থেকে বিচ্ছেদ। মোবাইলের নেটওয়ার্কও বেশিরভাগ সময় খুব দুর্বল থাকে। তখন হঠাৎ করেই বোদ্ধা হয়ে পড়ি, যেন এসব আমি খুব বুঝি, এসব ছাড়া আমার যেন চলেই না। সব মিলিয়ে খারাপ যায় না সময়টা। সপ্তাহ খানেক পরে যখন ঢাকায় ফিরে আসি সেটাও আবার একটা আনন্দ; Home, sweet home টাইপের। তাই আমি এখন মনে মনে রেডি হচ্ছি ঈদের জন্য।